আর্সেনিক 

আর্সেনিক একটি বিষাক্ত মৌলিক পদার্থের নাম। এর প্রতীক (As), পারমাণবিক সংখ্যা ৩৩ এবং ভর ৭৪.৯২। এটি একটি ত্রিযােজী মৌলিক পদার্থ। ভূগর্ভস্থ পাথরের স্তরে পাইরাইটস (FeS,) নামে একটি যৌগ আর্সেনিককে ধরে রাখে। ভূ-গর্ভ থেকে অতিরিক্ত পানি উত্তোলনের ফলে পানির স্তরের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। অন্যদিকে পাইরাইটস জারিত হওয়ার সময় যে এসিড তৈরি হচ্ছে তা খনিজ পদার্থের সঙ্গে বিক্রিয়া করে আর্সেনিককে যুক্ত করছে। সুতরাং ভূ-রাসায়নিক বিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আর্সেনিক বেরিয়ে এসে পানিতে দ্রবীভূত হচ্ছে এবং আর্সেনিকযুক্ত হচ্ছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ১৯৭৮ সালে প্রথম অর্সেনিক দূষণের সংবাদ পাওয়া যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর মতে, আর্সেনিকের সহনশীল মাত্রা হলাে ০.০০৫ পিপিএম, অর্থাৎ প্রতি দশ কোটি ভাগের পাঁচ ভাগ মাত্র। ১৯৮৩ সালে ভারতে আর্সেনিকের মাত্রা বেড়ে গেলে তারা ভূ-গর্ভস্থ পানি পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করে। এরপর ১৯৮৮ সালে ভারত আবারও আর্সেনিক দূষণ নিয়ে ব্যাপক পরিসরে গবেষণা শুরু করে। বাংলাদেশ সরকার ১৯৯০ সালে ভারতের এ ধরনের গবেষণা সম্বন্ধে জ্ঞাত হয়ে পশ্চিমবঙ্গের পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আর্সেনিক দূষণ বিষয়ক জরিপ পরিচালনা করে। ১৯৯৬ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব ও খনিজবিদ্যা বিভাগ থেকে পশ্চিমবঙ্গের আর্সেনিক কবলিত এলাকার নিকটস্থ বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলা থেকে ৬০০টি পানির নমুনা কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানাে হয়। পরে SOES (School of Enviroment, University of Jadabpur, India) ও (NIPSOM বাংলাদেশ) যৌথভাবে পরীক্ষা চালিয়ে বাংলাদেশের ১৭টি জেলায় আর্সেনিকের দূষণ দেখতে পায়। মানবদেহে আর্সেনিকের বিষক্রিয়া ব্যাপক ও ভয়াবহ। এর ক্ষতিকর লক্ষণটি দীর্ঘদিন পরে চোখে, পড়ে। প্রথমত আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করার ফলে দেহে ও হাতের তালুতে বাদামি ছােপ দেখা যায় যাকে ‘স্পটেড মেলানােসিস’ বলা হয়। আবার এ লক্ষণ সবার ক্ষেত্রে নাও দেখা যেতে পারে। কোনাে কোনাে রােগীর ক্ষেত্রে পা ও পেটের চামড়া পুরু হয়ে যায়, আঙুল বেঁকে যায় এবং শরীর অসাড় হয়ে পড়ে। অনেক সময় পায়ের আঙুলের মাথায় পচন ধরে। আর্সেনিক বিষক্রিয়ায় জিহ্বা, মাড়ি ও ঠোটে মারাত্মক ক্ষত সৃষ্টি হয়। ক্ষুধামন্দা, হাত-পা ফোলা এমনকি লিভার আক্রান্ত হয়ে লিভার ক্যানসারও হতে পারে। বাংলাদেশ একটি আর্সেনিক ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসাবে ইতােমধ্যে পরিচিতি পেয়েছে। দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৫৯টি জেলায় ৪৮ লক্ষ নলকূপের মধ্যে ১৩ লক্ষ নলকূপের পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক রয়েছে। বাংলাদেশ কমিউনিটি মেডিসিনের চিকিৎসা-বিজ্ঞানীদের সহযােগিতায় ১৯৯৩ সালে নলকূপের পানি পরীক্ষার কাজ শুরু হয়। এছাড়াও বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি সংস্থা নলকূপের পানিতে আর্সেনিক পরীক্ষা করে আর্সেনিক-দূষণ সম্বন্ধে গণসচেতনতা সৃষ্টি করেছে। তদুপরি এ দূষণের মাত্রা পৃথিবীর অন্য যেকোনাে দেশের তুলনায় সর্বাধিক। ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে প্রায় সাত হাজার রােগী আর্সেনিক ক্যানসারে আক্রান্ত। এ ভয়াবহ দূষণ থেকে রক্ষা পাওয়ার সঠিক পদ্ধতি আজও অনাবিষ্কৃত। তবে পুকুর, নদী-নালা ও বৃষ্টির পানি পান ও ব্যবহারের মধ্য দিয়ে একে অনেকটা প্রতিরােধ করা সম্ভব বলে গবেষকরা মত দিয়েছেন। আর্সেনিকে আক্রান্ত মানুষ প্রথম থেকে আর্সেনিকমুক্ত পানি, পুষ্টিকর খাবার এবং হালকা ব্যায়াম করেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে। আমাদের হতাশ হলে চলবে না বরং যেভাবে কলেরা, বসন্ত, যক্ষ্মাকে তাড়িয়েছি, তেমনিভাবে সকলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে আর্সেনিক দূষণকে প্রতিরােধ করার দৃঢ় | প্রত্যয়ে এগিয়ে যেতে হবে ।

Rate this post