অথবা, অগাস্ট কোঁৎকে কেন সমাজবিজ্ঞানের জনক বলা হয়? সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তিতে তার অবদান আলোচনা কর।
ভূমিকাঃ একটি স্বতন্ত্র বিজ্ঞান হিসেবে সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তি ও বিকাশে অগাস্ট কোঁৎ-এর অবদান অনস্বীকার্য। অগাস্ট কোঁৎ-ই সর্বপ্রথম সমাজবিজ্ঞানকে সামাজিক বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত করে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত একটি বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি সমাজবিজ্ঞান সম্বন্ধীয় বিক্ষিপ্ত চিন্তা, দর্শন ও তত্ত্বসমূহ একটি বিশেষ বিজ্ঞানের অধীনে এনে সামাজিক বিজ্ঞানের এই নতুন শাখার ভিত্তি স্থাপন করেন। এ কারণে অগাস্ট কোঁৎ-কে সমাজবিজ্ঞানের জনক বলা হয়।
জন্ম ও মৃত্যুঃ ফরাসি দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানী অগাস্ট কোঁৎ ১৭৯৮ সালে ফ্রান্সের মন্টপেলিয়ারে জন্মগ্রহণ করেন। এক ঘটনাবহুল জীবনের দীর্ঘ পরিক্রমায় ১৮৫৭ সালে ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশে অবদানঃ সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশে অগাস্ট কোঁৎ-এর অনন্য অবদান রয়েছে। নিম্নে তা তুলে ধরা হলো-
(১) সমাজবিজ্ঞানের নামকরণঃ রেনেসাঁ এবং ফরাসি বিপ্লবোত্তর সমাজের প্রেক্ষাপটে অগাস্ট কোৎ ‘Social Physics’ নামে একটি বিজ্ঞানের জন্ম দেন। পরে ১৮৩৯ সালে অগাস্ট কোঁৎ বিজ্ঞানের জগতে ‘Sociology’ তথা সমাজবিজ্ঞান প্রত্যয় ব্যবহারের মধ্যদিয়ে এক নবতর বিজ্ঞানের মাত্রা যোগ করেন।
(২) গবেষণা পদ্ধতিঃ অগাস্ট কোঁৎ-এর মতে, প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের অনুসৃত পদ্ধতি সমাজ গবেষণায়ও প্রয়োগ করতে হবে। এক্ষেত্রে তার গবেষণা পদ্ধতিগুলো হলো-
(ক) পর্যবেক্ষণ,
(খ) পরীক্ষামূলক এবং
(গ) তুলনামূলক বিশ্লেষণ।
(৩) রচনাবলিঃ সমাজবিজ্ঞানের চিন্তা, দর্শন ও তত্ত্বের মৌল ধারণা সংবলিত অগাস্ট কোঁৎ-এর উল্লেখযোগ্য রচনাগুলোর একটি হলো Positive Philosophy, যেটা ১৮৩০ থেকে ১৮৪২ সালের মধ্যে ছয় খণ্ডে প্রকাশিত হয়। আরেকটি রচনা হলো Positive Polity, যেটা ১৮৫১ সাল থেকে ১৮৫৪ সালের মধ্যে চার খণ্ডে প্রকাশিত হয়।
(৪) অগাস্ট কোঁৎ-এর দৃষ্টবাদঃ অগাস্ট কোঁৎ-এর তাত্ত্বিক অবদানসমূহের মধ্যে তার দৃষ্টবাদ হচ্ছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান। তৎকালীন ফরাসি সমাজে যে দু’টি তাত্ত্বিক ধারা বিরাজমান ছিল তার মধ্যে একটি ছিল সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে, অন্যটি ছিল স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণের পক্ষে। কেঁৎ ছিলেন দ্বিতীয় ধারার প্রবক্তা। তিনি দৃষ্টবাদকে বিজ্ঞানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে চিহ্নিত করেন। মূলত দৃষ্টবাদ কোঁৎ-এর দৃষ্টিতে একটি বিজ্ঞানসম্মত মতবাদ, যার লক্ষ্য মানবসমাজের বস্তগত, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং নৈতিকতা সংক্রান্ত বিষয়াবলীর সমৃদ্ধি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করা। দৃষ্টবাদ তিন ভাগে বিভক্ত, যথা
(ক) বিজ্ঞানসমূহের দর্শন,
(খ) বিজ্ঞানসম্মত ধর্ম ও নীতিশাস্ত্র এবং
(গ) দৃষ্টবাদী রাজনীতি।
(৫) মানব প্রগতির ত্রিস্তরের সূত্রঃ অগাস্ট কোঁৎ-এর ত্রিস্তরের সূত্র মানুষের মানসিক উন্নতি, ক্রমবিকাশ, স্বতন্ত্র সমাজগুলোর উন্নতি ও ক্রমবিকাশ এবং পরিশেষে সমগ্র মানবজাতির উন্নতি ও ক্রমবিকাশের কথা বিশ্লেষণ করে। তার ত্রিস্তরের সূত্র মূলত মানবজ্ঞানের সাথে সম্পর্কযুক্ত। এই স্তরগুলো হলো-
(ক) ধর্মতত্ত্ব সম্বন্ধীয় স্তর (Theolgical stage): এই স্তরটিকে সামরিক বা Military স্তর বলা হয়ে থাকে। এই সময় নিয়ম-কানুন খুব কড়াকড়িভাবে পালন করা হতো। এ সময় সামাজিক ঐক্যের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে পরিবার।
