রাষ্ট্রদর্শন, রাষ্ট্রচিন্তা এবং রাজনীতির জগতে বিশ্বের দুজন খ্যাতনামা মনীষী হলেন কার্ল মার্কস (১৮১৮-১৮৮৩ খ্রি.) এবং মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী (১৮৬৯-১৯৪৮ খ্রি.)। রাষ্ট্র সম্পর্কে কার্ল মার্কস এবং গান্ধীজীর চিন্তা দর্শনের মধ্যে পার্থক্য বিশ্লেষণের পূর্বে উভয় চিন্তাবিদের রাজনৈতিক চিন্তা ও মতাদর্শ সংক্ষেপে তুলে ধরা প্রয়ােজন।
রাষ্ট্র সম্পর্কে কার্ল মার্কসের বক্তব্য
কার্ল মার্কস ও তার অনুগামীরা ‘রাষ্ট্র’-কে শ্রেণিশাসন ও শ্রেণিশােষণের যন্ত্র হিসেবে মনে করতেন। আদি-অনন্তকাল ধরে রাষ্ট্রের যে অস্তিত্ব ছিল না, তা কার্ল মার্কস ও এঙ্গেলস বিশ্বাস করতেন। তাদের মতে, রাষ্ট্রের উদ্ভব তখনই হয় যখন সমাজের অর্থনৈতিক বিকাশের একটি বিশেষ স্তরে অনিবার্যভাবে শ্রেণি বিভাজন লক্ষ করা যায়। কমিউনিস্ট পার্টির ইস্তাহার বা কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোতে সামাজিক অগ্রগতির ইতিহাসকে কার্ল মার্কস চারটি ভাগে ভাগ করেছেন一
- (১) আদিম সাম্যবাদী সমাজ,
- (২) দাস সমাজ,
- (৩) সামন্ততান্ত্রিক সমাজ এবং
- (৪) পুঁজিবাদী সমাজ।
কার্ল মার্কস তাঁর কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো গ্রস্থে বলেছেন যে, পুজিবাদী সমাজ একদিন শ্রেণিশােষণ ও শ্রেণিশাসনের বশবর্তী হবে। শ্রমিক শ্রেণি একসময় ক্ষমতাসীন হয়ে সামাজিক মালিকানা ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবে। ব্যক্তি মালিকানার পরিবর্তে সেখানে সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। পরিশেষে সবরকমের শােষণ, বঞ্না এবং শ্রেণিশােষণের অবসান ঘটবে তখন শ্রেণিশােষণের যন্ত্র রাষ্ট্র অপ্রয়ােজনীয় হয়ে পড়বে এবং অবলুপ্ত হবে (..Withering away of the State)।
রাষ্ট্র সম্পর্কে গান্ধীজীর বক্তব্য
গান্ধীজীর দৃষ্টিতে রাষ্ট্র হল সংগঠিত শক্তি ও হিংসার মূর্ত প্রকাশ। বলাবাহুল্য, রাষ্ট্রের সর্বাত্মক কর্তৃত্বের বিরােধী ছিলেন গান্ধিজি। সীমিত কয়েকজনের হাতে কুক্ষিগত রাষ্ট্রক্ষমতাকে তিনি অপছন্দ করতেন। গান্ধিজি মনে করতেন যে, সমগ্র জনগণ ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের মধ্য দিয়ে গিয়ে একদিন ক্ষমতার আধার হয়ে উঠবে।
রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে গান্ধিজি ও মার্কসীয় ধারণার সাদৃশ্য:
দৃষ্টিভঙ্গিগত দিক থেকে কার্ল মার্কস ও গান্ধিজির রাষ্ট্র সম্পর্কিত ধারণার সাদৃশ্য বর্তমান। সাম্রাজ্যবাদ এবং উপনিবেশবাদ বিরোধী রাষ্ট্র সম্পর্কিত চিন্তাধারা উভয়েরই মানসিকতায় প্রকাশ পেয়েছিল। রাষ্ট্রের অস্তিত্ব তাদের কাছে অস্তিত্বহীন এবং অপ্রয়ােজনীয় বলে বিবেচিত হয়েছিল। কার্ল মার্কস-এর কাছে যা শোষণহীন রাষ্ট্র তা-ই গান্ধিজির কাছে রামরাজ্য বা আদর্শ সমাজ হিসেবে গণ্য হয়েছিল। উভয়েই মানবপ্রেমিক তথা মানুষের মুক্তির স্বার্থে কাজ করেছেন।
রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে গান্ধিজি ও মার্কসীয় ধারণার বৈসাদৃশ্য:
গান্ধীজীর ধারণা: গান্ধীজীর আদর্শ ছিল তিনি সম্পূর্ণরূপে সত্য, ন্যায় এবং অহিংস পথ অবলম্বন করেন। গান্ধীজীর দৃষ্টিভঙ্গিতে সবকিছুর চালিকাশক্তি হল ঈশ্বর, এই কারণেই তিনি ঈশ্বর ও ধর্মের প্রতি গভীরভাবে আস্থাশীল ছিলেন। গান্ধিজি শ্রেণি সংঘর্ষ নয়, শ্রেণি সমন্বয়ে বিশ্বাসী ছিলেন। গান্ধিজি কোনাে অবস্থাতেই হিংসাত্মক উপায়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পক্ষপাতী ছিলেন না। গান্ধিজি কোনােভাবেই রাষ্ট্রের অবলুপ্তির কথা বলেননি, তিনি সবসময় রাষ্ট্রহীন গণতন্ত্রের কথা বলেছেন। গান্ধিজি যে-কোনাে প্রকার ধ্বংসলীলার ঘাের বিরােধী ছিলেন। তিনি রাষ্ট্রের ধ্বংসের কথা কোথাও একবারও উল্লেখ করেননি। গান্ধিজি ছিলেন রাষ্ট্রের অনাবশ্যক হস্তক্ষেপের প্রবল বিরােধী। তিনি চেয়েছিলেন ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। গান্ধিজির রাষ্ট্র সম্পর্কিত ধ্যানধারণা এবং তত্ত্বচিন্তা এতই বৈপরীত্যে ভরপুর যে, আপাত বিচারে তা অবাস্তব বলেই সকলের নজরে বিবেচিত হয়। গান্ধিজির রাষ্ট্রচিন্তার সঙ্গে নৈতিকতা ও ধর্ম অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত রয়েছে।
মার্কসীয় ধারণা: রাষ্ট্র ক্ষমতা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সহিংস বিপ্লবী পথের মাধ্যমে বাস্তবতাকে প্রচার করাই ছিল মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গির শ্রেষ্ঠ পন্থা। সমাজ ও রাষ্ট্র বিকাশের মূল তত্ত্ব হিসেবে কার্ল মার্কস বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির আলােতে ইতিহাসের সকল তথ্য ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি ধর্ম ও ঈশ্বরের প্রতি আস্থাশীল না হয়ে ধর্মকে আফিম বলে মনে করেছেন। কার্ল মার্কসের কাছে শ্রেণিদ্বন্দ্ব বা শ্রেণি সংগ্রামই রাষ্ট্রক্ষমতা পরিবর্তনের একমাত্র উপায়। ক্ষমতাসীন শােষক শ্রেণি কখনােই অন্য শ্রেণির হাতে স্বেচ্ছায় শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা অর্পণ করবে না বলেই তারা সর্বহারা শ্রেণির নেতৃত্বে সংঘটিত বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করবে। এটাই ছিল কার্ল মার্কসের মূল তত্ত্ব। কার্ল মার্ক বলেছেন, সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হলে, রাষ্ট্র ধীরে ধীরে অপ্রয়ােজনীয় সংগঠন রুপে অবলুপ্ত হয়ে যাবে। কার্ল মার্কস বিশ্বাস করতেন বুর্জোয়া রাষ্ট্র ধ্বংস হলে সর্বহারা শ্রেণির একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। লেনিনের নেতৃত্বে রুশ বিপ্লবের মাধ্যমে এই সত্যটি প্রমাণিত হয়েছে। কার্ল মার্কস সাম্যবাদে উত্তরণের প্রথম ধাপে রাষ্ট্রের সর্বাত্মক নিয়ন্ত্রণ তথা রাষ্ট্রীয় মালিকানার পক্ষপাতী ছিলেন। কার্ল মার্কসের রাষ্ট্র সম্পর্কে চিন্তা দর্শন হল একটি বিশ্ববীক্ষা। মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণরূপে ঐতিহাসিক বিজ্ঞানসম্মত বস্তুবাদের উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে। এখানে ধর্ম ও নৈতিকতার কোনোরূপ প্রাধান্য নেই।