ভূমিকা: বাংলা নাটকের সার্থক সূচনা মধুসূদনে, কিন্তু এই নতুন শিল্প মাধ্যমটিকে আমাদের জাতীয় জীবনে অবিসংবাদি প্রতিষ্ঠা দান করেন দীনবন্ধু। নাটক সাহিত্যোর অন্যান্য শাখার মতো স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। রঙ্গমঞ্চের শিল্পীদের প্রয়োগ নৈপুণ্যেই নাটকের রসবস্তু আস্বাদনযোগ্য হয়ে উঠে। মধুসুদন পর্যন্ত বাংলা নাটক সীমাবদ্ধ ছিল কোলকাতার অভিজাত পরিবারগুলোর সৌখিন নাট্যচর্চা গণ্ডিতে। দীনবন্ধুর নাটক নিয়েই জনসাধারণের সংস্কৃতিচর্চার অংশ হিসেবে অভিনয় কলার নতুন পর্ব সূচিত হয়। গিরিশচন্দ্র ঘোষ দীনবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে লিখেছিলেন-

“বঙ্গে রঙ্গালয় স্থাপনের জন্য মহাশয় কর্মক্ষেত্রে আসিয়াছিলেন। মহাশয়ের নাটক যদি না থাকিত, এই সকল যুবক (ন্যাশনাল থিয়েটারের উদ্যোগিবৃন্দ) মিলিয়া ন্যাশনাল থিয়েটার স্থাপন করিতে সাহস করিত না। সেই নিমিত্ত আপনাকে রঙ্গালয় স্রষ্টা বলিয়া নমস্কার করি।”

দীনবন্ধুর নাট্যপ্রতিভা: নাট্যসাহিত্য বাংলাসাহিত্যের অন্যান্য শাখার তুলনায় অপেক্ষাকৃত দুর্বল। আজ পর্যন্ত যে সমস্ত নাট্যকার আমাদের সাহিত্যে আবির্ভূত হয়েছেন তাঁদের মধ্যে অনেকদিক থেকে দীনবন্ধুকে সর্বাপেক্ষা শক্তিমান লেখক বলে মনে করা হয়। পূর্বতন ঐতিহ্যের অনুবর্তন তিনি অনেক ক্ষেত্রেই করেছেন, বিভিন্ন উৎস থেকে নিজের রচনার উপকরণ সংগ্রহ করেছেন, কিন্তু আপন প্রতিভার শক্তিতে সেসব আহৃত উপকরণ দ্বারা তিনি অভিনব রসবস্তু সৃষ্টি করেছেন। দীনবন্ধু ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের শিষ্য হিসেবে সাহিত্যক্ষেত্রে আবির্ভূত হয়েছিলেন। ঈশ্বর গুপ্তকে আধুনিক যুগের প্রথম কবি বলা যায়, কিন্তু তাঁর রচনায় গ্রামীণ সংস্কৃতির, দেশজ ভাষারীতির প্রভাব খুব স্পষ্ট। তিনি আধুনিকতার মোহে স্বদেশের মৃত্তিকার আশ্রয় ত্যাগ করতে সম্মত হননি। ঈশ্বর গুপ্তের কবিতায় ভাষাপ্রয়োগের একটা বিশিষ্ট ভঙ্গি দেখা যায়। দীনবন্ধুর নাটকে সংলাপের ভাষায় ঈশ্বর গুপ্তের সেই ভাষাভঙ্গি অনেক ক্ষেত্রে অনুসৃত হয়েছে। পূর্ববর্তী লেখকদের মধ্যে মধুসূদনের রচনার হারা, বিশেষভাবে ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ নামক প্রহসনটির দ্বারা দীনবন্ধু বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছেন। তাঁর ‘নীলদর্পণ’ এর তোরাপ এবং অন্যান্য গ্রাম্য মানুষের চরিত্র রূপায়ণে এসব চরিত্রের সংলাপ রচনায় মধুসূদন সৃষ্ট হানিফ, গদাধর প্রভৃতি চরিত্র কল্পনার স্পষ্ট প্রভাব আছে। ‘নীলদর্পণ’ নাটকই দীনবন্ধুকে সাহিত্যক্ষেত্রে অবিসংবাদিতভাবে প্রতিষ্ঠিত করে। এই নাটকে যে সমস্যাটি কেন্দ্রীয় বিষয়, সেই নীলকরদের অত্যাচার-অনাচারের প্রসঙ্গ ইতোপূর্বে প্যারীচাঁদ মিত্র তার ‘আলালের ঘরের দুলাল’-এ ব্যবহার করেছিলেন। সমসাময়িককালে বিপুলভাবে সমাদৃত এই উপন্যাসের দ্বারা দীনবন্ধু প্রভাবিত হয়েছেন- এরূপ অনুমানের সঙ্গত কারণ আছে। প্যারীচাঁদের আর একখানি গ্রন্থ ‘মদ খাওয়া বড় দায়, জাত থাকার কি উপায়’ এ আগরভীমসেন নামে একটি চরিত্র আছে। দীনবন্ধু ‘নবীন তপস্বিনী’ নাটকে হোঁদলকুৎকুতের পরিকল্পনায় প্যারীচাঁদের এই চরিত্রটিকেই অনুকরণ করেছেন। প্রয়োজনবোধে কখনো রূপকথা থেকে, কখনো ইংরেজি বা সংস্কৃত থেকে তিনি রচনার উপকরণ সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু সংগৃহীত উপকরণ ব্যবহারের ভঙ্গিটি দীনবন্ধুর নিজস্ব। চরিত্র এবং ঘটনার বিন্যাসে তিনি সহজেই বাস্তবতার বার্তাবরণ সৃষ্টি করতে পারতেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেও বিভিন্ন চরিত্র অবিকল আপন রচনায় তুলে দিয়েছেন। বঙ্কিমচন্দ্রের মতে বাস্তব অভিজ্ঞতার সম্পদে দীনবন্ধু বাঙালি লেখকদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা সমৃদ্ধ ছিলেন। “বিস্ময়ের বিষয়, বাঙলা সমাজ-সম্বন্ধে দীনবন্ধুর বহুদির্শতা। সকল শ্রেণির বাঙ্গালীর দৈনিক জীবনের সকল খবর রাখে, এমন বাঙ্গালী লেখক আর নাই। বাঙ্গালী লেখকদের মধ্যে দীনবন্ধুই এ বিষয়ে সর্বোচ্চ স্থান পাইতে পারেন।”