(খ) অধিবিদ্যা সম্বন্ধীয় স্তর (Meta physical stage): এই স্তরটি সমাজ ও চিন্তা পরিবর্তনের মধ্যবর্তী একটি পর্যায়। এই স্তরটির অবস্থান ধর্মতত্ত্ব সমন্ধীয় স্তর থেকে দৃষ্টবাদ স্তর-এ উত্তরণের অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে লক্ষ্য করা যায়। মানুষের ধর্ম সম্পর্কিত চিন্তা থেকে উত্তরণের পথ হলো এই স্তর।
(গ) দৃষ্টবাদী স্তর (Positive stage): দৃষ্টবাদ স্তর চেতনার যুগ। যেখানে বস্তুগত অবস্থান হচ্ছে ব্যক্তিগত। অন্যকথায় ব্যক্তিবাদ বস্তুগত ভিত্তি। শিল্প হচ্ছে এখানকার প্রধান নিয়ম। যাকে Positive industrial stage-ও বলা হয়। এ সময়ে রাষ্ট্রের উর্ধ্বে উঠে মানুষ নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে।
(৬) সামাজিক উন্নতির ক্রমিক ধাপঃ কোঁৎ জ্ঞানের উপযুক্ত ধারাতত্ত্বের মাধ্যমে সমাজবিবর্তনকে উপলব্ধি করেন। আর বিবর্তন বলতে তিনি সমাজের উন্নতি ও প্রগতিকে বুঝিয়েছেন। তার মতে, সামাজিক উন্নতি তিনটি ক্রমিক ধাপের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। যথা-
(ক) বুদ্ধিগত উন্নতি,
(খ) ভাবগত উন্নতি এবং
(গ) কর্মগত উন্নতি।
(৭) বিজ্ঞানসমূহের উচ্চক্রমঃ অগাস্ট কোঁৎ বিমূর্ত বিজ্ঞানসমূহের জটিলতা এবং কার্যক্ষেত্রের পরিধি অনুযায়ী বিভিন্ন বিজ্ঞানকে উচ্চক্রমে সাজিয়েছেন। তার উচ্চক্রমের ফ্রেমে সর্বনিম্নে রয়েছে অংকশাস্ত্র, তারপর জ্যোতির্বিদা, পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা, জীববিদ্যা এবং সবার উপরে রয়েছে সমাজবিজ্ঞান। কার্যক্ষেত্রের পরিধির ব্যাপকতা ও বিস্তৃতির কথা বিবেচনা করে সমাজবিজ্ঞানকে তিনি সর্বোচ্চ মর্যাদা দিয়েছেন। তা ছাড়া তিনি বলতে চেয়েছেন, সমাজবিজ্ঞান একটি সমন্বিত বিজ্ঞান, যা বিভিন্ন বিজ্ঞানের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ণয় করে।
(৯) স্বাবলম্বী হওয়ার প্রেরণাঃ আগস্ট কোঁৎ সামাজিক উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করার জন্য মানবসমাজকে স্বাবলম্বি হওয়ার অনুপ্রেরণা দিয়ে গেছেন। তিনি বলেন, দ্বৈবশক্তির মাধ্যমে সমাজব্যবস্থায় উন্নয়ন সম্ভব নয়। কারণ দ্বৈব শক্তির প্রাধান্য মেনে নিলে সবকিছু সৃষ্টিকর্তার ওপর ছেড়ে দেয়া হয়- এরূপ ধারণা সামরিক মনোভাব বিশিষ্ট রাজতন্ত্রের পরিণতি ডেকে আনে। যার ফলে সমাজে রাজতন্ত্রভিত্তিক ও সামরিক প্রভাবভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে ওঠে।
অগাষ্ট কোঁৎ কেন সমাজবিজ্ঞানের জনকঃ দার্শনিক অগাস্ট কোঁৎকে সমাজবিজ্ঞানের জনক হিসেবে অভিহিত করার পেছনে তিনটি কারণ রয়েছে। যথাঃ
(১) কোঁৎ সর্বপ্রথম ‘Sociology’ প্রত্যয় ব্যবহারের মাধ্যমে স্বতন্ত্র বিজ্ঞান হিসেবে সমাজবিজ্ঞানের ভিত্তিভূমি রচনা করেন।
(২) অগাস্ট কোঁৎ-ই সর্বপ্রথম সমাজচিন্তাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দান করেন।
(৩) তার পদাঙ্ক অনুসরণের মাধ্যমে সমাজবিজ্ঞান নামক একটি সামাজিক চিন্তার ধারা সৃষ্টি হয়েছে, যা আজ বিজ্ঞানের জগতে সুপ্রতিষ্ঠিত।
পরিশেষঃ পরিশেষ বলা যায় যে, অগাস্ট কোঁৎ-এর সমাজ সম্পর্কিত চিন্তা ও তত্ত্ব সমাজবিজ্ঞানের জন্ম ও বিকাশের ক্ষেত্রে ভিত্তিস্থাপক হিসেবে বিবেচিত। যদিও সমাজ গবেষণার ক্ষেত্রে তার গৃহীত সকল পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়নি, তবুও তিনি সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে আছেন। তার সৃষ্ট এবং গতি দান করা একটি শাখা সার্বিক বিকাশ লাভ করে আজ জ্ঞানের রাজ্যে একটি স্বতন্ত্র শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। তাই আমরা বলতে পারি, একটি স্বতন্ত্র বিজ্ঞান হিসেবে সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তি ও বিকাশের ক্ষেত্রে অগাস্ট কোঁৎ-এর অবদান অপরিসীম।