প্রশ্নঃ সত্তা দর্শন বলতে কী বুঝ? সত্তা সম্পৰ্কীয় মতবাদগুলাে সংক্ষেপে আলােচনা কর।

অথবা, সত্তা বিষয়ক মতবাদ হিসাবে একাত্মবাদ, দ্বৈতবাদ ও বহুত্ববাদ ব্যাখ্যা কর।

ভূমিকাঃ জগত ও জীবনের সাথে জড়িত মৌলিক সমস্যাগুলাের যৌক্তিক অনুসন্ধানই হলাে দর্শন। এ মৌলিক সমস্যাগুলাের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলাে সত্তা বিষয়ক সমস্যা। সত্তার স্বরূপ ও সংখ্যা নিয়ে দার্শনিকদের মধ্যে মতভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। জগতের উৎপত্তির পেছনে কয়টি মূল উপাদান বিদ্যমান ছিল। এই মূল উপাদানের স্বরূপই বা কি- এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে দর্শনে একত্ববাদ, দ্বৈতবাদ এবং বহুত্ববাদের মতাে সত্তা বিষয়ক মতবাদের উদ্ভব ঘটেছে।

একত্ববাদ / অদ্বৈতবাদঃ একত্ববাদ হচ্ছে সত্তা সম্পর্কিত এমন একটি মতবাদ, যে মতবাদ মনে করে জড়ত সৃষ্টির পেছনে একটিমাত্র আদি সত্তা রয়েছে। বিশ্বের যাবতীয় বস্তুই একটিমাত্র আদিবস্তু থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। এ বৈচিত্র্যময় জগত ঐ আদি বা পরমসত্তারই অবসিক। বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্যের সন্ধান করাই একত্ববাদের মূল উদ্দেশ্য। এই একক সত্তার স্বরূপ নির্ণয় করাই দর্শনের কাজ। একত্ববাদকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা: ১। আধ্যাত্মিক একত্ববাদ ২। জড় একত্ববাদ।

(১) আধ্যাত্মিক একত্ববাদঃ আধ্যাত্মিক একত্ববাদ অনুসারে সত্তা হলাে আধ্যাত্মিক। এ মতবাদ জড়ের অস্তিত্ব স্বীকার করে না। এ মতবাদ অনুসারে সমগ্র বিশ্বজগত এক পরমসত্তার ওপর নির্ভরশীল। এ পরমসত্তা মূর্তও হতে পারে আবার বিমূর্তও হতে পারে। উল্লেখ্য এই মূর্ততার ওপর ভিত্তি করে পরমসত্তাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:

(ক) অমূর্ত বা বিমূর্ত একাত্ববাদঃ পাশ্চাত্য দার্শনিক স্পিনােজা, ভারতীয় দার্শনিক সংকর প্রমুখ বিমূর্ত একত্ববাদ প্রচার করেন। স্পিনােজার মতে, কেবল এক পরমসত্তা সত্য, জগত মিথ্যা। স্পিনােজা আরাে বলেন, ঈশ্বর অমূর্ত অবস্থায় নিজেকে প্রকাশ করেন। আর তাই ঈশ্বরকে কেবল ধারণার মাধ্যমে জানা সম্ভব। স্পিনােজা ঈশ্বরকে দ্রব্য বলে অভিহিত করেছেন। তার মতে, ঈশ্বরের বাইরে স্বতন্ত্র কোনাে কিছুর অস্তিত্ব নেই। জীব ও ব্রহ্ম অভিন্ন। ব্রহ্ম মায়া থেকে এই জগত সৃষ্টি করেছেন এবং মায়াতেই এর বিলুপ্তি ঘটবে।

(খ) মূর্ত একত্ববাদ মূর্তঃ একত্ববাদ অনুসারে এ বিশ্বজগত পরমসত্তায় প্রকাশ। এ সত্তা বহুর মাঝে নিজেকে প্রকাশ ও উপলব্ধি করে। সুতরাং এ জগত অলীক নয়। এ জগতেরও অস্তিত্ব আছে। জগত ও পরমসত্তা একটি ছাড়া আরেকটি অর্থহীন। দার্শনিক হেগেল, কোয়ার্ড, রয়েস, প্রাচীন ভারতীয় দার্শনিক রামানুজ এ মতবাদের অন্যতম সমর্থক। হেগেলের মতে, পরমসত্তা এক হয়েও নিজেকে অসংখ্য বৈচিত্র্যের মধ্যেদিয়ে প্রকাশ করেন। জগতের সব বস্তুই ঈশ্বরের অংশ। তিনি জগতের ভেতরেও আছেন এবং বাইরেও আছেন।

