সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘চরণ দাস এম.এল.এ.’ গল্পের মধ্যে জগৎগুরু সহস্রানন্দকে বলা যেতে পারে অপ্রত্যক্ষ চরিত্র। পাঠক কখনো তাঁকে চাক্ষুস করেননি। তাঁর মুখ নিসৃত কথা শোনেননি। এমনকি ঘটনা সংঘটনে বা জটিলতা সৃষ্টিতে কোনো ভাবেই অনুঘটকের কাজ করেননি। অথচ অন্যতম চরিত্রের প্রাধান্য পেয়ে গেছেন।
চরণদাসের চিন্তার সূত্র ধরে পাঠক জানতে পারেন যে, সহস্রানন্দ সিদ্ধ পুরুষ। সিদ্ধপুরুষের মতো অনেক বিভূতি তাঁর আছে। তিনি নির্লোভ, সদাচারী, বিভূতিবান। টাকা পয়সা নেন না, ছোঁন না। সকাল সন্ধে কীর্তন পাঠ নিয়ে থাকেন। সকালে সন্ধ্যায় ভক্তদের দেওয়া জিলিপি শিশুদের বিতরণ করেন প্রসাদরূপে। নিজে কিছু খান না। কেবল অম্বুরী তামাক সেবনের নেশা তাঁর আছে। গ্রামের প্রায় সকলেই তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছে। তাদেরকে তিনি মানুষের মূল্য বুঝিয়েছেন। যারা নিজেদের হীন বিবেচনা করতো, তারাও বুঝতে পেরেছে তাদেরও যথেষ্ট গুরুত্ব আছে— রামচন্দ্রের সেতু নির্মাণে কাঠবেড়ালীর ভূমিকা কম ছিল না। চরণদাস চিন্তাসূত্র ধরেই পাঠকরা জানতে পেরেছেন যে, স্বামী সহস্রানন্দ সামান্য মানুষ নন। তিনি চথুরির মতো অবোলাদের মুখে বুলি ফোটাতে সক্ষম। তিনি মানুষকে মানুষের পরিচয় দিতে সচেষ্ট। উপযুক্ত গুরু পেলে দস্যু রত্নাকরও যে মহর্ষি বাল্মীকি হয়ে উঠতে পারেন সেই দৃষ্টান্ত তাঁর ভক্তদের মধ্যে তুলে ধরে তাদের সম্মানিত করার চেষ্টা করেছেন।
এই সহস্রানন্দ সিদ্ধপুরুষ এবং সংসারের প্রতি মোহমুক্ত হলেও তাঁর প্রভাবে রাজনৈতিক নেতা ও দলের বেশ সংকট দেখা দিয়েছে। সহস্রানন্দের পূজার ফুলমালার আয়োজন করার জন্যে গ্রামবাসীরা নিবেদিত প্রাণ হবার জন্যে সেখানে কোনো রাজনৈতিক নেতা এলে তাঁর মালার জন্যে ফুল পাওয়া যায় না। এ ছাড়াও চরণদাস নিজেই লক্ষ করেছেন, তাঁকে গ্রামবাসীরা কেউ গ্রাহাই করতে চায়নি। এমনকি জগৎগুরুর আশ্রমে গিয়েও দেখেছেন তাঁর দিকে তাকানোর কোনো প্রয়োজনই গ্রামবাসীরা কেউ অনুভব করেনি।
কিন্তু এতটা বলার পরেও এই চরিত্রটি নির্মাণের সময় সতীনাথ কিছুটা ধোঁয়াশা রেখে গেছেন। তিনি বলেছেন স্বামী সহস্রানন্দ সিদ্ধপুরুষ। সিদ্ধপুরুষের অনেক লক্ষণ তাঁর মধ্যে বিদ্যমান। কিন্তু পাশাপাশি লেখক বলেছেন, আশ্রমে গুরুদেবের ঘর থেকে অম্বুরী তামাকের ধোঁয়া বার হয়। সেই ধোঁয়ার ঘ্রাণ ভক্তশিষ্যরা প্রাণ ভরে নেয়। কিন্তু ঘরের দরজা প্রায় সময়ই থাকে বন্ধ। সেখানে যজ্ঞ হয়। কিন্তু তার ধোঁয়ায় অম্বুরী তামাকের গন্ধ কেন? আবার চরণদাস লখনলাল, বচ্কন মাহাতোরা যখন পরামর্শ করছিলেন তখন গুরুদেবের বন্ধ দরজা একটু ফাঁক হয়েছিল। এই সব দৃষ্টান্ত তুলে ধরে তিনি যে কী বোঝাতে চেয়েছেন তা পরিষ্কার হয়নি। লেখক যদি চরিত্রটিতে সবিশেষ গুরুত্ব না দিতেন গল্পটি ঠিক মতো দাঁড়াতো না। অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ এই চরিত্রটির প্রতি লেখকের এই কি ঔদাসীন্য না মনন সংকট তা স্পষ্ট করে বুঝতে পারা যায় না। মনে হয় লেখক নিজেই কিছুটা সমস্যায় পড়েছিলেন চরিত্রটিকে নিয়ে। সাধু মহাত্মাদের অসাধুতার কাহিনি নিয়েই সাহিত্য কর্ম বেশি দেখতে পাওয়া যায়। সেখানে রাজনৈতিক বাতাবরণের ক্ষেত্রে স্বামী সহস্রানন্দকে তিনি কিভাবে রূপায়িত করবেন সেই নিয়ে বোধহয় নিজেই কিছুটা ধন্দে পড়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে সাহিত্য সমালোচক বসুমিত্র মজুমদারের মন্তব্যটি প্রণিধান যোগ্য। তিনি বলেছেন, “এই পর্যায়ে মনে হয় লেখক নিজেই কিছুটা ধন্দে পড়েছিলেন স্বামী সহস্ৰানন্দকে নিয়ে। মানুষের মূল্য যিনি বোঝেন, মানুষকে যিনি সম্মান করতে পারেন তাঁকে অসম্মান করার কোনো উপায় নেই – সম্ভবত এই কথা বোঝানোর জন্যেই গল্পকার জগৎগুরু সহস্রানন্দের কৌতূহলী চিত্তের চিত্র তুলে ধরলেও তাঁর অসাধু কিম্বা অসংযত কোনো সংবাদ গল্পের মধ্যে পরিবেশন করেননি।”