প্রশ্নঃ তত্ত্ববিদ্যা বা সত্তাদৰ্শন বলতে কী বুঝায়? এ সম্পর্কীয় মতবাদ হিসাবে জড়বাদ ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন কর।
অথবা, সত্তা বিষয়ক মতবাদ হিসাবে জড়বাদ ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন।
ভূমিকাঃ তত্ত্ববিদ্যা বা সত্তাসম্পর্কিত দর্শন দর্শনের এমন একটি শাখা যেখানে জগতের মূল উপাদান বা সত্তার স্বরূপ ও ব্যাখ্যা সম্পর্কিয় বিষয়ের আলােচনা হয়ে থাকে। এ দৃশ্যমান জগতের সংগঠনের আড়ালে যে মূল উপাদান সত্তা আছে তার মূল স্বরূপ জড় না মন বা আধ্যাত্মিক শক্তি এ নিয়ে দর্শনের জড়বাদ বা বস্তুবাদ ও ভাববাদ বা আধ্যাত্মবাদের উদ্ভব হয়েছে। আবার এ দৃশ্যমান জগতের সংগঠনের যে মূল উপাদান বা সত্তা রয়েছে তা এক না দুই না দুয়ের আধক এ নিয়ে দর্শনে অদ্বৈত্ববাদ ও দ্বৈতবাদ বা বহুত্ববাদের উদ্ভব হয়েছে।
সত্তা দর্শনঃ বিশ্বজগতের প্রকৃত সত্তা সম্পর্কিত আলােচনাকেই সাধারণত সত্তাদৰ্শন বা তত্তবিদ্যা বলা হয়ে থাকে। Ontology শব্দটি গ্রীক শব্দ Ont এবং Logos থেকে উদ্ভূত হয়েছে। Ont শব্দের অর্থ সত্তা এবং Logos অর্থ বিজ্ঞান। তাই “Ontology” হলাে সত্তা সম্পর্কিত বিজ্ঞান। অতএব যে বিদ্যায় জগতের মূল উপাদান বা সত্তার স্বরূপ ও সংখ্যা নিয়ে আলােচনা করা হয় তাকে সত্তা দর্শন বলে।
সাধারণভাবে দু’টি অর্থে সত্তা শব্দটি ব্যবহার হয়ে থাকে। প্রথমত, সত্তা বলতে বস্তুর মূল উপাদানকে বােঝানাে হয়। এদিক থেকে সত্তা বাস্তব সত্তাকে নির্দেশ করে। দ্বিতীয়ত, সত্তা শব্দটি পরমসত্তাকে বােঝায়। সুতরাং সত্তা হলাে,জগত ও জীবনের একক মৌলিক উপাদান, যা কেবল জড়শক্তি নয়, কিংবা মন ও মননও নয় বরং সেই জড় ও শক্তির উৎস ও পরিচালক, নিয়ন্ত্রক, স্বরূপ, সার্বভৌম ক্ষমতাধারী এমন এক বিদেশি পুরুষ যিনি এ বৈচিত্র্যময় পৃথিবী ও তার অগণিত জীবকুল সৃষ্টি করেছেন। অন্যভাবে বলা যায়, যে অদৃশ্য শক্তি নিজ অস্তিত্বের জন্য অপর কোনাে শক্তির ওপর নির্ভরশীল নয় তাকে সত্তা বা পরমাত্মা বলে। পিনােজা, প্রাডলি, প্রমুখ দার্শনিকের মতে, সত্তা বা পরমাত্মা হলাে আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতার চরম আধার যেখানে কোনােরকম বিরােধের স্থান নেই। সত্তা বা পরমসত্তার সংখ্যা নিয়ে দার্শনিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন দুই আবার কেউ বলেছেন বহু; তাই সত্তার সংখ্যার দিক থেকে তিনটি মতবাদের সৃষ্টি হয়েছে যেমন: ১। একত্ববাদ বা অদ্বৈতবাদ ২। দ্বৈতবাদ ৩। বহুত্ববাদ।
