কোঠারি কমিশনের রিপোর্ট উচ্চ মাধ্যমিক স্তর থেকে অর্থাৎ একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি থেকে শিক্ষার বিশেষীকরণ কথা বলছে। এ রে সাধারণ শিক্ষার লক্ষ্যের উপযােগী শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে বৃত্তিমূলক ক্ষার পাঠক্রম চালু করার প্রস্তাব রয়েছে, যা জাতীয় উন্নয়ন ও বিকাশে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার পরেই শুরু হয় উচ্চশিক্ষা। সাধারণত কলেজ স্তর থেকে উচ্চতম স্তর পর্যন্ত যে শিক্ষা, তাই হল উচ্চশিক্ষা। বিশ্ববিদ্যালয় দ্বারা পরিচালিত শিক্ষাই হল এই শিক্ষাব্যবস্থা। সাধারণত কলেজ বা মহাবিদ্যালয় থেকে শুরু করে উচ্চতর স্তর পর্যন্ত প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থাই উচ্চশিক্ষা বলা হয়।এই উচ্চশিক্ষা হবে প্রধানত তিন ধরনের

  • প্রথম ডিগ্রি স্তর বা স্নাতক স্তর
  • দ্বিতীয় ডিগ্রি স্তর (স্নাতকোত্তর স্তর)
  • গবেষণা স্তর।

(১) ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের বিকাশ: উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্য হল শিক্ষার্থীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বিকাশ সাধন করে, তাই এই শিক্ষায় শিক্ষার্থীর আগ্রহ, প্রবণতা, মানসিক ক্ষমতা ইত্যাদি অনুযায়ী তাদের বিষয় নির্বাচনে স্বাধীনতা দেওয়া হয়।

(২) কর্মোদ্যোগী ও আর্থিক স্বনির্ভরতা দান: এই স্তরের শিক্ষার্থীরা যেহেতু তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী সাধারণ ধর্ম বা কারিগরি শিক্ষার যে-কোন একটি দিক গ্রহণ করতে পারে, তাই তাদের আত্মতুষ্টি তাদের কর্মোদ্যোগ করে তোলে, যা তাদের ভবিষ্যৎ জীবনে আর্থিক দিক থেকে স্বনির্ভর করে তােলে ও জীবনের পথকে মসৃণ করে।

(৩) সৃজনাত্মক ক্ষমতার বিকাশ: উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য হল শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৃজনাত্মক ক্ষমতার বিকাশ সাধন করে। তাই এই শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলো সৃজনাত্মক ক্ষমতার বিকাশের সুযোগ থাকে।

(৪) সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশ: এই শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক রীতিনীতি, আচার-আচরণ, লোকাচার, সংস্কৃতি প্রভৃতি পরিচিতি ঘটিয়ে সামাজিক ও সংস্কৃতির উন্নয়ন ঘটায়।

(৫) বিশেষজ্ঞ তৈরি: উচ্চমাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীরা যে বিষয় নিয়ে ভর্তি হয়, সেই বিষয়ে তার জ্ঞানের স্ফুরণ ঘটে যে তাদের একজন বিশেষজ্ঞ মানুষ হিসেবে গড়ে তােলে।

(৬) জাতীয় সংহতি ও আন্তর্জাতিক বোধের বিকাশে: সামাজিক ও জাতীয় সংহতির বিকাশের জন্য কমিশন সর্বজনীন বিদ্যালয় ব্যবস্থা চালু করার কথা বলেছে। সেখানে ধর্ম, বর্ণ, অর্থ, জাতি নির্বিশেষে সকল শিক্ষার্থী একই রকম শিক্ষা পাবে এবং যা তোমাদের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদের সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিকতাবাদের বিকাশ ঘটাবে। 

শিক্ষার সর্বোচ্চ স্তর হল উচ্চশিক্ষা উচ্চশিক্ষার পরিধি হল ব্যাপক। প্রতিভাবানদের তৈরি করা, তাদের সুপ্ত সম্ভাবনাকে পরিপূর্ণ বিকাশ সাধন করা উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্য। উচ্চশিক্ষার কাঠামোকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।

(১) প্রথম ডিগ্রি স্তর: এই স্তরে শিক্ষা ৩ বছরের। শিক্ষার্থীর বয়স হাবে ১৮-২১ বছর। প্রথম বর্ষ, দ্বিতীয় বর্ষ ও তৃতীয় বর্ষ হলে স্নাতক স্তর সম্পূর্ণ হবে।

(২) দ্বিতীয় ডিগ্রি স্তর: এই স্তরে শিক্ষা হবে ২ বছরের। কোনাে কোনাে বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩ বছরের কোর্স, M.A, MSC, MCOM ইত্যাদি ডিগ্রি চালু রয়েছে। কমিশনের মতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৪ বছরের ডিগ্রি কোর্স চালু করা যুক্তিসম্মত।

(৩) গবেষণা স্তর: স্নাতকোত্তরের শেষে Major University সংক্রান্ত উল্লেখযোগ্য সুপারিশটি হল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রথম শ্রেণির স্নাতকোত্তর পঠন ও গবেষণা হবে, প্রতিটি Major University তে থাকবে Advanced Centres. এইসকল Advanced Centres পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত থাকবে, নিজেদেরকে শক্তিশালী করার চেষ্টায় থাকবে সবসময় এবং নিজেদের মধ্যে আন্তঃগবেষণায় (Inter disciplinary) যুক্ত থাকবে। সারা ভারতে 50 টি এইরূপ Advanced Centre দরকার। এগুলিতে কৃষি, ডাক্তারি, কারিগরি ইত্যাদি শাখায় গবেষণা থাকবে।

