সুলতানি আমলে কেন্দ্রীয় শাসনকাঠামো:
সুলতানি আমলে শাসনব্যবস্থার চরিত্র আক্ষরিক অর্থেই ছিল স্বৈরতান্ত্রিক। ধর্ম ও রাজনৈতিক স্বার্থ চিন্তাকে সমখণ্ডিত করে সুলতানি আমলে যে শাসন-পদ্ধতির প্রচলন করা হয়, তাতে সুলতান রাষ্ট্রের পার্থিব ও অপার্থিব উভয় ক্ষেত্রেই চূড়ান্ত কর্তৃত্বের অধিকারী ছিলেন। ধর্ম ও রাজনীতির এই মিলনের ফলে রাষ্ট্রনীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে মুসলিম ধর্মতাত্ত্বিক উলেমাদের প্রভাব বৃদ্ধির সম্ভাবনা ছিল; কিন্তু সামরিক ভাগ্যান্বেষী দিল্লির সুলতানেরা সচেতনভাবেই তা প্রতিহত করেন। সুলতান দৈবশক্তির সাথে রাজশক্তির সম্পর্কের তত্ত্ব প্রচার করলে ক্ষমতালোভী উলেমারা তা মেনে নেন। এইভাবে সুলতান ধর্ম এবং রাজনীতির চূড়ান্ত নীতিনির্ধারকের আসনে উত্তীর্ণ হন। আইনবিভাগ, শাসনবিভাগ ও বিচারবিভাগের সর্বময় ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকে সুলতানের হাতে। অবশ্য তাঁরা সরাসরি কোরান বা শরিয়তের সাথে সংঘাতে যেতেন না। তা সম্ভবও ছিল না, বাঞ্ছিতও ছিল না। তবে কেবল ধর্মশাস্ত্রের নির্দেশনামা সুলতানি আমলে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের চালিকা শক্তিতে পরিণত হতে পারেনি।
সুলতানি আমলে রাজপদে নির্বাচন-সংক্রান্ত কোনো আইন বা রীতি সুনির্দিষ্ট ছিল না। সুলতান সিংহাসনে বসতেন তাঁর শক্তির জোরে। সুলতানির স্থায়িত্বও নির্ভর করত সুলতানের সার্বিক দক্ষতার ওপর। অন্যান্য প্রশাসনিক সংস্থাগুলি সুলতান পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়ে যেত অথবা নতুন সুলতানের প্রতি আনুগত্য জানিয়ে টিকে থাকত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সুলতান তাঁর পরবর্তী উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যেতেন। তবে সেই ব্যক্তির সিংহাসনে বসা কিংবা টিকে থাকা একান্তভাবে নির্ভর করত তাঁর ব্যক্তিগত দক্ষতা ও প্রতিভার ওপর। এ কাজে অভিজাতদের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তাঁরা ইচ্ছা করলে নিজেদের মনোনীত যে-কোনো ব্যক্তিকে, এমনকি প্রাক্তন সুলতানের বংশের বাইরের লোককেও, সিংহাসনে মনোনীত করতে পারতেন। অবশ্য এই ব্যবস্থার একটা শুভ দিক ছিল। এর ফলে যোগ্য ব্যক্তির সর্বোচ্চ পদে মনোয়ন সম্ভাবনা ছিল বেশি। ড. কুরেশীর ভাষায় : “The absence of an heridetary principle of succession, the rough and ready methods of selecting the Sultan nor only worked well, but were the only means of finding the right man at the right time.”
