মুদালিয়র কমিশন বা মাধ্যমিক শিক্ষা কমিশন (১৯৫২-৫৩ খ্রি.) মাধ্যমিক শিক্ষার সংগঠন, পুনর্গঠন এবং শিক্ষার সময়কাল সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করেছিল। কমিশন মন্তব্য করেছিল যে, বিদ্যালয় স্তরে মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করার পর যেসব শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের শিক্ষা গ্রহণ করতে আসে, তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা হয় নিম্নমানের এবং তাদের বয়সও থাকে কম। তাই তারা যাতে বাস্তব জীবনের দায়িত্ব গ্রহণে সক্ষম হয় এবং বৃত্তি শিক্ষার জ্ঞান অর্জনে সমর্থ হয়, সেদিকে লক্ষ্য রেখে মুদালিয়র কমিশন তার শিক্ষা কাঠামোগত সুপারিশ গুলি পেশ করেছিল। মাধ্যমিক শিক্ষার সাংগঠনিক রূপ দেওয়ার সময় কমিশন প্রাথমিক ও উচ্চ শিক্ষার মধ্যে সমন্বয় সাধনের কথা বলে। মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরের গুরুত্ব বিবেচনা করে কমিশন সাধারণ শিক্ষার কাঠামো নির্ধারণে নিম্নলিখিত সুপারিশ গুলি করে।

(১) বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান উন্নয়নের স্বার্থে এবং জাতীয় স্তরে বৃত্তিমূলক চাহিদা পরিতৃপ্তির উদ্দেশ্যে কমিশন মাধ্যমিক শিক্ষার সময়কাল বিস্তৃত করার সুপারিশ করে এবং এর ফলে বিদ্যালয় শিক্ষার সম্পূর্ণ সময়কাল হয় ১২ বছরের।

(২) পরবর্তীকালে কমিশন বিদ্যালয় শিক্ষার সময়কাল স্থির করে ১১ বছরের জন্য এবং একে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করে। যথা— প্রাথমিক শিক্ষা বা নিম্ন বুনিয়াদী শিক্ষা (৫ বছরের), উচ্চ বুনিয়াদি শিক্ষা বা নিম্নমাধ্যমিক শিক্ষা (৩ বছরের) এবং উচ্চতর মাধ্যমিক শিক্ষা (৩ বছরের)।

(৩) উপরোক্ত ১১ বছরের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হওয়ার পূর্বে প্রচলিত মাধ্যমিক শিক্ষা কাঠামোর অন্তর্গত ২ বছরের ইন্টারমিডিয়েট স্তর কমিশন এক-এক বছরে(১+১) ভেঙে প্রথম বর্ষে মাধ্যমিক স্তরের সঙ্গে যুক্ত করেছে এবং দ্বিতীয় বর্ষটিকে প্রচলিত স্নাতক স্তরের (২বছরের) সঙ্গে যুক্ত করে স্নাতক স্তরের শিক্ষাকে তিনটি বছরে ব্যাপৃত করেছে। অর্থাৎ, মুদালিয়র কমিশন কর্তৃক প্রস্তাবিত মাধ্যমিক শিক্ষার সংগঠনটি হয় এইরূপ— ৫+৩+৩=১১ বছর।

(৪) কমিশন সমস্ত দশম শ্রেণির বিদ্যালয়গুলো একাদশ শ্রেণি যুক্ত না হওয়া পর্যন্ত দশম শ্রেণির পর এক বছরের প্রাক্-বিশ্ববিদ্যালয় কোর্সের (Pre-University Course) সুপারিশ করে। বলা হয়, দশম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর এক বছরের প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় বা PU স্তরে অধ্যয়ন করে তবে শিক্ষার্থীরা তিন বছরের স্নাতক স্তরে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবে। ফলে মাধ্যমিক শিক্ষার কাঠামোটি হল নিম্নরূপ :

(৫) বৃত্তি বা পেশাগত শিক্ষার কলেজগুলিতে এক বছরের প্রাক্‌-বৃত্তিমূলক কোর্স চালু করতে হবে।

(৬) শিক্ষার্থীরা যাতে নিজেদের পছন্দ, আগ্রহ ও সামর্থ্য অনুযায়ী শিক্ষা লাভের সুযোগ পায়, তার জন্য বহুমুখী বিদ্যালয় (Multipurpose School) স্থাপন করতে হবে।

