বাংলা গদ্য সাহিত্যের উন্মেষ, প্রকাশ, বিকাশ ও প্রচারে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অবদান অপরিসীম। এ কলেজ থেকেই বাংলা গদ্যের প্রাথমিক নিদর্শন শুরু হয়েছে। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে কলকাতায় লালবাজারে প্রতিষ্ঠিত হয়। ৪ মে কলেজের প্রতিষ্ঠা দিবস হলেও ২৪ নভেম্বর থেকে কলেজের কাজ শুরু হয়েছিল।

লর্ডওয়েলেসলি ছিলেন তৎকালীন ভারতের গভর্নর জেনারেল। তিনি অনুভব করেছিলেন যে কোম্পানির দায়িত্বপূর্ণ ভার নিয়ে বিলেত থেকে যেসব সিভিলিয়ান কর্মচারী আসে, তাঁরা অধিকাংশ চৌদ্দ থেকে আঠারো বছরের নাবালক, স্বদেশে তাদের শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়নি, এদেশেও তার কোনো ব্যবস্থা ছিলোনা। তাই দেশীয় বাংলা ভাষায় শিক্ষা দিয়ে এ সকল সিভিলিয়ানদের উপযুক্ত করে তোলার জন্যই ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮০১ খ্রিষ্টাব্দে এ কলেজে বাংলা বিভাগ প্রবর্তিত হলে অধ্যক্ষ হিসেবে আসেন শ্রীরামপুরের পাদ্রী ও বাইবেলের অনুবাদক বাংলায় অভিজ্ঞ উইলিয়াম কেরী । তিনি তার অধীনস্থ দুইজন পণ্ডিত ও আরো ছয় জন সহযোগী পণ্ডিতদের সহযোগিতায় বাংলা গদ্য কলেজের পাঠোপযোগী পুস্তক রচনায় আত্মনিয়োগ করেন। তাঁদের প্রচেষ্টার ফলাফল দিয়েই বাংলা গদ্যের অনুশীলনে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ভূমিকা নিরূপণ করা হয়।

ওয়েলেসলি কিছু বিলাতী সিভিলিয়ানদের এ দেশীয় ভাষা, এদেশীয় সাহিত্য, ইতিহাস, ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞান প্রদানের জন্য ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ পর্বে ১৮০১-১৮১৫ পর্যন্ত সময়ে ৮ জন লেখক মোট ১৩টি বাংলা গদ্য পাঠ্যপুস্তক লিখেছিলেন।

উইলিয়াম কেরী ছিলেন এ কলেজের কর্ণধার। ১৮০১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা বিভাগ চালু হলে তিনি বিভাগীয় অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। ৫৪ বছর স্থায়ীকালের শেষের দিকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। তবে গদ্যের বিকাশে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের যুগ হিসেবে ১৮০১-১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সময়কে ধরা হয়।

এ কলেজে কয়েকজন কৃতি ব্যক্তিত্ব যোগদান করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে উইলিয়াম কেরী, রামরাম বসু, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার উল্লেখযোগ্য। এঁদের মেধা ও মনন বাংলা গদ্যের সূচনা ও বিকাশের পথকে সুগম করে। তাঁদের রচিত বিভিন্ন গ্রন্থের মাধ্যমে গদ্য বিকাশে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ভূমিকা চিহ্নিত। এরা ছাড়াও ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের আরো কয়েকজন লেখক মোট ১৩খানি বাংলা পুস্তক লিখেছেন। নিচে লেখকদের নাম ও রচিত পুস্তকের নাম প্রদান করা হলো:

১. উইলিয়াম কেরী – i. কথোপকথন (১৮০১)  ii. ইতিহাসমালা (১৮১২)

২. রামরাম বসু – i. রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র (১৮০১) ii. লিপিমালা (১৮০২)

৩. গোলোকনাথ শর্মা – i. হিতোপদেশ (১৮০২)

৪. মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার –  i. বত্রিশ সিংহাসন (১৮০২) ii. হিতোপদেশ (১৮০৮) iii. রাজাবলি (১৮০৮) iv. প্রবোধ চন্দ্রিকা (১৮০৩)

