প্রশ্নঃ জাহেলিয়া যুগের সামাজিক অবস্থা বর্ণনা কর।
অথবা, জাহেলিয়াতের যুগে আরবের সামাজিক অবস্থা কেমন ছিল বর্ণনা কর।
ভূমিকাঃ হযরত মুহাম্মদ (স)-এর আবির্ভাবের পূর্বে আরবসহ গোটা বিশ্ব ছিল জাহেলিয়াতের অজ্ঞতা, অপসংস্কৃতি, ধর্মীয় কুসংস্কার, সামাজিক বিশৃঙ্খলা, অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও বেহায়াপনার তিমির অন্ধকারে নিমজ্জিত। ঐতিহাসিকগণ এ চরম বীভৎস যুগকে The age of ignorance বা অজ্ঞতার যুগ বলে অভিহিত করেছেন।
জাহেলিয়া যুগে আরবদের সামাজিক অবস্থাঃ নিম্নে ইসলাম পূর্ব জাহেলিয়া যুগে কুসংস্কারাচ্ছন্ন আরবদের সামাজিক অবস্থা বর্ণনা করা হলো-
বংশভিত্তিক কৌলিন্য প্রথাঃ আরবে বংশভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায় প্রচলিত কৌলিন্য প্রথা প্রসঙ্গে মওলানা আকরম খাঁ বলেন, প্রাক-ইসলাম যুগে সেখানে যে বংশগত ও গোত্রগত কৌলিন্য প্রথার প্রভাব অপ্রতিহতভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল, সে সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ নেই। এ বংশ মর্যাদা নিয়ে বিভিন্ন গোত্রের লোকদের মধ্যে অহংকার, ঘৃণা ও হিংসাবিদ্বেষ ব্যাপকরূপে বিদ্যমান ছিল।
মাদকাসক্তিঃ জাহেলিয়া যুগে আরবগণ ছিল অতিমাত্রায় মাদকাসক্ত। মদ্যপ হয়ে তারা নর্তকীদের সাথে অশ্লীল কাজে লিপ্ত হতো। ঐতিহাসিক খোদা বক্স বলেন, War, women and wine were there observing possessions of the Arabs. অর্থাৎ, মদ্যপান, নেশাসক্তি, নারী সঙ্গম প্রভৃতি চরম অনৈতিকতা আরবদের মধ্যে বিরাজমান ছিল।
নারীদের অবস্থাঃ জাহেলিয়া যুগে আরবে নারীদের কোনো সামাজিক মর্যাদা ছিল না। নারীকে পণ্যদ্রব্য এবং ভোগ বিলাসের সামগ্রী মনে করা হতো। উত্তরাধিকার সম্পত্তিতেও তাদের কোনো অধিকার ছিল না। পুরুষ কর্তৃক নারীরা সর্বত্র নিগৃহীত হতো। তবে মক্কায় নারীদের মর্যাদা কিছুটা লক্ষণীয়। যেমন খাদীজা (রাঃ) ও আবু জাহেলের মা সে যুগেও মর্যাদার অধিকারী ছিলেন।
কন্যা সন্তানের জীবন্ত সমাধিঃ প্রাক-ইসলাম যুগে আরবরা কন্যা সন্তানের জন্মকে দুর্ভাগ্য ও লজ্জাজনক মনে করত। কখনো কখনো নিষ্ঠুরতার বশবর্তী হয়ে তারা এ সকল নিস্পাপ কন্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দিতে কুণ্ঠাবোধ করত না।
বৈবাহিক অবস্থাঃ প্রাক-ইসলাম সমাজব্যবস্থায় সুষ্ঠু বিবাহ প্রথা ছিল না। পুরুষরা যেমন একাধিক স্ত্রী ও উপপত্নী রাখতে পারত, তেমনি নারীরাও একাধিক পতি রাখতে পারত। একটি লোক যত ইচ্ছা বিবাহ করত এবং ইচ্ছামতো তালাক দিত। ভাই আপন বোনকে এবং পিতার মৃত্যুর পর বিমাতাকে বিয়ে করার কুপ্রথাও তাদের মাঝে প্রচলিত ছিল।
দাসদাসীদের অবস্থাঃ বহু আগ থেকেই আরবে দাস প্রথা চালু ছিল। দাসদাসীদের কোনো সামাজিক মর্যাদা ও অধিকার ছিল না। পণ্যদ্রব্যের মতো বাজারে তাদের কেনা বেচা করা হতো। দাসদাসীকে নির্মমভাবে কাজে খাটাত ও নির্যাতন করত। তাদের জীবন মৃত্যু প্রভুর মর্জির ওপর নির্ভর করত। বিয়ে শাদীর অধিকারটুকুও তাদের ছিল না।