(১) জড় একত্ববাদঃ জড়বাদ একত্ববাদ অনুসারে বিশ্বের আদি উপাদান হলাে জড়। চিন্তন হলাে জড়ের গুণ প্রাণ হলাে জড়ের জটিলতম রূপ। জড়বাদ একত্ববাদের সমর্থকেরা কখনাে পানি, কখনাে অগ্নি, কখনাে বায়ু, কখনাে বা পরমাণুকে জগতের আদি উপাদান বলে মনে করেন।

দ্বৈতবাদঃ দ্বৈতবাদ হচ্ছে সত্তা বিষয়ক এমন একটি মতবাদ যেটি মনে করে বিশ্বজগতের মূল উপাদান দু’টি তবে এই মূল উপাদানের স্বরূপ ভিন্ন ভিন্ন দার্শনিকের কাছে ভিন্ন ভিন্ন মনে হলেও অধিকাংশ দার্শনিক এই দুটি উপাদান বলতে দেহ বা জড় এবং মন বা চেতনাকে বুঝিয়েছেন। প্রাচীন, মধ্য এবং আধুনিক এই তিন যুগেই দ্বৈতবাদের প্রসার লক্ষ্য করা যায়। প্রাচীন গ্রীক দর্শনে এ্যানাক্সাগােরাস জড় ও মানবসত্তা, প্লেটো ইন্দ্রিয়জগত এবং ধারণার জগত, এরিস্টটল, আকার এবং উপাদানের কথা বলে তাদের দ্বৈতবাদ মত প্রচার করেন। প্রাচীন ভারতীয় অসংখ্য দর্শনে পুরুষ ও প্রকৃতি অথবা দুটি সত্তাকে স্বীকার করা হয়। এভাবে দ্বৈতবাদের উদ্ভব ঘটেছিল। মধ্যযুগে দার্শনিকসেন্ট অগাস্টিন তার দর্শনে দেহ ও মন বা আত্মা বিষয়ক দ্বৈতবাদ প্রচার করেন। ডেকার্টের দর্শনে দ্বৈতবাদের আধুনিক রূপটি পরিলক্ষিত হয়। তিনি দেহ ও মনকে পৃর্থক দুটি স্বতন্ত্র সত্তা বলে দ্বৈতবাদের সূচনা করেন।

বহুত্ববাদঃ বহুত্ববাদের মূল কথা হলাে সত্তা এক নয়, দুইও নয় বরং বহু। এই পরিদৃশ্যমান জগতের পেছনে সত্তার সংখ্যা অনেক। এই পরিদৃশ্যমান জগত হচ্ছে বৈচিত্র্যপূর্ণ। বিশ্বের এ বৈচিত্র্যকে কেবল একটি বা দুটি সত্তার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। এজন্য স্বাভাবিকভাবেই অগণিত সত্তার অস্তিত্ব স্বীকার করতে হয়। বহুত্ববাদের সাধারণত চারটিরূপ পরিলক্ষিত হয়। যথাঃ

(১) জড়াত্মক বহুত্ববাদ বা পরমাণুবাদঃ পরমাণুবাদ অনুসারে জড়বস্তুকে ক্রমাগত ভাগ করতে থাকলে আমরা একসময় এমন এক ক্ষুদ্রকণিকায় এসে উপস্থিত হই, যাকে আর ভাগ করা যায় না। এ ক্ষুদ্রতম অবিভাজ্য কণিকাগুলাে হলাে পরমাণু। এই দৃশ্যমান জগত ও জগতের যাবতীয় কিছু এই ধরনের অসংখ্য পরমাণুর সমন্বয়ে গঠিত। গ্রীক দার্শনিক ডেকোক্রিটাস পরমাণুবাদের সূচনা করেন। আধুনিকযুগে বিজ্ঞানী ডাল্টন তা সমর্থন করেন।