(৭) বহুমুখী বিদ্যালয়গুলির সঙ্গে কারিগরি বিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে। শিল্পসমৃদ্ধ এলাকায় পলিটেকনিক অথবা প্রযুক্তি শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলি স্থাপন করতে হবে।

(৮) কমিশন প্রতিটি রাজ্য সরকারকে গ্রামীণ বিদ্যালয় স্থাপনের পরামর্শ দেয়। এ ছাড়া মহাবিদ্যালয় গুলিতে কৃষিবিদ্যা, পশু পালন, কুটির শিল্প প্রভৃতি বিষয়ে শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করার জন্য সুপারিশ করে।

(৯) মাধ্যমিক শিক্ষার কোর্স নির্ধারণ, পাঠ্যসূচি সংগঠন ইত্যাদি ক্ষেত্রে All India Council of Technical Education (AICTE)-এর মতো সংস্থা গুলোর সহযোগিতা নেওয়ার কথা বলেছেন কমিশন। এই শিক্ষার ব্যয়সংকুলানের জন্য কমিশন শিল্প শিক্ষা কর বসানোর কথা বলেছে।

(১০) শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীদের জন্য উপযুক্ত সংখ্যক বিদ্যালয় স্থাপনের সুপারিশ করা হয়।

(১১) মেয়েদের জন্য পৃথক বিদ্যালয় ও প্রয়োজনে তাদের উপযুক্ত পাঠ্য বিষয় পড়ানোর ব্যবস্থা করার কথা বলেছে। যেমন— গার্হস্থ্য বিজ্ঞান, সংগীত, শিল্পকলা ইত্যাদি।

(১২) যেসব ব্যক্তি বদলির চাকরি করেন তাদের জন্য গ্রামাঞ্চলে আবাসিক বিদ্যালয় গড়ে তুলতে হবে।

(১৩) কিছু কিছু আংশিক দিবা বিদ্যালয় গড়ে তােলার সুপারিশ করে, যেখানে শিক্ষার্থীরা সকাল আটটা থেকে সন্ধে পর্যন্ত কাটাবে। বিদ্যালয়গুলিতে দিনের খাবারের ব্যবস্থা থাকবে।

(১৪) ছেলেমেয়ে উভয়েই যাতে সমান সুযোগ পায় তার জন্য সহশিক্ষা স্কুলের সুপারিশ করেছে সুবিধা থাকবে। যেখানে মেয়েদের উপযুক্ত সুযোগ সুবিধা থাকবে।

(১৫) ৬-১৪ বছরের সম্পূর্ণ সময়ের শিক্ষা যারা শেষ না করেই পড়া ছেড়ে দিয়েছে তাদের জন্য আংশিক সময়ের শিক্ষার বিশেষ বিদ্যালয়ের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। বিকেলে এই ধরনের শিক্ষার ব্যবস্থা থাকবে। এই শিক্ষা হবে অবৈতনিক ও স্থানীয় বিদ্যালয় কর্তৃক পরিচালিত।

(১৬) বাস্তবের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পাবলিক স্কুল স্থাপনের পরামর্শ দিয়েছে। বিদ্যালয়গুলো হবে স্বাবলম্বী। সরকারি অনুদান এই স্কুলগুলি থেকে ধীরে ধীরে কমিয়ে আনতে হবে। এই বিদ্যালয়গুলির শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষণ পদ্ধতি প্রচলিত বিদ্যালয় থেকে পৃথক হবে। মেধাসম্পন্ন শিক্ষার্থীরা এখানে পড়ার সুযোগ পাবে এবং তাদের সরকারি বৃত্তির ব্যবস্থা থাকবে।

(১৭) উচ্চতর মাধ্যমিক স্তর বা নবম দশম শ্রেণিতে কোর বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হবে তবে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে ঐচ্ছিক বিষয়ের উপর গুরুত্ব দেওয়া হবে।

কাঠামো সংক্রান্ত সুপারিশ গুলি পরবর্তীকালে বিভিন্ন প্রাদেশিক সরকার আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করেছিল।

Rate this post