নীলদর্পণ: ছাত্রজীবন থেকে দীনবন্ধু ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় কবিতা লিখতেন। তাঁর কোনো কোনো কবিতা সমসাময়িক পাঠকসমাজে সমাদৃতও হয়েছিল। কিন্তু নীলদর্পণই (১৮৬০) সাহিত্যক্ষেত্রে তাঁর অবিসংবাদিত প্রতিষ্ঠা এনে দেয়। দীনবন্ধুর এই প্রথম নাটকটি নীলদর্পণম নাটকম্’ গ্রন্থকারের নাম ছাড়াই প্রকাশিত হয়েছিল।

দীর্ঘকাল থেকে বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে ইংরেজ নীলকরদের অন্যায় উপদ্রব চলছিল। সিপাহি বিদ্রোহের পরে এই নীলচাষের উপর নীলকরেরা নানাভাবে উৎপীড়ন চালাত। ধানের জমিতে জোর করে নীল চাষ করতে বাধ্য করে এই ইংরেজ ব্যবসায়ীবৃন্দ চাষিদের সারা বছর ক্ষুধার অন্ন উৎপাদনের পথ বন্ধ করতো। অগ্রিম টাকা বা দাদন নিতে বাধ্য করে তারা চাষিদের চিরস্থায়ী ঋণের জালে জড়িয়ে পুরুষানুক্রমে শোষণ করতো। নীলচাষে অনিচ্ছুক কৃষকদের জোর করে আটক রাখা, তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া, প্রহার এবং বিভিন্ন প্রকার শাস্তির ব্যবস্থা এমনকি নকি মহিলাদের উপরেও অত্যাচার করতে তারা দ্বিধা করতো না। নিচু এলাকার প্রায় সবগুলো জেলায় ক্রমে এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে কৃষকদের সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে উঠে, কোলকাতার শিক্ষিত সমাজেও কৃষকদের এই দুরবস্থার প্রতিকারের জন্য আন্দোলন দেখা দেয়।

