কিশোর অপরাধ

ইংরেজি ‘Juvenile Delinquency’-এর বাংলা দাপ্তরিক অর্থ ‘কিশাের অপরাধ। কিশাের অপরাধ বলতে বােঝায় অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশাের-কিশােরীদের দ্বারা সংঘটিত কোনাে অসামাজিক কার্যকলাপ। সাধারণত, যাদের বয়স ৯ বছর থেকে ১৬ বছরের মধ্যে তারাই কিশাের-কিশােরী নামে পরিচিত। সুতরাং, ৯ বছরের কম নয় এবং ১৬ বছরের বেশি নয় এমন সব বালক-বালিকাদের দ্বারা সমাজের প্রচলিত রীতিনীতি, আইন-কানুন, মূল্যবােধের পরিপন্থি কোনাে কাজ সংঘটিত হলে তাকে ‘কিশাের অপরাধ বলে। অর্থাৎ কিশােরকিশােরীরা সাধারণত লঘু ধরনের অপরাধ করে থাকে। তবে Crime and Juvenile Delinquency অর্থাৎ, অপরাধ ও কিশাের অপরাধের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। প্রাপ্তবয়স্করা সাধারণত সুচিন্তিতভাবে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করতে উদ্দেশ্যপ্রণােদিত হয়ে অপরাধমূলক কাজ করে থাকে। পক্ষান্তরে, অপ্রাপ্তবয়স্করা অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিণাম চিন্তা না করে পরিবেশ ও আবেগের বশবর্তী হয়ে অপরাধমূলক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু বর্তমানকালে অপ্রাপ্তবয়স্করাও অনেক গুরুতর অপরাধে জড়িয়ে পড়ায় অপরাধ ও কিশাের অপরাধের মাঝে পার্থক্য নির্ণয় করা অত্যন্ত দুরূহ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে আমাদের দেশে কিশাের অপরাধ একটি সামাজিক সমস্যা হিসাবে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল দেশ। আমাদের দেশের অধিকাংশ কিশাের-কিশােরী যথাযথভাবে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বিধায় তাদের ব্যক্তিত্ব ও মানসিকতার সুষ্ঠু বিকাশ সম্ভব হচ্ছে না; যা পর্যায়ক্রমে তাদের অপরাধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বাংলাদেশে বর্তমানে যে সকল কাজকে কিশাের অপরাধের লক্ষণ হিসাবে গণ্য করা হয়, সেগুলাে হলাে- পকেট মারা, পরীক্ষায় নকল করা, কারও বাড়িতে ঢিল ছােড়া, কারও গায়ে থুথু দেওয়া, মেয়েদের দেখে শিস দেওয়া, স্কুল থেকে পলায়ন, বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হওয়া, বিনা টিকেটে ভ্রমণ, অন্যের গাছের ফল খাওয়া, গুরুজনের সাথে বেয়াদবি করা, নেশা করা, মারপিট করা, ঘরের জিনিস চুরি করা, প্রতারণা করা, মিথ্যা বলা, পর্নোছবি দেখা, ইভটিজিং ইত্যাদি। বর্তমানে বাংলাদেশে কিশাের-অপরাধের মাত্রা অতীতের তুলনায় বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিশাের-অপরাধ কখনাে একক কোনাে কারণে সৃষ্টি হয় না। এর মূলে থাকে দৈহিক, মানসিক, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, নৈতিক, ভৌগােলিক, সাংস্কৃতিক প্রভৃতি উপদানের এক জটিল ও মিশ্র প্রক্রিয়া। বিশেষ করে যৌথ পরিবারের ভাঙন, সঙ্গ দোষ, দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা ও অজ্ঞতা, চিত্তবিনােদনের অভাব, ইন্টারনেটে সহজলভ্য পর্নো সাইটের প্রসার, আইন-শৃঙ্খলার দুর্বলতা, সংঘাতময় বিশৃঙ্খল রাজনৈতিক পরিবেশ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঋতুর প্রভাব, সহজলভ্য অস্ত্র, পিতা-মাতার মধ্যে কলহ বা ছাড়াছাড়ি, মাতা-পিতার আদর-স্নেহ থেকে বঞ্চিত হওয়াসহ সামঞ্জস্যহীন পারিবারিক আচরণ তথা অতি স্নেহ বা অতি শাসনের কারণে কিশােরকিশােরীরা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। তাই এসব দিক বিবেচনা করে রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার তথা আমাদের সকলের উচিত কিশাের-অপরাধ নিরসনকল্পে যথাযথ ও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা। কিশাের-অপরাধ সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করাসহ প্রতিরােধ ও সংশােধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে এই সমস্যা সমাধান করা সম্ভব।

Rate this post