গণতন্ত্র বলতে জনগণের শাসনকে বোঝায়। কিন্তু জনগণের দ্বারা সরাসরি পরিচালিত শাসনব্যবস্থা বা প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার দি আর নেই। বর্তমান বৃহদায়তনবিশিষ্ট এবং জনবহুল রাষ্ট্রগুলিতে জনগণের প্রত্যক্ষ শাসন অসম্ভব। তাই বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে প্রতিনিধিত্বমূলক বা পরোক্ষ গণতন্ত্রের ব্যবস্থা করা হয়। আধুনিক গণতান্ত্রিক শাসন বলতে পরোক্ষ বা প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনকেই বোঝায়।

আধুনিক গণতন্ত্রে রাজনীতিক দল অপরিহার্য: প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থায় জনসাধারণ সরাসরি শাসনকার্য পরিচালনা করে না। জনগণ তাদের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করে। নির্দিষ্ট সময় অন্তর জনগণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে প্রতিনিধি নির্বাচন করে। জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিগণই শাসনকার্য পরিচালনা করে। তাই প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে নির্বাচন অত্যাবশ্যক। আর নির্বাচন বর্তমান কালের দলপ্রথার ভিত্তিতেই অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনীতিক দলগুলি নির্দিষ্ট কর্মসূচীর ভিত্তিতে তাদের মনোনীত প্রার্থীদের অনুকূলে জনসমর্থন লাভের জন্য প্রচারকার্য পরিচালনা করেন। যে দলের প্রার্থীগণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেন, সেই দলই সরকার গঠন করে। অর্থাৎ প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র বলতে বর্তমানে দলগত শাসনকেই বোঝায়। সেইজন্য আধুনিক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় রাজনীতিক দলের অস্তিত্ব অপরিহার্য।

জনমতকে রাজনীতিক দলগুলি সুস্পষ্ট ও সুগঠিত করে: গণতন্ত্র হল প্রকৃতপক্ষে জনমতের দ্বারা পরিচালিত শাসনব্যবস্থা। কোন বিশেষ শাসনব্যবস্থা কতখানি গণতান্ত্রিক তা নির্ধারণের মাপকাঠি হল সংশ্লিষ্ট শাসনব্যবস্থায় জনমতের প্রভাব কতখানি তা বিচার করা। অর্থাৎ আধুনিক গণতন্ত্রে জনমতের ভূমিকা ও গুরুত্ব অপরিসীম। এই জনমত গঠন ও প্রকাশের ক্ষেত্রে রাজনীতিক দলগুলি অত্যন্ত সক্রিয় ও কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করে। রাজনীতিক বিষয়ে সাধারণ মানুষের কোন স্পষ্ট ধারণা থাকে না। আর যদিও বা কোন বিষয়ে তাদের মোটামুটি ধারণা থাকে, সে বিষয়ে তারা তাদের মতামতকে যথাযথভাবে প্রকাশ করতে পারে না। অস্পষ্ট ও বিক্ষিপ্ত জনমতকে রাজনীতিক দলগুলিই সুস্পষ্ট ও সুগঠিত করে। রাজনীতিক দলগুলিই জনমতকে পরিশীলিত ও কার্যকরী করার ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে।

গণতন্ত্রে বিরোধী দল অপরিহার্য: দলপ্রথার ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সেই দলই শাসনকার্য পরিচালনা করে। নির্বাচনে যে দল সংখ্যালঘু হয়ে পড়ে, তা বিরোধী দল হিসাবে সরকারী কার্যকলাপের গঠনমূলক সমালোচনা করে। বিরোধী দলের সদাসতর্ক দৃষ্টি ও সমালোচনার জন্য সরকার খেয়ালখুশিমত আচরণ করতে পারে না। তাই স্বৈরাচারের উদ্ভব হয় না। সেজন্য গণতন্ত্রে বিরোধী দলের অস্তিত্ব অপরিহার্য বলে বিবেচিত হয়।