জড়বাদ বা বস্তুবাদঃ সত্তা সম্পর্কিয় মতবাদ হিসেবে জড়বাদ বা বস্তুবাদ হচ্ছে এমন এক তত্ত্ববিদ্যা মতবাদ যা জড়কে বিশ্বজগতের আদি সত্তা বলে মনে করে। এ বিশ্বের সর্বকিছুই জড় থেকে উদ্ভূত। প্রাণ এবং মনের উৎপত্তিও জড় থেকে। জড় বিস্তৃতি ও অভেদ্যতা এ দুই গুণ সম্পন্ন, গতি হচ্ছে জড়ের ধর্ম। বিশ্বজগতের যাবতীয় বস্তু জড় বা পরমাণুর আকর্ষণ ও বিকর্ষণের ফলে সৃষ্টি হয় এবং বিশ্বজগত কতকগুলাে যান্ত্রিক বা প্রাকৃতিক নিয়মের অধীন। মন বা আত্মা বলে কোনাে আদি সত্তা নেই। বরং মন ও প্রাণ জড় থেকেই উদ্ভূত। মন ও প্রাণ জড়ের জটিলতর রূপমাত্র। জড়বাদ যান্ত্রিক বিবর্তনবাদে বিশ্বাসী এবং যন্ত্রবাদের মুখপাত্র। হনলি জড়বাদের স্বরূপ সম্পর্কে বলেন, জড়বাদ সমগ্র প্রকৃতি বা প্রকৃতির জীবন্ত অংশকে ঈশ্বরের সৃষ্টি বলে মনে করে না।
জড়বাদের পটভূমিঃ জড়বাদের ইতিহাস বা পটভূমি অত্যন্ত ব্যাপক ও দীর্ঘ। পাশ্চাত্য দর্শনের জনক থেলিসের মতবাদে প্রথম জড়বাদের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। পরবর্তীতে অ্যানাক্সিমেণ্ডার, অ্যানাক্সিমেনিস, হিরাক্লিটাস, এমিড ক্লিস, অ্যানাক্সাগােরাস প্রমুখ দার্শনিকদের দর্শনে জড়বাদের আলােচনা পরিলক্ষিত হয়। এরপর প্লেটো ও এরিস্টটলের কাছে যদিও জড়বাদ কিছু বাধা পেয়েছিল, তথাপি পরবর্তিতে এপিকিউরান, স্টোয়িক ও লিউক্রেটিয়াস-এর হাতে পড়ে জড়বাদের আলােচনা আবার দেখা যায়। ভারতীয় দর্শনে চার্বাক, বৌদ্ধ, জৈনদর্শনে জড়বাদের আলােচনা পরিলক্ষিত হয়। মধ্যযুগীয় দর্শনে ধর্মের প্রভাব বেশি ছিল বলে জড়বাদের আলােচনা পরিলক্ষিত হয় হয়। কিন্তু আধুনিক যুগে থমাস, হবস, ডিভারােট, লামেট্রি, হল, ব্যাক, জনউল্যাণ্ড, কার্টােগট, অ্যার্নস্টহেইকেল প্রমুখ চিন্তাবিদেরাও জড়বাদ সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনা করেন।
জড়বাদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যঃ জড়বাদ সম্পর্কে আলােচনা করতে গিয়ে কিছু বৈশিষ্ট্যের সন্ধান পাওয়া যায়। যেমনঃ
(১) যান্ত্রিক নিয়ন্ত্রাধীনঃ জড়বাদ অনুযায়ী এ জগতের যাবতীয় বস্তুই জড়ের আকর্ষণ ও বিকর্ষণের ফলেই উদ্ভূত হয়। জড়বাদের মূল কথা হলাে- এ জগতের যাবতীয় বস্তুরই মূল উপাদান পরমাণু ও তার গতি। এ জাগতিক বস্তু সৃষ্টি করতে জগতকে কতকগুলাে যান্ত্রিক নিয়মের নিয়ন্ত্রাধীন থাকতে হয়।
(২) ভাববাদ বিরােধীঃ জড়বাদে কোনাে অলৌকিক বা আধ্যাত্মিক শক্তির স্থান নেই। প্রাকৃতিক বা যান্ত্রিক নিয়মে এ জগতের ঘটনাবলি ব্যাখ্যা করাই জড়বাদের প্রধান ধর্ম। এদিক থেকে জড়বাদ ভাববাদের একটি সম্পূর্ণ বিরােধী মতবাদ।
