বাংলা রচনা : মাতৃভাষায় শিক্ষা


মাতৃভাষায় শিক্ষা
অথবা, মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান

[সংকেত : ভূমিকা; শিক্ষার ভাষা হিসেবে মাতৃভাষা; আমাদের মাতৃভাষার অতীত ও বর্তমান; শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা চালু; বাংলা ভাষার পূর্ণ মর্যাদালাভ; উপসংহার ।]

ভূমিকা : ‘যতদিন না শিক্ষিত প্রাণবন্ত বাঙ্গালিরা বাঙ্গলা ভাষায় আপন উক্তি সকল বিন্যস্ত করিবেন ততদিন বাঙ্গালির উন্নতির কোনাে সম্ভাবনা নাই।’ ১২৭৯ বঙ্গাব্দে সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের এই উক্তিকে সামনে রেখে আজকে ১৪২৭ বঙ্গাব্দে আমাদের বলতে হয়, যতদিন পর্যন্ত শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষা বাংলা সর্বস্তরে চালু না হবে ততদিন পর্যন্ত বাংলা এবং বাঙালির উন্নতির শিখরে আরােহণ করার সম্ভাবনা নেই। কেননা মা, মাতৃভূমি এবং মাতৃভাষা একই সূত্রে গাঁথা । মানবজীবনে এর কোনােটারই বিকল্প নেই। কোনােটাই অবহেলার নয়। যারা বাংলা ভাষাকে আন্তরিকভাবে মূল্যায়ন করে না, তাদের উদ্দেশ্যে সতেরাে শতকের কবি আব্দুল হাকিম বলেছেন—

যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।
সে সবে কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি ॥
দেশি ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায় ।
নিজ দেশ তেয়াগি কেন বিদেশ ন যায় ॥ 


শিক্ষার ভাষা হিসেবে মাতৃভাষা : মায়ের সঙ্গে যেমন আমাদের নাড়ির যােগ তেমনি মাতৃভাষার সঙ্গে আমাদের প্রাণের যোেগ। জন্মের পর মানবসন্তান প্রথম যে বুলি আওড়ায় তা মায়ের বুলি; প্রথম যে কথা কয় তা মায়ের কথা। সুতরাং মায়ের কথা, মায়ের ভাষা আমাদের প্রাণের ভাষা। অতএব, এ ভাষা আমাদের অস্তিত্বের, আমাদের গর্বের। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। বাংলা ভাষার। প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি অক্ষর আমাদের প্রিয়। আমাদের জীবনের মতাে প্রিয় । আমরা প্রথম বিদ্যালয়ে গিয়ে এ ভাষার সাথেই পরিচিত। হই । এই ভাষায় কথা বলি, গান শুনি, ভাবের আদান-প্রদান করি । মাতৃভাষা ব্যতীত অন্য কোনাে ভাষা আমাদের মুক্ত বুদ্ধির এবং, মুক্ত চিন্তার দ্বার খুলে দিতে পারে না। আমাদের কথাবার্তার, ভয়-ভালােবাসার, চিন্তা-কল্পনার ভাষা বাংলা। এই মাতৃভাষা বাংলা। ব্যতীত আর কোনাে ভাষা কানের ভেতর দিয়ে মরমে পশিয়া পরান আকুল’ করে না। এই মাতৃভাষা ব্যতীত আর কোনাে ভাষার। ধ্বনির জন্য প্রবাসীর কান পিয়াসি থাকে না । পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালােচনা করলে দেখা যায়, মাতৃভাষার উন্নতি ব্যতীত, মাতৃভাষার। শিক্ষা ব্যতীত কোনাে জাতি কখনাে বড়াে হতে পারেনি । যতদিন পর্যন্ত জার্মানিতে জার্মান ভাষা প্রতিষ্ঠা পায়নি ততদিন পর্যন্ত। জার্মানির জাতীয় জীবনের বিকাশ হয়নি। কাজেই আমাদের বেলায়ও বলা যায়, যতদিন পর্যন্ত আমাদের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু না হবে, যতদিন পর্যন্ত বাংলায় জ্ঞান জিজ্ঞাসা চর্চা শুরু না হবে ততদিন পর্যন্ত বাঙালির জাতীয় জীবনে উন্নয়ন সম্ভব নয় । 