সুদ প্রথাঃ শোষণের অন্যতম হাতিয়ার সুদ প্রথাও আরবে প্রচলিত ছিল। লোকেরা মুষ্টিমেয় ধনিক শ্রেণির চক্রবৃদ্ধি সুদের যাতাকলে নিষ্পেষিত হয়ে সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্বে পরিণত হয়েছিল। সুদ পরিশোধ করতে না পারলে ঋণ গ্রহীতার স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির সঙ্গে তার স্ত্রী পুত্রকেও ঋণদাতা দখল করত।
বিকৃত যৌনাচার ও ব্যভিচারঃ জাহেলী যুগে আরবরা বিভিন্ন ধরনের যৌনাচার, ব্যভিচার ও নারী ধর্ষণে অনুরাগী ছিল। এ প্রসঙ্গে মওলানা আকরম খাঁ বলেন, পুং মৈথুন, নারীর অস্বাভাবিক মৈথুন ও পশু মৈথুন তাদের মধ্যে প্রচলিত ছিল এবং তাদের কাছে এসব নির্দোষ কর্ম বলে পরিগণিত হতো।
নারীরা খেলার সামগ্রীঃ প্রাক ইসলামী যুগে অভিজাত আরবরা নিছক খেলাচ্ছলে নারীদের ঘোড়ার লেজের সাথে বেঁধে ঘোড়া ছুটিয়ে দিত। এর ফলে কোন হতভাগা নারীর মৃত্যু হলে তারা উল্লাস করে আনন্দ উপভোগ করত।
জুয়াখেলাঃ জুয়াখেলা আরব সমাজে অবসর বিনোদনের একটি বিশেষ মাধ্যম ছিল। জুয়ার নেশা তাদের এমন পাগল করে তুলত যে, তারা দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে নিজ স্ত্রী কন্যাকেও জুয়ার বাজি ধরে বসত।
লুটতরাজঃ লুটপাট, মারামারি, রাহাজানি, দাঙ্গা হাঙ্গামা ছিল জাহেলিয়া আরব সমাজের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। পরসম্পদ অপহরণ ও বলপূর্বক লুণ্ঠন আরব বেদুইনের জীবনধারার অংশ ছিল।
কুসংস্কারঃ তৎকালে আরব সমাজে কুসংস্কার এত বেশি প্রচলিত ছিল যে, তারা কোনো কাজ আরম্ভ করার পূর্বে তীরের সাহায্যে দেবমূর্তির সাথে পরামর্শ করত। কোনো ব্যক্তি মারা গেলে এ বিশ্বাসে তার কবরের পাশে উট বা ঘোড়া বেঁধে রাখত যে, মৃতব্যক্তি এক সময় কবর থেকে উঠে অজ্ঞাত কোনো স্থানে বা স্বর্গের দিকে যাত্রা করবে।
অসৎ গুণাবলিঃ জাহেলিয়া সমাজের মানুষের মধ্যে আভিজাত্যের দম্ভ, আত্মম্ভরিতা, চরিত্রহীনতা, পরশ্রীকাতরতা, পরনিন্দা, পরচর্চা, হিংসা, অপরের কুৎসা রটনা ইত্যাদি অসৎ গুণাবলি মহামারীর রূপ ধারণ করেছিল। আরবের মতো নৈতিক ও সামাজিক অধঃপতিত সমাজ সমকালীন বিশ্বের অন্য কোথাও দেখা যায়নি।
সদগুণাবলিঃ জাহেলিয়াতের বিভীষিকায় নিমজ্জিত আরবদের মাঝে কতিপয় সদগুণও পরিলক্ষিত হতো। সাহসিকতা, স্বাধীন চেতনা, উদারতা, বদান্যতা, একনিষ্ঠতা, আতিথেয়তা, আশ্চর্যজনক স্মৃতিশক্তি, কাব্যচর্চা, বাগ্মিতা, আত্মসম্মানবোধ প্রভৃতি মহৎ গুণে তারা গুণান্বিত ছিল।
উপসংহারঃ একথা সুস্পষ্ট যে, প্রাক-ইসলাম যুগে আরবের সামাজিক অবস্থা ছিল বিভিন্ন অন্যায়, অনাচার, পাপাচার, ব্যভিচার, দুর্নীতি ও বিশৃখলায় পরিপূর্ণ। মহানবী (স)-এর আবির্ভাবে নীতি নৈতিকতাহীন আরব সমাজ ইসলামের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে সুষ্ঠু সমাজ সভ্যতার গোড়াপত্তন করে।