(২) আধ্যাত্মিক বহুবাদ বা মােনাভবাদঃ জার্মান দার্শনিক লাইবনিজ এই মতবাদের সমর্থক। তিনি জগতের মলসত্তা হিসেবে অসংখ্য চিৎপরমাণুর কথা বলেন। এই চিৎপরমাণুগুলাে অবিভাজ্য, আধ্যাত্মিক, সক্রিয়, আত্মকেন্দ্রিক, স্বনির্ভর চেতনাসম্পন্ন এবংগবাক্ষহীন। লাইবনিজের মতে, ঈশ্বর হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ চিৎপরমাণু এবং তিনিই এই চিৎপরমাণুগুলােকে সৃষ্টি করেছেন। আর তিনিই গবাক্ষহীন চিৎপরমাণুগুলাের মধ্যে একটা পূর্বপ্রতিষ্ঠিত শৃংখলা স্থাপন করেছেন।

(৩) প্রয়ােগবাদী বহুত্ববাদঃ উইলিয়াম জেমস এ মতবাদের সমর্থক। তার মতে, বৈচিত্র্য, নতুনত্ব এ জগতের মূল বৈশিষ্ট্য। এ বিশ্বজগত এক আঙ্গিক ঐক্য এবং পরমসত্তার বহিঃপ্রকাশ নয়। বরং এ বিশ্বজগত বহু বিচ্ছিন্ন সত্তার সমষ্টি। বিচ্ছিন্নতা এবং বৈচিত্র্যই এ বিশ্বজগতের আসলরূপ। উইলিয়াম জেমস আরাে বলেন, এ জগত এক নয় বরং বহু। নিত্যনতুন বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি এ জগতের অসংখ্য সত্তার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

(৪) নব্যবাস্তববাদী বহুত্ববাদঃ নব্য বাস্তববাদীদের মতে, এ বিশ্বজগতে কোনাে আত্মিক ঐক্য নেই এবং বহুই সত্য। তাদের মতে, জড়, প্রাণ ও মন হলাে বিভিন্ন স্তরের সত্তা। কতিপয় নব্য বাস্তববাদী বিশ্বজগতের মূল সত্তা হিসেবে কতকগুলাে নিরপেক্ষ পদার্থের কথা বলেন। যারা এক প্রেক্ষিতে ভৌতিক এবং অন্য প্রেক্ষিতে মানসিক বলে প্রতীয়মান হয়।

সমালােচনাঃ বহুত্ববাদ বিভিন্নভাবে সামালােচিত হয়। যেমনঃ

প্রথমতঃ একত্ববাদ একটিমাত্র সত্তার মাধ্যমে জাগতিক বহুত্ব ও বৈচিত্র্যকে ব্যাখ্যা করতে অসমর্থ।এটি জগৎ ও জাগতিক বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করে বিশ্বজগত্রে প্রকৃত রূপকে অস্বীকার করেছে, যা গ্রহণযােগ্য নয়।

দ্বিতীয়তঃ দ্বৈতবাদ জগতের ব্যাখ্যায় পরস্পর স্বতন্ত্র ও বিপরিতধর্মী সত্তার কথা বলেছেন। কিন্তু বিপরীত ধর্ম দু’টি সত্তা কীভাবে বিশ্বজগতকে পরিচালনা করছে তার কোনাে ব্যাখ্যা দ্বৈতবাদে নেই।

তৃতীয়তঃ বহুত্ববাদ জগতের মূলে বহু বা অসংখ্য সত্তার স্বীকার করে জগতকে বিশৃংখলার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। তা ছাড়া অসংখ্য সত্তা কিভাবে এ সৃঙ্খল জগতের সৃষ্টি ও পরিচালনা করছে তার কোনাে গ্রহণযােগ্য ব্যাখ্যা বহুত্ববাদে নেই।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, সত্তা বিষয়ক মতবাদ হিসেবে একত্ববাদ ও দ্বৈতবাদ অন্যন্য গুরুত্বপূর্ণ দুটি মতবাদ। বিশ্বজগতের উৎপত্তির পেছনে সত্তা কয়টি বা সত্তার স্বরূপ কী তা নির্ধারণ করাই মূলত একত্ববাদ, দ্বৈতবাদ ও বহুত্ববাদের কাজ। সত্তা বিষয়ক মতবাদের মধ্যে একত্ববাদ সবচেয়ে বেশি গ্রহণযােগ্য মতবাদ। কেননা বিশ্বজগতের অসংখ্য বৈচিত্র্যের ব্যাখ্যা দুটি কিংবা অসংখ্য দুর্বল উপাদানের মাধ্যমে দেয়ার চেয়ে এক মহাপরাক্রমশালী পরমসত্তার মাধ্যমে দেয়া যুক্তিসংগত।

Rate this post