‘নীলদর্পণ’ একটি ঐতিহাসিক মর্যাদাসম্পন্ন রচনা। ডক্টর সুকুমার সেন যথার্থই বলেন, “দীনবন্ধুর নাটকে সর্বপ্রথম শাসক শাসিতের নিগূঢ় সম্বন্ধ, দেশের অর্থনৈতিক শোষণের কুৎসিত রূপ, সভ্য নামক মানুষের বর্বর অন্তর উদঘাটিত হইল। নীলদর্পণে সমগ্র দেশের মর্মবেদনার প্রকাশ হওয়ায় দেশে যেমন সাড়া পড়িয়াছিল তেমনটি ইতিপূর্বে কখনো ঘটে নাই।”

‘নীলদর্পণ’ প্রকাশের ফলেই কৃষকদের উপরে অত্যাচার রোধকল্পে দেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ দেখা যায় এবং সরকারী মহল সক্রিয় হয়ে উঠে। ইংল্যান্ডেও এই আন্দোলনের প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ক্রমে নীলচাষ বন্ধ হয়ে যায় এবং বাঙলার কৃষককুল বহুদিনের অত্যাচার উৎপীড়ন থেকে মুক্তি পায়।

নীলদর্পণের বৈশিষ্ট্য: নাটকটি গড়ে উঠেছে গোলকচন্দ্র বসুর পরিবারকে কেন্দ্র করে। সম্পন্ন গৃহস্থ গোলক বসু, তার পরিবার পরিজন এবং তার প্রজাবৃন্দ এই নাট্যকাহিনির প্রধান চরিত্র। গোলক বসুর পুত্র নবীনমাধব এই কাহিনির নায়ক। কৃষকদের উপরে অত্যাচার রোধ করতে গিয়ে নবীন বসু এবং গোলক বসুকে বিপন্ন হতে হয়েছে। গোলক বসুর আত্মহত্যার, নবীনমাধব এবং সরলার মৃত্যু, সাবিত্রীর উন্মাদ দশা এবং মৃত্যু-ইত্যাদির শোচনীয় ঘটনায় নাটকটি শেষ হয়। এই বিষাদকে ঘনীভূত করে ক্ষেত্রমণির মৃত্যু। শিল্পের বিচারে ‘নীলদর্পণ’ নাটককে রসোত্তীর্ণ বলা যায় না।

পারম্পর্যের অভাব, একের পর এক মৃত্যু দৃশ্য ন নাটকটিকে একটি মেলোড্রামায় পর্যবসিত করেছে। কিন্তু এ নাটকের চাষি চরিত্রগুলো রূপায়ণে, সাধারণ মানুষের মর্মান্তিক জীবনসঙ্কট চিত্রণে দীনবন্ধু অসামান্য নাটকীয় প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। সাধুচরণ, রাইচরণ, রেবতী, ক্ষেত্রমণি, আদুর, পদী বা আমিন প্রভৃতি চরিত্রসৃষ্টিতে দীনবন্ধু যে বাস্তবতাবোধ এবং মানবচরিত্র বিষয়ে অভিজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছেন তা আমাদের সাহিত্যে তুলনারহিত।

দীনবন্ধুর আরো নাটক: দীনবন্ধু মিত্রের অন্যান্য নাটক ‘নবীন তপস্বিনী’ (১৮৬৩), ‘বিয়েপাগলা বুড়ো’ (১৮৬৬), ‘সধবার একাদশী’ (১৮৬৬), ‘লীলাবতী’ (১৮৬৭), ‘জামাই বারিক’ (১৮৭২) এবং ‘কমলে কামিনী’ (১৮৮৩) ইত্যাদি। এর মধ্যে ‘সধবার একাদশী’ই দীনবন্ধুর শ্রেষ্ঠ রচনা। মধুসূদন ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ প্রহসনে নব্যশিক্ষিত যুবকদের চারিত্রিক ভ্রষ্টতার ব্যঙ্গচিত্র এঁকেছিলেন। দীনবন্ধুও অনুরূপ বিষয়বস্তুই ব্যবহার করেছেন ‘সধবার একাদশী’ নাটকে। কিন্তু দীনবন্ধুর রচনা প্রহসনের পরিহাস রসিকতার স্তর থেকে সিরিয়াস নাটকের পর্যায়ে উন্নীত।