(৩) প্রত্যক্ষণনির্ভর জ্ঞানঃ জড়বাদ অনুযায়ী প্রত্যক্ষণই জ্ঞান লাভের একমাত্র পথ। এ মতবাদ অনুযায়ী যা প্রত্যক্ষের বিষয় নয়, তার অস্তিত্ব স্বীকার করা যায় না। যেহেতু জড়কে আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারি, সেহেতু জড়ের অস্তিত্ব অবশ্যই আছে।
(৪) যান্ত্রিক বিবর্তনবাদে বিশ্বাসীঃ যান্ত্রিক বিবর্তনবাদ অনুযায়ী জগত কতকগুলাে যন্ত্রের নিয়মের নিয়ন্ত্রাধীন। এজন্য জাগতিক পরিবর্তনের মূলে রয়েছে কতকগুলাে যান্ত্রিক শক্তির কাজ। যান্ত্রিক কার্যকারণ সম্পর্ক হচ্ছে জড়বাদের আসল বৈশিষ্ট্য। সুতরাং বলা যায় জড়বাদ যান্ত্রিক বিবর্তনবাদে বিশ্বাসী।
(৫) ইহার স্বাধীনতা অস্বীকারঃ জড়বাদ জড়কে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে ধর্মনীতি, পরমমূল্য, ইচ্ছার স্বাধীনতা প্রভৃতির স্বাধীনতা নেই। কেননা পূর্ববর্তী বা অতীত ঘটনাই ব্যক্তির কার্যকে পরিচালিত করে।
সমালােচনাঃ সত্তা সম্পর্কিয় মতবাদের কিছু সমালােচনা রয়েছে যা নিম্নরূপ-
প্রথমতঃ জড়বাদ জগতের সবকিছুকে পরমাণু ও গতির মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেছে। এ মতকে মেনে নিয়ে বলতে হয় যে, জগতের সব ঐক্য, শৃংখলা, সামঞ্জস্য কেবল পরমাণু ও তার গতির আকস্মিক সংযােগের ফলেই ঘটে থাকে। কিন্তু এ মতবাদ অনুসারে কোনাে বস্তুকে আকষ্মিক সংযােগের ফল বলা হলে তার কোনাে সন্তোষজনক ব্যাখ্যা পাওয়া সম্ভব নয়।
দ্বিতীয়তঃ জড়বাদের মতে, প্রত্যক্ষণ জ্ঞান লাভের একমাত্র উপায় কিন্তু শুধু প্রত্যক্ষণই জ্ঞান লাভের একমাত্র উপায় হতে পারে না বরং জ্ঞান লাভের জন্য প্রত্যক্ষণ ছাড়াও অন্যান্য উপায় রয়েছে।
তৃতীয়তঃ জড়বাদের যান্ত্রিক বিবর্তনবাদ গ্রহণযােগ্য নয়। জগতের সবকিছুই যান্ত্রিক নিয়মে চলতে পারে না। কিন্তু জড়বাদীরা সে কথা বেমালুম ভুলেই গেছেন।
চতুর্থতঃ জড়বাদের মতে, জড়, প্রাণ ও মনের মধ্যে কোনাে মৌলিক পার্থক্য নেই। প্রাণ জড় থেকে উদ্ভূত হয় এবং মন জড়েরই উপবস্তু বা উপঘটনা। কিন্তু এ ধারণা একেবারেই ভ্রান্ত। কেননা প্রাণ ও জড় এক ও অভিন্ন হতে পারে না।
পঞ্চমতঃ জড়বাদ নীতি, ধর্ম, পরম মূল্য, ঈশ্বরের ধারণা প্রভৃতিকে অলীক বা মিথ্যা বলে প্রমাণিত করেছে। কিন্তু নীতি ও ধর্মবোেধকে অস্বীকার করার অর্থ দাঁড়ায় মানুষের পরম আদর্শকে ধ্বংস করা।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, জড়বাদ বিশ্বজগতের মূল উপাদান বা সত্তা সম্পৰ্কীয় একটি সন্তোষজনক মতবাদ নয়। তারপরও দর্শনের ইতিহাসে জড়বাদকে অস্বীকার করা যায় না। কেননা জড়বাদ জগত সম্পর্কে যে মতবাদ প্রদান করেছে, হােক সেটা ঠিক বা বেঠিক তা নিঃসন্দেহে দার্শনিকদের আলােচনার ক্ষেত্রকে আরাে অনেকদূর পর্যন্ত প্রসারিত করেছে।