নূরজাহান শব্দের অর্থ হল জগতের আলাে। পারস্যের মির্জা গিয়াস বেগের কন্যা নূরজাহানের (১৫৭৮-১৬৪৫ খ্রি.) আসল নাম ছিল মেহেরউন্নিসা। ভারতে এসে শেখ মামুদ নামে এক ধর্মপ্রাণ মুসলিমের সহায়তায় গিয়াস বেগ আকবরের দরবারে চাকরি পান। সেখানে আকবরের পুত্র সেলিম (জাহাঙ্গির) মির্জা গিয়াস বেগের কন্যা নূরজাহানের অপরূপ সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হন।

[1] নুরজাহান ও জাহাঙ্গিরের প্রেম: আকবরের পুত্র যুবরাজ সেলিম (জাহাঙ্গির) নূরজাহানের প্রেমে একদা আকুল ছিলেন আকবরের মৃত্যুর পর সেলিম সম্রাট হয়ে ১৬০৭ খ্রিস্টাব্দে আলিকুলি বেগকে হত্যা করেন এবং ১৬১১ খ্রিস্টাব্দে নূরজাহানকে বিবাহ করে তাকে প্রধানা মহিষীর মর্যাদা দেন।

[2] নুরজাহানের রাজনৈতিক দক্ষতা: নূরজাহান সহজসরল, প্রজাদরদি এবং বহুগুণের অধিকারী হলেও রাজনীতির কুটকৌশলেও অত্যন্ত বিচক্ষপ ছিলেন। যে-কোনাে জটিল রাজনৈতিক বিষয় তিনি সহজেই সমাধান করতে পারতেন।

[3] রাজনৈতিক সুযােগ গ্রহণ: ১৬১১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৬২৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জাহাঙ্গিরের অসুস্থতা ও দুর্বলতার সুযােগে নূরজাহান প্রশাসনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেন। তাঁর হাতে মােগল প্রশাসন নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে। তার সহায়তায় পিতা মির্জা গিয়াস বেগ এবং দুই ভ্রাতা আসফ খাঁ ও ইৎমদ খাঁ রাজদরবারে উচ্চপদ লাভ করেন।

[4] ‘নূরজাহান চক্র’ গঠন: জাহাঙ্গিরের অসুস্থতা, দুর্বলতা ও অন্ধ পত্নীভক্তির সুযােগে উচ্চাকাঙ্ক্ষী নূরজাহান একটি গােষ্ঠী গড়ে তােলেন যা ‘নূরজাহান চক্র নামে পরিচিত। নূরজাহানের নেতৃত্বাধীন এই চক্রের অন্যান্য সদস্য ছিলেন তাঁর পিতা মির্জা গিয়াস বেগ, ভ্রাতা আসফ খা এবং যুবরাজ খুররম (শাহজাহান)।

[5] চক্রের উদ্যোগ: জাহাঙ্গির ক্রমে আমােদ-প্রমােদ ও মদ্যপানে গা ভাসিয়ে দিলে প্রশাসন ও রাজনীতিতে নূরজাহান চক্রের একাধিপত্য শুরু হয়। নূরজাহান ‘Power behind throne’ বা ‘সিংহাসনের পশ্চাতের শক্তি’ হিসেবে শাসনক্ষমতা কুক্ষিগত করেন। অবশ্য ইতিহাসবিদ ড. নুরুল হাসান ‘নূরজাহান চক্র-এর বাস্তব অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।

[6] চক্রের পরিণর্তি: নূরজাহান তার প্রথম পক্ষের কন্যা লাডলি বেগমকে জাহাঙ্গিরের কনিষ্ঠ পুত্র শাহরিয়ার-এর সঙ্গে বিবাহ দিয়ে শাহরিয়ারকে সিংহাসনে বসানাের পরিকল্পনা করেন। ফলে খুররম এই চক্র ছেড়ে বেরিয়ে যান। অবশেষে নূরজাহানকে ক্ষমতাচ্যুত করে খুররম দিল্লির সিংহাসনে বসেন।

উপসংহার: খুররম সিংহাসনে বসার পর নূরজাহান বাকি জীবন গৃহবন্দি অবস্থায় কাটাতে বাধ্য হন। ১৬৪৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয় এবং লাহােরে জাহাঙ্গিরের কবরের পাশেই তাঁকে কবর দেওয়া হয়। ইতিহাসবিদ ড. আর. পি. ত্রিপাঠী বলেছেন যে, “নূরজাহান জাহাঙ্গিরের জীবনে কোনো অশুভ শক্তি হিসেবে দেখা দেননি, তিনি ছিলেন তাঁর রক্ষাকারী দেবদূতের মতােই।”

Rate this post