সংসদীয় গণতন্ত্রের স্বার্থে দলীয় শাসনব্যবস্থা দরকার: দলপ্রথা ছাড়া পার্লামেন্টারী শাসনব্যবস্থা সফল হতে পারে না। এরকম শাসনব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল মন্ত্রিসভা গঠন করে। সেজন্য মন্ত্রিসভার পিছনে পার্লামেন্টের অধিকাংশ সদস্যদের সমর্থন অটুট থাকে। এর ফলে সরকারী নীতি নির্ধারণ ও শাসনকার্য পরিচালনার ব্যাপারে দৃঢ়তার সঙ্গে অগ্রসর হতে পারে। এই কারণে বলা হয় যে সংসদীয় গণতন্ত্রের স্বার্থে দলীয় শাসনব্যবস্থা দরকার।

সুনাগরিক সৃষ্টিতে সাহায্য করে: গণতন্ত্রের সাফল্যের অন্যতম শর্ত হিসাবে সুনাগরিকের কথা বলা হয়। কিন্তু নির্লিপ্ততা, স্বার্থপরতা প্রভৃতি সুনাগরিকতার পথে বড় বাধা হিসাবে দেখা দেয়। রাজনীতিক দলগুলি সভাসমিতি, বক্তৃতা, আলাপ-আলোচনা, দলীয়-মিছিল, প্রচারকার্য প্রভৃতি রাজনীতিক ক্রিয়াকলাপের দ্বারা জনগণের রাজনীতিক জ্ঞানের বিস্তার ঘটায় এবং রাজনীতিকভাবে জনগণকে সচেতন করে তোলে। এইভাবে সাধারণ মানুষের নির্লিপ্ততা দূর হয় এবং দেশ ও দেশবাসীর ব্যাপারে দায়িত্ববোধের সৃষ্টি হয়। আবার এই পথেই মানুষ সমাজ-সচেতন হয় এবং সংকীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে পারে। রাজনীতিক দলগুলি এইভাবে সুনাগরিক সৃষ্টিতে সাহায্য করে এবং গণতন্ত্রের সাফল্যের পথকে সুগম করে। 

সরকারের গণতান্ত্রিক চরিত্র বজায় রাখে: গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য জনসাধারণের সক্রিয় সহযোগিতা আবশ্যক। সরকারের সঙ্গে জনসাধারণের যোগাযোগ না থাকলে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা সফল হতে পারে না। রাজনীতিক দলগুলি সরকারের সঙ্গে জনগণের যোগাযোগ রক্ষার গুরুদায়িত্ব পালন করে। বৃহদায়তন বিশিষ্ট রাষ্ট্রে দলীয় ব্যবস্থার এই ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ম্যাকাইভার-এর মতে বৃহদায়তন-বিশিষ্ট গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে দল-ব্যবস্থা অপরিহার্য অঙ্গস্বরূপ। তিনি বলেছেন: “Although party is often extra-constitutional, it is an essential organ of every large scale democracy.” জনগণ তাদের দাবি-দাওয়া ও অভাব-অভিযোগ সম্পর্কে রাজনীতিক দলের মাধ্যমে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সরকারও রাজনীতিক দলের মাধ্যমে জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছা জানতে পারে। এইভাবে দলীয় ব্যবস্থা সরকারের গণতান্ত্রিক স্বরূপ সংরক্ষণ করে।

উপসংহার: বস্তুতপক্ষে, গণতন্ত্রে রাজনীতিক দলের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। দলপ্রথার অস্তিত্ব ব্যতীত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার কথা চিন্তা করা যায় না। আর গণতান্ত্রিক শাসন বলতে বর্তমানে দলীয় শাসনকেই বোঝায়। গণতন্ত্রে দলব্যবস্থার অপরিহার্যতা দলব্যবস্থার গুণাবলীর মধ্যেই নিহিত আছে। বর্তমানে বিশ্বের প্রতিটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র দলপ্রথার গুরুত্ব উপলব্ধি করেছে এবং প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকার করেছে। বর্তমানে গণতন্ত্র ও দলপ্রথা ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কযুক্ত। দলপ্রথাকে বাদ দিয়ে গণতন্ত্রের কথা ভাবা যায় না। আধুনিক গণতন্ত্রে রাজনীতিক দলই প্রাণসঞ্চার করে। ফাইনার (Finer)- এর মতে, গণতন্ত্র তার আশা-নিরাশা সমেত দল-ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল। তিনি বলেছেন: “(Democracy) rests in its hopes and doubts upon the party system. There is political centre of gravity.”

Rate this post