সাধারণত ‘বৈষ্ণব পদাবলী’কে ‘বৈষ্ণুব কবিতা’বা বৈষ্ণবগীতি কবিতা হিসাবে আমরা আখ্যাত করে থাকি। এখন প্রশ্ন হল, গীতিকবিতা কাকে বলে? পাশ্চাত্য সাহিত্যে ‘লিরিক’ নামে যাকে অভিহিত করা হয় বাংলায় সেটাই গীতি কবিতা। আসলে গীতি কবিতাগুলি ‘লির’ নামক বাদ্যযন্ত্রের মাধ্যমে গীত হত বলেই তার নাম দেওয়া হয়েছে ‘লিরিক’। বৈষ্ণব পদাবলীকে গীতি কবিতা বলা হয়ে থাকে। বৈষ্ণব পদাবলী কিন্তু পাঠ্য কবিতা নয় গেয় কবিতা । এ প্রসঙ্গে কাব্যেরসিক সমালোচক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মত পোষণ করা যাক—“গীত হওয়াই গীতি কাব্যের আদিম উদ্দেশ্য ; কিন্তু যখন দেখা গেল যে, গীত না হইলেও কেবল ছন্দোবিশিষ্ট রচনাই আনন্দদায়ক, এবং সম্পূর্ণ চিত্ত ভাবব্যঞ্জক, তখন গীতোদ্দেশ্য দূরে রহিল, যুগেয় গীতিকা রচিত হইতে লাগিল। অতএব গীতে রসের যে উদ্দেশ্য, সেই কাব্যই গীতি কাব্য।” অর্থাৎ আনন্দ বেদনা সুখদুঃখ-আদিসূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভূতি যখন ছন্দোবদ্ধ হয়ে প্রকাশিত হয় তাকেই আধুনিক সংজ্ঞায় ‘গীতি কবিতা’ বলা সমীচীন।
গীতি কবিতার স্বরূপ বিশ্লেষণ করলে কয়েকটি মৌল বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়—
(১) কবির ব্যক্তিক অনুভূতির স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ। (২) কবির ব্যক্তিক আবেগ ও অনুভূতির সংক্ষিপ্ত প্রকাশ। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে হয়, একটুখানির মধ্যে একটিমাত্র ভাবের বিকাশই গীতি কবিতা। (৩) গীতি কবিতা হল কোনও একক সত্তার ব্যক্তিগত আনন্দ বেদনাপূর্ণ প্রকাশ। এখানে ব্যক্তিগত আনন্দই শেষ কথা। বস্তুগত অনুভূতির নয় অর্থাৎ অপরের অনুভূতি নয়।
অতএব আধুনিক গীতি কবিতা উক্ত বৈশিষ্ট্যের নিরিখে বিচার করলে বৈষ্ণব পদাবলীকে কখনই গীতি কবিতার মর্যাদা দেওয়া যেতে পারেনা। কারণ বৈষ্ণব পদাবলী কখনোই কবিদের ব্যক্তিমানসের আনন্দ-আবেগ-বেদনার উচ্ছ্বাসময় প্রকাশ নয়। তাই এখানে ব্যক্তিগত আবেদন, অনুভূতির প্রকাশ পাইনা। তবে এই পদপাঠে আনন্দ উপভোগ করা হয়। গীতিকবিতার শ্রেষ্ঠ উপাদান প্রেম। বৈব পদেও প্রেমের জলোচ্ছ্বাস ও বন্যা লক্ষ্য করা যায়। বৈষ্ণুব তত্ত্বকে বাদ দিয়ে, মানব-মানবীর প্রেমলীলা ও প্রেমানুভূতি বৈষ্ণুব পদাবলীতে অনুপম। কিন্তু বৈষ্ণব পদাবলীতে ধর্মের আবেদন মুখ্য। গীতি কবিতায় যে ধরণের ভাবচিত্র ও সুরঝংকার শোনা যায় বৈক্ষ্ণব পদাবলীতেও সেইরূপ চিত্র ও সুর একই সঙ্গে বেজে ওঠে।
বৈষ্ণব পদাবলীর মধ্যে গীতি কবিতার উপাদান সুপ্রচুর। যেমন, বিদ্যাপতির কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল-
“এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর
এভরা বাদর মোহ ভাদর
শূন্যমন্দির মোর।”
