প্রতিবেদন সম্পর্কিত প্রাথমিক ধারণা

ইংরেজি Report (রিপাের্ট) শব্দটির বাংলা পারিভাষিক শব্দ হলাে প্রতিবেদন। ‘Report’ শব্দটির আভিধানিক বা শাব্দিক অর্থ হলাে সমাচার, বিবরণী বা বিবৃতি। প্রতিবেদন’ ও ‘রিপাের্ট দুটি শব্দই বাংলা ভাষায় বহুল প্রচলিত। কোনাে নির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কে প্রয়ােজনীয় তথ্যানুসন্ধানের পর উক্ত বিষয় সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে বিবরণী পেশ করার নামই প্রতিবেদন। প্রতিবেদন হলাে বিশেষ কৌশলে বা পদ্ধতিতে রচিত বিবৃতি বা বিবরণী। অনেকের মতে, তথ্যগত ও সত্যনিষ্ঠ বিবরণীকেই প্রতিবেদন বলা হয়। অর্থাৎ কোনাে তথ্য, ঘটনা বা বক্তব্য সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ বর্ণনা দান করাই হলাে প্রতিবেদন। অধ্যাপক মাইক হ্যাচ-এর মতে, প্রতিবেদন হলাে একটি সুসংগঠিত তথ্যগত বিবৃতি, যা কোনাে বক্তব্য সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত অথচ সঠিক বর্ণনা বিশেষ। একে যথেষ্ট সতর্কতা, পর্যবেক্ষণ, পর্যালােচনা, গবেষণা ও বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে তৈরি করা হয়।

প্রতিবেদন রচয়িতার ভূমিকা 

প্রতিবেদন যিনি তৈরি বা রচনা করেন তাকে বলা হয় প্রতিবেদক বা রিপাের্টার । একজন প্রতিবেদন রচয়িতার দায়িত্ব হলাে কোনাে বিষয়ে তথ্য, উপাত্ত, সিদ্ধান্ত, ফলাফল ইত্যাদি অনুসন্ধানের পর বিবরণী তৈরি করে কোনাে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা কোনাে কর্তৃপক্ষের বিবেচনার জন্য পেশ করা। সংবাদপত্রে প্রতিদিন এ ধরনের অসংখ্য প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। একজন প্রতিবেদক বা রিপাের্টার সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনে নানা ধরনের ঘটনার বিবরণ তুলে ধরেন। এ ধরনের প্রতিবেদনে তাঁর ব্যক্তিগত চিন্তাধারা কিংবা কোনাে মন্তব্য বা সুপারিশ উপস্থাপনের কোনাে সুযােগ নেই। আবার, অন্যান্য প্রতিবেদনে কখনাে কখনাে প্রতিবেদকের মন্তব্য বা সুপারিশ বা নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা স্থান পায় বলে অনেকেই সংবাদপত্রের প্রতিবেদনকে অন্যান্য প্রতিবেদন থেকে আলাদা বলে মনে করেন। কিন্তু এ ধারণা সঠিক নয়। সংবাদপত্রের মুখ্য উদ্দেশ্যই হলাে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করা। সাধারণ পাঠক সংবাদপত্রে যেকোনাে প্রতিবেদন পাঠের পর তার সে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বা মন্তব্য বা সুপারিশ কিংবা সেই একই প্রতিবেদনের ওপর প্রশাসনিক যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বা সিদ্ধান্ত তা পুনরায় প্রতিবেদককে সংবাদপত্রে প্রকাশ করতে হয় বা তিনি প্রকাশ করে থাকেন। এখানে তার ব্যক্তিগত মতামত বা সুপারিশের কোনাে গুরুত্ব নেই। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন পাঠ করে যেকোনাে পাঠকই তার দৃষ্টিভঙ্গির আলােকে যেকোনাে মন্তব্য করতে পারেন। তবে কোনাে ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তাদের নেই, যদি প্রশাসন এ ব্যাপারে। কোনাে ব্যবস্থা না নেন। অপরদিকে প্রশাসনিক, ব্যবসায়িক, আইন-আদালত ও অন্যান্য ক্ষেত্রে যে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়, সেই প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্তে উপনীত হন বলে এসব প্রতিবেদনে প্রতিবেদক সে বিষয় সম্পর্কে কিছু সুপারিশ বা মন্তব্য বা মতামত দিয়ে থাকেন। কর্তৃপক্ষও প্রতিবেদকের প্রদত্ত মতামতকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করেন। ভাষাবিদ নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তার বাংলায় কী লিখবেন, কেন লিখবেন’ গ্রন্থে বলেছেন, সংবাদের ওপর মন্তব্য করার জন্য সম্পাদকীয় নিবন্ধকারেরা আছেন, ভাষ্যকারেরা আছেন, তাছাড়া আছেন নিয়মিত কলামের লেখকরা। এ কাজ প্রতিবেদক বা রিপাের্টারের নয়। প্রতিবেদন, রিপাের্ট মন্তব্যবর্জিত হবে।

 

প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য 

প্রতিবেদন রচনার অনেকগুলাে সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য রয়েছে। উদ্দেশ্যগুলাে নিয়ে উপস্থাপন করা হলাে

১. সুনির্দিষ্ট কোনাে বিষয় সম্পর্কে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা। 

২. যে বিষয়ে প্রতিবেদন রচিত হবে সে বিষয়ে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা।