সুলতান স্বৈরাচারী ক্ষমতার অধিকারী হলেও, তা অনিয়ন্ত্রিত বা স্বেচ্ছাচার ছিল না। এর মূলে ছিল বাস্তব প্রয়োজনবোধ। আমরা আগেই দেখেছি (সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতি) যে, মধ্যযুগে সুলতানের স্বৈরতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো কোনো সংগঠিত রাজনৈতিক সংস্থা ছিল না। অভিজাতরা ছিলেন স্বার্থান্বেষী এবং গোষ্ঠী- রাজনীতির শিকার, উলেমারাও পদের মোহে ক্ষমতাবান সুলতানের বিরুদ্ধাচরণ করতে দ্বিধান্বিত ছিলেন। সর্বোপরি তখন কোনো জনপ্রতিনিধিমূলক পরিষদ বা সাংবিধানিক রীতি ছিল না, যা জনগণের ইচ্ছার সাথে প্রশাসকের যোগস্থাপন করতে সক্ষম। স্বভাবতই সুলতান ছিলেন অপ্রতিহত ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু বিচক্ষণ সুলতানেরা এই অর্জিত ক্ষমতার অপব্যবহার কদাচ করতেন। যাঁরা অন্ধের মতো আচরণ করতেন, তাঁদের স্থায়িত্ব ছিল খুবই অল্প। বিচক্ষণ সুলতানেরা উপলব্ধি করেন যে, সুবিস্তৃত রাজ্যের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ তাঁর একার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই রাষ্ট্রের প্রয়োজনে তাঁরা একটা শাসন-পরিকাঠামো গড়ে তোলেন। এখানে নিয়োজিত হন বিভিন্ন স্তরের কর্মীমণ্ডলী। এরা ব্যক্তিগতভাবে বা সংঘবদ্ধভাবে সুলতানকে পরামর্শ দিতেন। এখনকার মন্ত্রীপরিষদের সমতুল্য না হলেও ‘মজলিস-ই-খওয়াত ‘নামক সভা সুলতানকে নানা বিষয়ে পরামর্শ প্রদান করত। উচ্চ অভিজাত ও দায়িত্বশীল কর্মীদের সভা ‘বার-ই-খাস’ জরুরি অবস্থায় সুলতানকে মতামত প্রদান করে সাহায্য করত। এই সকল সভার পরামর্শ গ্রহণ করা বা না-করা ছিল সম্পূর্ণভাবে সুলতানের ইচ্ছাধীন। তথাপি একথা সত্য যে, সুলতানের শুভবুদ্ধি জাগ্রত করার ক্ষেত্রে এদের একটা ভূমিকা ছিল।
কেন্দ্রীয় প্রশাসনে সুলতানের পরেই ছিল ‘উজির’ (প্রধানমন্ত্রী স্বরূপ)-এর স্থান। তাত্ত্বিকদের মতে, “উজিরের সাহায্য ও সমর্থন ছাড়া সার্বভৌমত্ব ও সাম্রাজ্য গৌরবের চরমে উঠতে পারে না; উজিরের সুপরামর্শ সাম্রাজ্যের উন্নতি এবং প্রজাদের সমৃদ্ধির পথ প্রশস্ত করে।” সাধারণভাবে উজিরের ক্ষমতা নির্দিষ্ট ছিল না। তা নির্ভর করত পদাসীন ব্যক্তির দক্ষতা এবং সুলতানের সাথে সম্পর্কের ওপর। যেমন—মহম্মদ তুঘলকের উজির খাজা-জাহান সুলতানের অবর্তমানে রাজধানীতে সুলতানের কাজ পরিচালনার অধিকারী ছিলেন। ফিরোজ তুঘলকের উজির খান-ই-জাহান ছিলেন ধর্মান্তরিত ব্রাহ্মণ। কিন্তু সুলতানের অতি বিশ্বস্ত এবং কর্মদক্ষ এই উজির রাজস্ববিভাগের একচ্ছত্র অধিপতি ছিলেন। এই সময়কে ‘উজিরৎ-এর চরম গৌরবের কাল’ বলা হয়। যাই হোক্, প্রথমদিকে সাধারণত সামরিক কাজে দক্ষ ব্যক্তিরাই উজির পদে নিযুক্ত হতেন। চতুর্দশ শতকে রাজস্ব কাজে দক্ষ ব্যক্তিদের উজির-পদে প্রাধান্য দেওয়া হয়। উজিরের প্রধান কাজ ছিল রাজস্ব আদায় ও প্রশাসন পরিচালনা করা। তবে সাধারণভাবে তিনি ছিলেন