এই যে অনন্ত ভাব মাধুরী, ছন্দের কলতান, সঙ্গীতময়তা সত্যি আমাদেরকে আনন্দের স্রোতে জারিত করে। এই আনন্দময়তা রসের উদ্ভব করে বলেই বৈষ্ণব পদাবলীকে গীতি কবিতা বলা হয়। কিন্তু তাত্ত্বিকগণ মনে করেন, এ পদ কবির মনোজগতের কথা নয়, কাস্ত-কৃষ্ণের সঙ্গে কান্তা-রূপভক্ত শ্রীরাধিকার নিরবিচ্ছিন্ন মানসপ্রেমলীলা। অতএব বৈশ্বব পদ্গীতি কবিতা হতে পারে না। কেন না কাব্য বিষয়ে উক্ত পদে ‘রাধাকৃষ্ণ’ কবিদের ব্যক্তিগত অনুভূতি প্রকাশের সুযোগ দেননি। মূলবিষয়-বস্তু ঠিক থেকে গেছে। কবিতার ভাব আগে থেকেই নির্ধারিত ও নির্দিষ্ট। তাই আধুনিক গীতি কবিতার সঙ্গে এদিক দিয়ে দেখলে বৈব পদের কোনও মিল নেই।
বৈষ্ণব পদাবলীর পশ্চাৎপটে একটা ভাবলোক বর্তমান থাকলেও কার্যত বৈশ্বব কবিতার পটভূমিকায়-প্রকৃতির সৌন্দর্যে, রাধাকৃষ্ণের নিবিড় মিলন রস ও তীব্র বেদনায়, রূপানুরাগে মর্ত্যধূলি ধূসরিত এই বাস্তব জগৎকেই উপস্থাপন করা হয়েছে—
“রূপ লাগি আঁখি ঝরে গুণে মন ভোর।
প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর।।”
অধ্যাপক শশিভূষণ দাশগুপ্ত মহাশয় বলেন,—“দ্বাদশ শতকের জয়দেব ব্যতীত অন্যান্য কবিগণ রচিত রাধা-প্রেমের কবিতা সমসাময়িক পার্থিব প্রেমের কবিতার সহিত সমসুরেই গ্রথিত। জয়দেব হইতে আরম্ভ করিয়া পরবর্তী কালের বৈষ্ণব কবিতার সহিতও ও ভারতীয় চিরপ্রচলিত পার্থিব প্রেমকবিতার ধারার গভীর মিল রহিয়াছে।”
এখানে অবশ্য পার্থিব কবিতা বলতে রোমান্টিক বৈশিষ্ট্যকেই বোঝান হয়েছে। বৈষ্ণুব কবিতার যে আকুলতা, অপ্রাপ্যকে পাবার আকাঙ্ক্ষা এর মধ্যেই আধুনিক গীতি কবিতার জীবন-লক্ষণ বর্তমান ৷ গীতি কবিতার রোমান্টিক আবেদন প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে ছুটে চলাই তো আসল ব্যাপার। যে সৌন্দর্য, আনন্দ ও প্রেমের নবমুকুলিত ধারায় কবির ব্যক্তিগত অনুভূতি নিয়ে গীতি কবিতার জন্ম, বৈষ্ণব পদাবলীতে সে লক্ষণও প্রকাশিত। বৈষুব কবিগণ অন্তরালে থেকে নায়ক নায়িকাকে যেভাবে স্থাপন করেছেন সেখানে অনুভূতির গাঢ়তা ও আন্তরিকতার বিন্দুমাত্র ত্রুটি ঘটেনি।
“রূপের পাথারে আঁখি ডুবি সে রহিল
যৌবনের বনে মন হারাইয়া গেল।।
বৈষ্ণব পদাবলীর তত্ত্ব আলোচনা করলে বৈক্ষ্ণব কবিতাকে গীতি কবিতা বলা সমীচীন কিনা তা বলা দুষ্কর হয়ে পড়ে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ধর্ম তত্ত্বকে বাদ দিয়ে বৈষ্ণুব কবিতাকে গীতি কবিতা হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের কাছে গীতি কবিতা তো একটুখানির মধ্যে একটি মাত্র ভাবের বিকাশ। সে দিক দিয়ে বিচার করলে বৈব পদের গীতিকবিতা নামাঙ্কন কিছুটা সার্থক হয়েছে। যেমন বিদ্যাপতির—
“এ ভরা বাদর মাহভাদর
শূন্য মন্দির মোর।”
কণ্ঠে উচ্চারিত হওয়ার সাথে সাথে বহুদিন ধরে হৃদয়ে সঞ্চিত থাকা অব্যক্ত ভাবমাধুরীর ব্যঞ্জনাপূর্ণ যে উদ্ভাসন ঘটে তা গীতি কবিতারই সম্পদ। অতএব বৈষ্ণব পদ হল রোমান্টিক গীতি কবিতা।