৩. যেকোনাে জটিল বিষয়ের সহজ ও সুন্দর ব্যাখ্যা প্রদান করা।

৪. যেকোনাে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপন করে উক্ত বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করা। 

৫. যে বিষয়ে প্রতিবেদন রচিত হবে সে বিষয় সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের মতামত গ্রহণ করা। 

৬. গুরুত্বপূর্ণ ও আলােচিত নানা বিষয় নিয়ে প্রতিবেদন রচনা করার মাধ্যমে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা। 

৭. প্রশাসনকে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা প্রদান করা। 

প্রতিবেদনের বৈশিষ্ট্য 

একটি আদর্শ প্রতিবেদনে যেসব বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকে সেগুলাে নিমরূপ

১. প্রতিবেদন নির্দিষ্ট কাঠামাে ও নিয়মানুযায়ী প্রণয়ন করতে হবে। 

২. কোনাে নির্দিষ্ট ঘটনা বা বিষয় অবলম্বনে প্রতিবেদনটি বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যনির্ভর হতে হবে ।

৩. প্রতিবেদনের বক্তব্য হবে সহজ-সরল, নিরপেক্ষ, যুক্তিযুক্ত ও বাহুল্যবর্জিত। প্রতিবেদকের কাছে বিশেষভাবে প্রত্যাশিত যে, তাঁর। | সংবাদে পারতপক্ষে এমন কোনাে বিশেষণ ব্যবহার করা উচিত হবে না, যার ফলে তাঁর রচনাকে পক্ষপাতদুষ্ট মনে হয়। 

৪. জটিল বিষয়ে সরল ব্যাখ্যা দান করাই সংগত। 

৫. বাক্যে যতি বা ছেদ চিহ্নের ব্যবহার যথাযথ হতে হবে। 

৬. প্রতিবেদনের শিরােনামে উদ্ধৃতি চিহ্ন ব্যবহার করা সংগত নয় । 

৭. সংবাদের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলােই অর্থাৎ খবর হিসেবে যা গুরুত্বপূর্ণ তাই প্রতিবেদনে স্থান পাবে। বক্তা কিংবা প্রতিষ্ঠানের। | খ্যাতিতে বিভ্রান্ত না হয়ে বস্তু, ব্যক্তি, স্থান ও কাল সতর্কভাবে বিচার করে প্রতিবেদককে আসল বা সত্য বিষয়টি প্রতিবেদনে তুলে ধরতে হবে। 

৮. প্রতিবেদনে ব্যবহৃত বাক্য যেন জটিল না হয়, সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। প্রতিবেদনের বাক্য জটিল হলে ভাষা দুর্বোধ্য হয়ে পড়বে। যে ভাষা দুর্বোধ্য হয়, তা অধিকাংশ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায় না। তাই ভাষা কঠিন হলে প্রতিবেদন সংবাদপত্রে প্রকাশের অনুপযােগী হয়ে পড়ে, যা একজন প্রতিবেদকের কাম্য নয়। তাই প্রতিবেদনের ভাষা হতে হবে সহজ─সরল, প্রাঞ্জল ও সকলের বােধগম্য। 

৯. প্রতিবেদনে প্রতিবেদকের অতিরিক্ত বেগ বা উচ্ছ্বাস প্রকাশের কোনাে সুযােগ নেই। তবে নিরেট আবেগহীন ভাষা ব্যবহার করলেও যেকোনাে রচনা তার স্বাভাবিকতা হারায়। তাই প্রতিবেদককে প্রতিবেদন রচনার সময় তার আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। তবে ভাষার মাধুর্য যেন বজায় থাকে সে বিষয়টিও বিবেচনায় রাখা জরুরি। তবেই প্রতিবেদন রচনা সার্থক হবে। 

১০. সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে সুপারিশ কোনােভাবেই গ্রহণযােগ্য নয়। এছাড়া অন্যান্য প্রতিবেদনে যেকোনাে সমস্যা সম্পর্কে সুপারিশ বা মতামত প্রদান করা যেতে পারে। 

১১. প্রতিবেদনের বিষয়বস্তুকে কয়েকটি অনুচ্ছেদে ভাগ করে আলােচনা করা যেতে পারে। অনুচ্ছেদগুলােতে বর্ণিত হবে ভিন্ন ভিন্ন ঘটনার বিবরণ এবং বস্তুনিষ্ঠ, তথ্যনির্ভর ও অনুসন্ধানমূলক বিবরণী । তবে প্রতিটি অনুচ্ছেদ যেন প্রাসঙ্গিক বাক্য দিয়ে শুরু হয় সে বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। 

১২. প্রতিবেদনে সুনির্দিষ্ট তথ্যসূত্র বা উৎস নির্দেশ করতে হবে। প্রতিবেদন লেখার সময় বলাবাহুল্য’, ‘পরিশেষে বলতে হয়, প্রসঙ্গত বলা যায় ইত্যাদি শব্দ বর্জন করা উচিত। 

১৩. প্রতিবেদনের পূর্বের বক্তব্য এবং পরের বক্তব্যের মধ্যে যেন সংগতি থাকে সে বিষয়েও প্রতিবেদককে সচেতন থাকতে হবে। অন্যথায় প্রতিবেদন রচনার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হতে বাধ্য। 

Rate this post