‘সধবার একাদশী’র নায়ক নিমচাঁদ দত্ত চরিত্রে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত যুবকদের প্রতিচ্ছায়া আছে, কিন্তু তাকে টাইপ চরিত্র বলা যায় না। নিমচাঁদের প্রখর আত্মসচেতনতা, দুর্মর প্রবৃত্তির মতো মদ্যাসক্তির জন্য জীবনের সকল সম্ভাবনা বিনষ্ট হওয়ায় দুঃখবোধ এবং বিশুদ্ধ জীবন সুখ বিফলীকৃত শিক্ষার জন্য আক্ষেপ-তাকে একটি ব্যক্তিবৈশিষ্ট্যে মণ্ডিত চরিত্রে পরিণত করেছে। নিমচাঁদকে কখনোই প্রহসনের টাইপ চরিত্র মনে হয় না, বরং মনে হয় শিক্ষা দীক্ষায় পরিমার্জিত, জীবনের শুভাশুভ বিষয়ে প্রখর চেতনাসম্পন্ন একটি মানুষ প্রবৃত্তির দুচ্ছেদ্য বন্ধনের মধ্যে নিজেকে ক্ষয় করছে। নিমচাঁদ চরিত্রের জন্যই ‘সধবার একাদশী’ প্রহসনের সীমা অতিক্রম করে গভীর রসাত্মক নাটকে পরিণত হয়েছে।

‘নবীন তপস্বিনী’, ‘কমলে কামিনী’ এবং ‘লীলাবতী’তে অংশত রোমান্টিক প্রেম কাহিনি রচনা করতে গিয়ে দীনবন্ধু ব্যর্থ হয়েছেন, কিন্তু এদের মধ্যে যেখানে কৌতুকরসের আয়োজন করেছেন সেইসব অংশ অবিস্মরণীয়। নাটক তিনটি সামগ্রিকভাবে সফল রচনা না হলেও ‘নবীন তপস্বিনী’র জলধর বা ‘লীলাবতী’র নদেরচাঁদ হেমচাঁদ চরিত্রসৃষ্টির দুর্লভ শক্তিতে দীনবন্ধু অনায়াস অধিকারের পরিচয় দেন। এই নাটক তিনটির তুলনায় ‘বিয়ে পাগলা বুড়ো’ এবং ‘জামাই বারিক’ অনেক উপভোগ্য রচনা।

বিয়েবাতিকগ্রস্ত বৃদ্ধ বাজীবের বিড়ম্বনা ‘বিয়েপাগলা বুড়ো’র কয়েকটি কৌতুকপ্রদ পরিস্থিতির মধ্যে চিত্রিত হয়েছে। ‘জামাই বারিক’ এর ঘরজামাইয়ের দল যে বিচিত্র জীবনযাত্রা নির্বাহ করে তারই চিত্র হাস্যরসের প্রধান উৎস, কিন্তু এর সঙ্গে দুটি উপকাহিনি যুক্ত হওয়ায় হাস্যরসের বৈচিত্র্য দেখা দিয়েছে। এর কাহিনি অংশ অপেক্ষাকৃত জটিল। অভয়কুমার ও কামিনীর উপকাহিনীতে কামিনী চরিত্রে আত্মমর্যাদা জ্ঞানসম্পন্ন নতুন ধরনের নারী চরিত্রের সন্ধান পাওয়া যায়।

দীনবন্ধু বিভিন্ন নাটক রচনায় সাফল্য অর্জন করতে পেরেছেন। একটা জীবন্ত আদর্শকে সামনে রেখে দীনবন্ধু বিভিন্ন চরিত্র অঙ্কন করতেন বলেই তাঁর অঙ্কিত চরিত্রগুলোও এমন জীবন্ত হয়ে উঠতো।

পরিশেষে বলা যায় যে, দীনবন্ধুর নাটকে যথেষ্ট অভিনয় উপযোগিতা থাকায় সাধারণ নাট্যশালায় অত্যধিক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। তৎকালীন জনসমাজে প্রহসন জাতীয় নাট্যরচনা বিশেষ সমাদৃত হতো। দীনবন্ধু এ শ্রেণির রচনায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন’। তিনি ছিলেন সামাজিক রীতিনীতির একজন দর্শক। পৃথিবীর পরিচিত যেসব ঘটনা তার দৃষ্টিগোচর হয়েছে এবং তার মধ্যে যেসব অসংগতি রয়েছে তা তিনি হাস্য কৌতুকের মাধ্যমে নাটকে তুলে ধরেছেন। ফলে এ শ্রেণির রচনাগুলো যথেষ্ট সমাদর লাভ করেছে। আর এ কারণেই বাংলা নাটকে দীনবন্ধু মিত্র নিজস্ব অবস্থান করেনিয়েছেন।

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।

5/5 - (1 vote)