৫. তারিণীচরণ মিত্র – i. ওরিয়েন্টাল ফেবুলিস্ট (১৮০৩)

৬. রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায়  – i. মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্র (১৮০৫)

৭. চণ্ডীচরণ মুন্সী –  i. তোতা ইতিহাস (১৮০৫)

৮. হরপ্রসাদ রায় – i. পুরুষ পরীক্ষা (১৮১৫)

নিচে লেখকদের সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:

উইলিয়াম কেরী: ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সতেরো বছরের এই দীর্ঘ সময় কেরীর পরিচালনা এবং তার সহকারী তুখোড় পণ্ডিতদের নিরলস প্রচেষ্টায় বাংলা গদ্য ধীরে ধীরে উন্নতির পথে অগ্রসর হতে থাকে। উইলিয়াম কেরী ভারতের বহুভাষায় অগাধ পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন। বাংলা গদ্যের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কেরী কেবল বাংলাবিভাগ পরিচালনা করেননি, তিনি নিজেই নিরবচ্ছিন্নভাবে লিখেছেন। তাঁর দুটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয় “কথোপকথন” ও “ইতিহাসমালা”। “কথোপকথন” প্রকাশিত হয় ১৮০১ সালে। বাংলাদেশের বিভিন্ন শ্রেণির লোকের মুখের ভাষার একত্রীকরণের ফসল “কথোপকথন”। অবশ্য গ্রন্থটি নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। কেরীর রচনা কিনা তা নিয়ে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করতেন। তবে কেরীর নামে প্রকাশিত বলে এর সকল কৃতিত্ব কেরীরই প্রাপ্য। “কথোপকথন” গ্রন্থটি ছিল দ্বিভাষিক, এক পৃষ্ঠায় বাংলা, অপর পৃষ্ঠায় ইংরেজি।

উইলিয়াম কেরীর পরবর্তী গ্রন্থ “ইতিহাসমালা” এতে সংস্কৃত সাহিত্যের ঘনিষ্ঠ পরিচয় পাওয়া যায়। এদেশের প্রচলিত প্রায় দেড়শত গল্পের সমন্বয়ে “ইতিহাসমালা” ১৮১২ সালে মুদ্রিত হয়। কেরী পরিচ্ছন্ন ভাষাতে গল্পগুলোকে সরল ভঙ্গীতে উপস্থাপন করেন। গদ্য সাহিত্যের উদ্ভবে বা উত্তরণে “ইতিহাসমালা”র অবদান উল্লেখযোগ্য।

রামরাম বসু: রামরাম বসু হলেন প্রথম বাঙালি সাহিত্যিক, যার লিখিত বাংলা গদ্য সর্বপ্রথম মুদ্রিত হয়। বাংলা গদ্যের পুরোভাগে তার অরস্থানের জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন। কেরীর অনুরোধে তিনি ১৮০১ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে সহকারী পণ্ডিতরূপে যোগদান করেন। তাঁর রচিত দুইটি গ্রন্থ হলো:

একটি “রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র” এবং অন্যটি হলো “লিপিমালা”। “রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র” ১৮০১ খিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়। ফারসি থেকে উপকরণ সংগ্রহ করে রচিত হলেও বাংলা গদ্যে মৌলিক পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনার প্রথম সার্থক প্রয়াস এই বইটি। ১৮০২ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশ পায় “লিপিমালা”। এটা রামরাম বসুর একটি ভিন্নধর্মী কাল্পনিক পত্রগুচ্ছের সমষ্টি। পত্রাকারে লিখিত কতকগুলো পৌরাণিক, ঐতিহাসিক ও শাস্ত্রীয় বিষয় আছে এ গ্রন্থে। এ গ্রন্থে প্রথম বইয়ের মতো ফারসি শব্দের প্রতুলতা নেই, বরং এতে তৎকালীন প্রচলিত গদ্যরীতির ইংগিত পাওয়া যায়। রামরাম বসু রচিত গদ্যগ্রন্থ ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা বিভাগের গদ্যসাহিত্য প্রচলনের উদ্দেশ্যকে অনেকাংশে সফল ও সার্থক করেছে।

মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার: মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার শুধু অধ্যাপক পণ্ডিতই ছিলেন না, তিনি সে যুগের বহু জনহিতকর প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাঁর শাস্ত্রজ্ঞান ও পাণ্ডিত্যের খ্যাতি সে আমলে প্রবাদের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের লেখকগণের মধ্যে তিনি ছিলেন অধিক খ্যাতিসম্পন্ন। তিনি ছিলেন আরবি, ফারসি, সংস্কৃত ভাষার বিদগ্ধ পণ্ডিত। মার্শম্যানের মতো মিশনারী দল তার পায়ের কাছে বসে সংস্কৃত শিক্ষা গ্রহণ করতেন। তাঁর অসাধারণ পাণ্ডিত্যের কারণে মার্শম্যান তাকে ডক্টর জনসনের সঙ্গে তুলনা করেছেন। ১৮০১ থেকে ১৮১৬ পর্যন্ত এ কলেজে চাকরিরত ছিলেন এবং অধ্যাপনাকালে তিনি পাঁচটি বাংলা বই লিখেন। বইগুলো হলো “বত্রিশ সিংহাসন” (১৮০২) “বেদান্তচন্দ্রিকা” (১৮১৭) ও “প্রবোধচন্দ্রিকা” (১৮৩৩) ইত্যাদি। তাঁর রচিত বইয়ের মধ্যে অনুবাদ ও নিজস্ব সৃষ্টি গ্রন্থ আছে। তিনি অনুবাদ গুলোতে সংস্কৃত অনুসারী ও চলিতভাষা এ দুই রীতি প্রয়োগ করেছেন। তাঁর লেখায় সতেজ প্রকাশভঙ্গি এবং সরল শব্দবিন্যাস বাংলা গদ্য প্রসারের পথকে সুগম করেছিল।

গোলকনাথ শর্মা: গোলকনাথ শর্মা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের শিক্ষক না হয়েও মিশনারিদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। তাঁর রচিত “হিতোপদেশ” ১৮০১ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পাঠ্যপুস্তক রূপে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়। বইটি সংস্কৃত থেকে অনুবাদ হলেও কথ্যরীতির অনুসরণে গদ্যের প্রাঞ্জলতা প্রকাশ পেয়েছে।

চণ্ডীচরণ মুন্সী: চণ্ডীচরণ মুন্সীর “তোতা ইতিহাস” ১৮০৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়। তিনি বইটি ফারসি হতে অনুবাদ করেন। পাঠ্যপুস্তক হিসেবে রচিত এ গ্রন্থটি বাংলা গদ্যের বিকাশকে উজ্জ্বল করেছে।

রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায়: রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায়ের “মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্র” ১৮০৫ সালে রচিত। এ গ্রন্থে ইতিহাসের বিষয়বস্তু স্থান পেলেও কাহিনির ঐতিহাসিক মূল্য সামান্য। গ্রন্থটি বর্ণনামূলক সাধুভাষায় লেখা। বাক্য সরল ও সংক্ষিপ্ত।

হরপ্রসাদ রায়: হরপ্রসাদ রায়ের “পুরুষ পরীক্ষা” (১৮১৫) সংস্কৃত থেকে অনুবাদিত। গ্রন্থের রচনারীতি সরল ও প্রাসাদগুণ বিশিষ্ট। শিক্ষাপ্রদ উপদেশাত্মক গল্প সমষ্টি ছাড়া এই গ্রন্থখানার তেমন কোনো নতুনত্ব নেই।

উপসংহার: ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত অস্তিত্ব বজায় রাখলেও প্রথম পনেরো বছর শেষে বাংলা গদ্যের উপর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ তথা ইংরেজি মিশনারিদের প্রভাব স্তিমিত হয়ে আসে শুধু পাঠ্যপুস্তক রচনাতে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের লেখকগোষ্ঠি প্রচেষ্টা চালান। তবুও বাংলা গদ্যের পথিকৃৎ হিসেবে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ তথা কলেজের লেখকগোষ্ঠীর কথা সবিশেষে উল্লেখযোগ্য। তাঁরা কোনো মহৎ ও স্থায়ী সাহিত্য সৃষ্টি করতে সক্ষম না হলেও বাংলা গদ্যের রাজপথের পত্তন তাঁরাই করেন।

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।

Rate this post