উচ্চশিক্ষা মান উন্নয়নের জন্য কোঠারি কমিশন যে-সমস্ত সুপারিশ গুলি করেছিল, সেগুলি হল— 

(১) বিবিধ সুপারিশ :

  • প্রথম ডিগ্রি স্তর তিন বছরের হবে। দ্বিতীয় ডিগ্রি স্তর হবে দুই বা তিন বছরের।
  • উচ্চশিক্ষা স্তরের কোন ক্ষেত্রে ভাষা শিক্ষা বাধ্যতামূলক নয়। তবে আঞ্চলিক ভারতীয় ভাষা বা প্রাচীন ভাষা Elective বিষয় হিসেবে উচ্চশিক্ষার স্তরে থাকবে।
  • এইসকল সুপারিশ ছাড়াও উচ্চশিক্ষাকে আরও সুসংগঠিত করে তলতে কোঠারি কমিশন যে-সমস্ত সুপারিশের অবতারণা করেছে, সেগুলো সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হল।

(২) পরীক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার :

  • লিখিত পরীক্ষার এমনভাবে সংস্কার সাধন প্রয়ােজন যাতে এর দ্বারা প্রতিটি স্তরে অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ সম্ভব হয়। পরিমাপ ব্যবস্থা ও উচ্চশিক্ষায় মূল্যায়নের ক্ষেত্রে বহিঃ পরীক্ষার পরিবর্তে অভ্যন্তরীণ ও নিরবচ্ছিন্ন মূল্যায়নের ব্যবস্থা করার উপর গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
  • বহিঃপরীক্ষার উন্নয়নের জন্য উপযুক্ত Paper setter এবং ফলাফল নির্ধারণ ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। 
  • UGC একটি Central Examination Reform Unit প্রতিষ্ঠা করে, যেটা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে সংযোগ থাকে মূল্যায়নের ব্যাপারে।
  • বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের উন্নত মূল্যায়ন ব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার জন্য সেমিনার, আলোচনা ও ওয়ার্কশপ ব্যবস্থা রাখতে হবে।
  • খাতা দেখার জন্য শিক্ষকদের কোনাে অর্থ দেওয়া উচিত নয়।

(৩) ভরতি সংক্রান্ত কর্মসূচি :

  • উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ভরতি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া। শিক্ষার্থীদের ভর্তি করা হবে Selective Admission-এর মাধ্যমে।
  • ভর্তির ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাধাগুলোকে বিচার বিবেচনা করে দেখতে হবে।
  • পরামর্শ দেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বাের্ডে থাকবে।
  • একটি কলেজে কম করে ৫০০ শিক্ষার্থী থাকবে। যত বেশি সম্ভব কলেজে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১০০০-এর বেশি না হওয়া বাঞ্ছনীয়।

(৪) পাঠ্যক্রম ভিত্তিক কর্মসূচি :

  • উচ্চশিক্ষার স্তরে প্রত্যেক শিক্ষককে কমপক্ষে দুটি ভাষা জানতে হবে।
  • স্নাতক স্তরে কলা ও বিজ্ঞান বিষয়ে পঠনপাঠনের সময় বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে শিথিলতা প্রয়ােজন।
  • এক্ষেত্রে পাঠক্রমের পুনর্নবীকরণ-এর প্রয়োজন। পাঠ্যক্রম হওয়া উচিত General Based।
  • বিজ্ঞান শিক্ষার ক্ষেত্রে পরীক্ষা ও তাত্ত্বিক কাজের মধ্যে সমতার প্রয়োজন। 
  • মেয়েদের জন্য স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরের শিক্ষার দ্বারা সর্বক্ষেত্রে কলা, বিজ্ঞান, কারিগরি শিক্ষা যুক্ত থাকবে। 
  • গবেষণার প্রথম বছর শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন ধরনের বক্তৃতা এবং Advance Nature-এর টিউটোরিয়ালে অংশগ্রহণ করতে হবে। 
  • নতুন কলেজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কমিশন মনে করে, যে কলেজ আছে, তার সম্প্রসারণই যুক্তিসঙ্গত। 
  • কমিশন আংশিক সময়ের শিক্ষার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতির সুপারিশ করেছে। সান্ধ্য ক্লাস, ডাকযোগে শিক্ষা প্রস্তুতি প্রভৃতি সুযোগ যাতে বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষায় প্রযুক্ত হয়, তার প্রতি বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।

(৫) গবেষণামূলক কাজের জন্য :

  • গবেষণা কাজের ক্ষেত্রে ট্রেনিং ব্যবস্থা থাকবে। 
  • প্রতি Phd শিক্ষার্থীদের দ্বিতীয় একটি ভাষা অবশ্যই জানতে হবে।

(৬) স্নাতকোত্তর এর জন্য :

  • মাস্টার ডিগ্রি কোর্সে পাঠক্রমের নবীকরণ করে তাকে General Based করতে হবে। যে-কোনাে একটি বা দুটি বিষয়ে Interviewing Training এর ব্যবস্থা করতে হবে।

সর্বোপরি কোঠারি কমিশন বিশ্ববিদ্যালয় স্বাধীনতা এবং আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার সুপারিশ করেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষমতা এবং শিক্ষার মানের দিকে লক্ষ্য রেখে যোগ্য শিক্ষার্থীদের সুযোগ সুবিধা দানের কথা কমিশন বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছে।

Rate this post