পাশ্চাত্য শিক্ষার ঢেউ যখন আছড়ে পড়ল এদেশের বুকে তখন প্রাচ্যপন্থী রক্ষণশীল মানসিকতা ও পাশ্চাত্যপন্থী ভাবধারার দেখা দিল সংঘাত। কিন্তু লক্ষণীয় প্রাচ্য পন্থীর বাংলা ভাষার প্রতি দরদী ছিল না, ছিলেন সংস্কৃত ভাষার প্রতি। ভাষার দারিদ্র্যে তাঁরা লজ্জাবোধ করতেন, কিন্তু সেই লজ্জা মুক্তির জন্য লেখনী ধারণ করতেন না। মধুসূদনের পূর্বে রঙ্গলাল বাংলা ভাষায় এই দারিদ্র্যতা ঘোচাবার জন্য লেখনী ধারণ করেছিলেন।

মধুসূদনের কবি প্রতিভার মৌলিকতার পরিচয়বাহী তাঁর কাব্যগুলি। ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’র মতো মহাকাব্য রচনার সময়ই তিনি রচনা করেছেন ওড জাতীয় কাব্য ‘ব্রজাঙ্গনা’ (১৮৬১) আর তার ঠিক পরেই লিখলেন ‘বীরাঙ্গনা’ (১৮৬২)। মধুসূদনের অমিত্রাক্ষর ছন্দের সূচনা ‘তিলোত্তমা সম্ভব কাব্য’ কিন্তু তার পরিপূর্ণতা বীরাঙ্গনা কাব্যে। ‘বীরাঙ্গনা কাব্যে’ বাংলা ভাষায় লেখা প্রথম সার্থক পত্রকাব্য।

প্রাচীন ভারতে নারী শুধু পুরুষের শয্যাসঙ্গিনী এবং পুত্র উৎপাদনের আধারমাত্র ছিল না। নারীরা ছিলেন যোগ্য সহধর্মিণী, সহমর্মিণী। ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগে পাশ্চাত্য রেনেসাঁস সমৃদ্ধ শিল্প ও সাহিত্যের সংস্রবে আসার ফলে বাংলা কবিতাতেও এসেছে অবশ্যম্ভাবী পরিবর্তন। উনিশ শতকের মধ্যভাগের শেষ গুরুত্বপূর্ণ কবি ভারতচন্দ্রের সাথে সাথে কবি ঈশ্বর গুপ্তও করেছেন কাব্যচর্চা। ঈশ্বর গুপ্তের বস্তুবাদী চিন্তা, তাঁর তির্যকতা সে যুগের সাধারণ মানুষকে খুশি করলেও সাহিত্যের যথার্থ রস পিপাপুদের অতৃপ্ত থাকতে হয়েছে।

এদেশে নারী শিক্ষা চেতনার সূচনা বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে। বেথুন স্কুলের সঙ্গে ওই বিদ্যালয়ের মিলন স্ত্রী শিক্ষার নব দিগন্ত উন্মোচন করে। নারীর শিক্ষার সাথে সাথে আসে নারী প্রগতির প্রশ্ন। শিবনাথ শাস্ত্রী, ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গ সমাজ’ গ্রন্থে জানিয়েছেন সেকালে স্ত্রীর হাত ধরে কেবশচন্দ্র সেন দেউড়ির দুয়ার পেরিয়ে পথে নামার সাথে সাথে ঘটেছিল নতুন যুগের নারী প্রগতির সূচনা। নারী চিত্রের এই উন্মোচন সুসম্পূর্ণ হবার জন্য বিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। মধুসূদনের কাব্যে কোনো মৌলিক নারী চরিত্র সৃষ্টি হয়নি—পৌরাণিক আর ঐতিহাসিক চরিত্রগুলি আধুনিক জীবন দৃষ্টিতে স্বতন্ত্র আর অভিনব হয়ে উঠেছে।