সমগ্র অসামরিক প্রশাসনের তত্ত্বাবধায়ক। সাম্রাজ্যের আয়ব্যয় সংক্রান্ত বিষয়ে উজিরকে সাহায্য করার জন্য একজন হিসাবরক্ষক ও একজন হিসাবপরীক্ষক থাকতেন। ড. আর. পি. ত্রিপাঠী ‘উজির’ পদের গুরুত্ব প্রসঙ্গে লিখেছেন যে, তিনি প্রজাসাধারণ ও সুলতানের মধ্যে যোগসূত্রস্বরূপ ছিলেন। সুলতানির স্বার্থে উজির-পদের ক্ষমতা ও মর্যাদা অব্যাহত থাকা আবশ্যিক ছিল। কারণ সুলতানের খেয়ালিমনের নিয়ন্ত্রণ এবং শাসক ও শাসিতের যোগসূত্র হিসেবে উজির প্রশাসনকে স্থায়িত্বদানের দায়প্রাপ্ত ছিলেন। কিন্তু সুলতানেরা প্রায়শই সন্দেহবশত উজিরের ক্ষমতা খর্ব করে নিজেদের অস্থিত্বকে বিপন্ন করতেন।
উজিরৎ ছাড়া সুলতানি প্রশাসনের অপর তিনটি স্তম্ভ ছিল ‘দিওয়ান-ই-আরজ’, ‘দিওয়ান-ই রিসালত্’এবং ‘দিওয়ান-ই-ইন্সা’। উজিরৎ-এর পরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ‘দিওয়ান-ই-আরজ’। এই বিভাগের প্রধান ছিলেন ‘আরিজ-ই-মমালিক’। সুলতানি সেনাবাহিনীর সংগঠন ও পরিচালনার দায়িত্ব ছিল এই বিভাগের। ‘আরিজ-ই-মমালিক’ সৈন্যসংগ্রহ, তাদের বেতন নির্ধারণ ও প্রদান, যুদ্ধকালে সেনা প্রস্তুতি, বাহিনীর কুচকাওয়াজ পরিদর্শন ও দক্ষতা বিচার, যুদ্ধের পরে সংগৃহীত অর্থ-সম্পদের বণ্টন, তদারক ইত্যাদি কাজ সম্পন্ন করতেন। প্রসঙ্গত স্মরণীয় যে, আরিজ সেনাবিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেও সর্বাধিনায়ক ছিলেন না। এই পদটি ছিল সুলতানের নিজের হস্তগত। “দিওয়ান-ই-রিসালত’-এর দায়িত্ব সম্পর্কে কিছুটা বিতর্ক আছে। ড. কুরেশীর মতে, ধর্মীয় কাজের তত্ত্বাবধান করতেন, ‘সদর-উস্-সুদূর’। কিন্তু সতীশ চন্দ্র ‘সদর-উস্-সুদুর’ এবং প্রধান কাজিকে একই ব্যক্তি হিসেবে বর্ণনা করে দিওয়ান-ই রিসালতের প্রধান কর্মাধ্যক্ষ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ‘দিওয়ান-ই-ইনসা’ ছিলেন সরকারি চিঠিপত্র, দলিল-দস্তাবেজ ও যোগাযোগের দায়িত্বপ্রাপ্ত। স্বভাবতই সুলতানের একান্ত বিশ্বস্ত ব্যক্তি এই পদে নিযুক্ত থাকতেন। বিভিন্ন প্রাদেশিক শাসক, অন্যান্য ভারতীয় রাজ্য ও সরকারি কর্মচারীদের সাথে সুলতানের বা সরকারের গোপন এবং সরকারি মতবিনিময় ‘দিওয়ান-ই-ইনসা’র মাধ্যমে সম্পন্ন হত। এঁর অধীনে বহু দবির কর্মরত থাকতেন। সরকারি নির্দেশনামায় খসড়া প্রস্তুত করা এবং সুলতানের অনুমোদনের পর তা কপি করে উপযুক্ত স্থানে প্রেরণ ও নথিভুক্ত করার কাজ ‘দিওয়ান-ই-ইন্সা’ও তাঁর সহযোগীরা সম্পন্ন করতেন।
সুলতানি শাসনকাঠামো বর্ণিত চারটি বিভাগের প্রায় সমতুল্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল ‘কাজি-উল-কাজাৎ বা প্রধান কাজির পদটি। ইনি ছিলেন বিচারবিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত। সুলতানের পক্ষে ইনি বিচারের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করতেন। নিম্ন আদালতের বিচারকদের নিয়োগ এবং দেওয়ানি ও ফৌজদারি