আমাদের মাতৃভাষার অতীত ও বর্তমান : বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছিল খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে। বাংলা ভাষার একমাত্র নিদর্শন। চর্যাপদ’-এর গীতিগুলাে ছিল বৌদ্ধ সহজিয়াদের সাধন পদ্ধতিমূলক গান । সেই প্রাচীন যুগ হতে শুরু করে, মধ্যযুগ পেরিয়ে, শত শত বছর অতিক্রম করে বাংলা ভাষা সাহিত্যের আধুনিক যুগে এসে পদার্পণ করলেও কখনাে রাজভাষার মর্যাদা পায়নি। হিন্দু আমলে সংস্কৃত এবং মুসলমান আমলে ফারসি ছিল রাজভাষা। বাংলা ভাষা যারা শিখতেন তারা অন্তরের তাগিদে শিখতেন । ধর্মের ছায়াতলে অর্থাৎ দেবদেবী এবং অবতারকে আশ্রয় করে তখনকার সাহিত্য রচিত হতাে। এমনি করে বাংলা ভাষা ধীরে ধীরে এগিয়ে এসেছে এবং মুসলমান আমলে বাংলা ভাষা রাজভাষার মর্যাদা না পেলেও রাজদরবারের পৃষ্ঠপােষকতা পেয়েছে। মুসলমান শাসকগণ বাংলা জয়ের পর যখন বুঝতে পারলেন, এদেশ ছেড়ে যাওয়ার দেশ নয়, এদেশ ভােগের জন্য, এদেশ জীবনের জন্য, এদেশ মরণের জন.. তখন থেকেই বাংলার পাঠান-বাদশাহগণ বাংলা এবং বাংলা ভাষাকে আদর করতে লাগলেন। যে ভাষা দেশের উচ্চ শ্রেণির অবজ্ঞাত ছিল সে ভাষা বাদশাহের দরবারে ঠাই পেল। বাদশাহের দেখাদেখি আমির-ওমরাহগণ বাংলাকে খাতির করতেন এবং তাদের দেখাদেখি সাধারণ মানুষও বাংলা ভাষাকে ভালােবাসল । এভাবে বাংলা ভাষা বিকশিত হলাে। হিন্দু-মুসলমান উভয়ে সমানভাবে বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চা শুরু করল। উনিশ শতকের পূর্ব পর্যন্ত ছিল কাব্য সাহিত্যের যুগ। গদ্য সাহিত্যের সূচনা হয় ইংরেজ আগমনের পর উনিশ শতকে। ইংরেজের আমলে ফারসির বদলে ইংরেজি হয় রাজভাষা। বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি বিশেষ মর্যাদার আসন পায় । ইংরেজি শেখা এবং জানা ছিল তখন গৌরবের । বাংলা ভাষা অবহেলিতই থেকে যায়। শুধু ভাষা শেখার জন্য কিছু সাহিত্য বিষয়ক পুস্তক এবং কিছু স্কুল শিশু পাঠ্যপুস্তক ছাড়া মাধ্যমিক পর্যায় থেকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাংলা ভাষা চর্চার কোনাে সুযােগ ছিল না। তবে পাশ্চাত্য সাহিত্যের সংস্পর্শে এসে বাংলা সাহিত্য নতুন রূপে বিকশিত হওয়ার সুযােগ পায় । 

শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা চালু : ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের পর মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষা চালু হয় । কিন্ত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির দাপট । ১৯৪৭-এর পর দেশ বিভাগােত্তর কালে পাকিস্তান সরকার উদুকে রাষ্ট্রভাষা করার। চক্রান্তে মেতে উঠলে এদেশের ছাত্র-জনতা এর প্রতিবাদে তীব্র বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি এদেশের অকুতােভয় দামাল ছাত্রসমাজের বুকের তাজা রক্তে রঞ্জিত হয় ঢাকার রাজপথ । রক্ত দিয়ে ছিনিয়ে আনে মায়ের ভাষা বাংলার মযাদা। 

বাংলা ভাষার পূর্ণ মর্যাদালাভ : একুশের চেতনায় পথ চলে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয় । এতদিন পর স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা পূর্ণ মর্যাদা পায়। আশির দশকে এরশাদ সরকারের আমলে অফিস-আদালতে বাংলা ভাষা ব্যবহার করার সরকারি নির্দেশ চালু হয়। কিন্তু ইংরেজি প্রেমিক কিছু আমলা, কর্মকর্তার কারণে তা সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হচ্ছে না। এ আরেক চক্রান্ত। তবে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা স্বীকৃতি লাভ করেছে। কিন্তু উচ্চশিক্ষার বিজ্ঞান শাখায় বাংলা এখনাে চালু হয়নি। উপযুক্ত পুস্তক বাংলা ভাষায় নেই বলে অজুহাত দেখিয়ে বাংলা ভাষাকে বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার জগৎ থেকে দূরে রাখতে চাচ্ছে। আমরা মনে করি, মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চা শুরু হলে গ্রন্থ রচনার পথও সুগম হবে। ইংরেজ বিজ্ঞানীদের রচিত গ্রন্থগুলাে বাংলায় অনুবাদ করলে এবং বাঙালি বিজ্ঞানীগণ মাতৃভাষায় গ্রন্থ রচনা করলেই এ সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। 

উপসংহার : আসলে ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। তবে চেষ্টা করতে হবে, চেষ্টা করা উচিত। কেননা সাধারণ শিক্ষা এবং বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষা চালু হলে বাংলা এবং বাঙালি জাতি জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে অভাবিত সাফল্য লাভ করবে নিঃসন্দেহে।

Rate this post