‘বীরাঙ্গনা কাব্যে’র প্রথম পত্র ‘দুষ্মন্তের প্রতি শকুন্তলা’। কালিদাসের নাটক ‘শকুন্তলা’র চরিত্রটি এ পত্রের অবলম্বন। পত্রের একমাত্র পরিচয় সে প্রেমিকা। দুষ্মত্তের সঙ্গে আকস্মিক পরিচয়, মিলন, বিবাহ, দুর্বাসার অভিশাপ, স্বামী কর্তৃক প্রত্যাখ্যান, ইত্যাদি মধুসূদনের কাব্যে নারীর চিত্র মুক্তির কারণ হয়ে উঠেছে। তার চিঠিতে দুষ্মত্তের সঙ্গে তার প্রথম পরিচয় থেকে মিলন ও বিরহ পর্যন্ত বর্ণনা করে সে জানিয়েছে অন্তরের তীব্র ব্যাকুলতাকে। এখানে নারী চিত্তের মুক্তি ঘটতে আমরা দেখি।

‘সোমের প্রতি তারা’ পত্রটি অনেক বলিষ্ঠ পত্র। কিন্তু মধুসূদন তার এই পত্রে নারী হৃদয়ের আন্তঃস্থলকে দেখিয়েছেন। সোমের প্রতি তারার সামাজিক সম্পর্ক শিষ্যের সঙ্গে গুরুমার। এখানে পাশ্চাত্য নারীর চেতনা প্রকাশ ঘটেছে।

‘দশরথের প্রতি কেকেয়ী’ পত্রে দশরথের স্ত্রী কেকেয়ী চরিত্রটি নূতনতর মর্যাদা পেয়েছে। আপন অধিকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সে স্বামীকে অপমানজনক ভাষায় আঘাত করতেও ছাড়েনি। রামায়ণের কেকেয়ী অন্দরমহলের গোষা ঘরে ঢুকে রাজ্যকে বিড়ম্বিত করেছে। কিন্তু মধুসূদনের কেকেয়ী সরাসরি পত্রের দ্বারা নিজ মনোবাসনা ব্যক্ত করেছে। আহত ও অসুস্থ দশরথ কেকয়ীর সেবায় এক সময় সুস্থ হয়ে উঠে তাকে তিনটি বর দিতে চেয়েছিলেন। সে বরগুলি উপযুক্ত সময়ে চেয়ে নেবে বলে কেকেয়ী বলেছিল। কিন্তু মধূসূদন এমনভাবে এপত্রের সূচনা করেছেন যেন মনে হয় কেকেয়ী তার মনোবাসনা বা বরে পূর্বেই বারবার চেয়েছে।

‘অর্জুর্নের প্রতি দ্রোপদী’তে আছে আত্মমর্যাদা সম্পন্না নারীর বীর পূজা। পতি সুদূর প্রসারজীবন থেকে ফিরে আসার জন্য বিরহ কাতর নারীর আকুল আহ্বান। এইখানে ভারতীয় নারী চেতনার মুক্তির উন্মেষ ঘটেছে।

নারী চিত্রমুক্তির অর্থ এই নয়, সমাজ সংসারকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করে নিজের খুশিমতো যা খুশি কাজ করা, বরং অস্বীকার করা সেই সামাজিক বন্ধসংস্কারের সেই অংশকে যে অংশে থাকে কুসংস্কারের অবিলতা, অন্যায়ভাবে নারীকে পেষণ করার প্রয়াস তার স্বতন্ত্রবিকাশে বাধা দেওয়ার প্রচেষ্টা। কুমারী, সধবা, প্রেষিত-ভর্তৃকা নানা ধরনের চরিত্রের মাধ্যমে মধুসূদন চরিত্রগুলির স্বাধীন বিকাশ ঘটাতে চেয়েছেন। ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়াকে প্রাধান্য দিয়েছেন।

Rate this post