বিচারের আপিল বিচারও প্রধান কাজি করতেন। মুসলিম আইনবিধি ‘শরিয়ত’ অনুযায়ী কাজি দেওয়ানি বিচার নিষ্পত্তি করতেন। ‘মুফূতি’ নামক কর্মীরা কাজিকে আইনের ব্যাখ্যা করে বিচারকার্যে সাহায্য করতেন। অ মুসলমানরা নিজ নিজ আইনে বিচার পেতেন। নতুন আইন শহর ও মুসলমানপ্রধান অঞ্চলে প্রথমে প্রয়োগ করা হত। গ্রামাঞ্চলে পুরোনো আইন চলত। গ্রামে বিচারের ভার ছিল গ্রাম পঞ্চায়েতের ওপর। সুলতানি যুগে দণ্ডবিধির কঠোরতা ছিল। অপরাধ কবুল করানোর জন্য কঠোর শাস্তি দেওয়া হত। অপরাধ হিসেবে ধৃত ব্যক্তির আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ ছিল খুবই কম। প্রধান কাজি ‘সদর-উস্-সুদুর’ নামেও পরিচিত ছিলেন।
স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থায় অধীনস্থ প্রজা, কর্মচারী ও আঞ্চলিক প্রশাসনের ওপর কেন্দ্রীয় সরকারের নিরন্তর অনুসন্ধান আবশ্যিক। তাই দিল্লির সুলতানেরা সর্বদা অতি দক্ষ ও সুসংগঠিত গুপ্তচরবাহিনী পোষণ করতেন। ‘বারিদ-ই-মমালিক ছিলেন গুপ্তচরবিভাগের প্রধান। বারিদ নামক গুপ্তচরবৃন্দ দেশের নানা অংশে কর্মরত থেকে রাজ্যের খুঁটিনাটি প্রতিটি সংবাদ প্রধান বারিদকে জানাতেন। দ্রুত সেই সংবাদ সুলতানের কর্ণগোচর করা হত। সুলতানরা নীতিগতভাবে গুপ্তচরদের প্রকাশ্যে দরবারে হাজির হওয়া পছন্দ করতেন না। কিন্তু গোপন সংবাদ যথাসময়ে সুলতানের কাছে পৌঁছে দিতে না পারলে বা ভুল সংবাদ দিলে সংশ্লিষ্ট বারিদকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হত। বারাণী লিখেছেন : “সৎ, দয়ালু ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের এই পদ গ্রহণে বাধ্য করা হত। কারণ মনে করা হত এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় কর্তব্য।”
উপরিলিখিত দপ্তরগুলি ছাড়াও বহু কর্মচারী সুলতানি প্রশাসনের সাথে যুক্ত থাকতেন। সুলতানের প্রসাদ ও রাজকীয় কারখানা সম্পর্কে তদারকির জন্য একটি বিশেষ বিভাগ ছিল। এর প্রধানকে বলা হত ‘ভকিল-ই-দার’। ইনি সুলতানের ব্যক্তিগত সুখসুবিধা ও রাজপরিবারের সমস্ত সদস্যের ব্যক্তিগত প্রয়োজনের তত্ত্বাবধান করতেন। সরকারি কারখানা থেকে রাজপরিবার ও ক্ষেত্রবিশেষে অভিজাতদের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সরবরাহ করা হত। এই সকল কারখানায় বহু ক্রীতদাস নিযুক্ত থাকত। দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব ছিল ‘কতোয়াল’এর ওপর। কতোয়ালের অধীনে বহু কর্মচারী নিযুক্ত থাকতেন। এ ছাড়া সুলতানের দেহরক্ষী বাহিনীর তত্ত্বাবধায়ক ‘সর-ই-জান্দার’, কৃষিবিভাগের ভারপ্রাপ্ত ‘আমির-ই-কোহ, গৃহনির্মাণ-বিষয়ক প্রধান ‘আমির-ই-ইমারত, দাতব্যবিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত ‘দিওয়ান-ই-খয়রাত’, নৌযান নিয়ন্ত্রক ‘আমির-ই-বেহর’, সহকারী উজির ‘নায়েব-ই-মমালিক’ প্রভৃতি নানা ধরনের কর্মীবৃন্দ সুলতানি আমলের প্রশাসনের সাথে জড়িত ছিলেন।