প্রশ্নঃ মন্টেস্কুর ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির বৈশিষ্ট্যসমূহ সমালােচনাসহ আলােচনা কর।

অথবা, মন্টেস্কুর ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ তত্ত্বটি বিশ্লেষণ কর।

অথবা, মন্টেস্কুর ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রকৃতি উল্লেখ কর।

ভূমিকাঃ রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে যেসব মহামনীষী তাদের জ্ঞানের মহিমায় চির উজ্জ্বল হয়ে আছেন তার মধ্যে মন্টেস্কু অন্যতম। তিনি বাল্যকাল থেকে অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। মন্টেস্কু তার ‘The.Spirit of The Laws’ গ্রন্থে তৎকালীন ফরাসি স্বৈরাচারী সরকারের হাত থেকে স্বাধীনতা কিভাবে রক্ষা করা যায় তা উল্লেখ করেন। তিনি আইনের বিধান অনুযায়ী কাজ করাকে স্বাধীনতা বলেছেন। কিন্তু তার মতে, রাজনৈতিক স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য সরকার দরকার। এ সরকারের কাজ নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্যের জন্য ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি অবশ্যই প্রয়ােজন।

মন্টেস্কুর ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিঃ মন্টেস্কুর মতে, স্বাধীনতার পূর্ণ ব্যবহারের জন্য সত্যিকারের শক্তিশালী সরকার প্রয়ােজন, যা সরকারের বিভাগগুলাের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে। তার মতে, “In every form of government there are three sorts of power; the legislative, the executive in respect of the things, dependent on the law of nations and the executive in regard to the matters that depend on the civil law.” মন্টেস্কুর মতে, যেখানে ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ হয় নি, সেখানে স্বাধীনতার কোন মূল্য নেই। তাই তিনি। সরকারের তিনটি বিভাগকে আলাদা করার মাধ্যমে তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে নিয়ােজিত থাকতে বলেছেন এবং এক বিভাগ অন্য বিভাগের উপর কোন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। যদি করে তা হলে স্বাধীনতা বিপন্ন হয়ে পড়বে। তাই তিনি বলেছেন, “When the legislative and executive powers are united in the same person of body of magistrates there can be no liberty. Again there is no liberty if the judiciary power is not separated from the legislative and executive.”

সুতরাং ক্ষমতা যদি কোন একক ব্যক্তি বা গােষ্ঠীর হাতে থাকে তাহলে তা স্বৈরাচারী হয়ে পড়ে। যেমন হয়েছিল তৎকালীন ফ্রান্সে ও ইউরােপের অন্যান্য দেশে। এ অবস্থার বাস্তবদর্শনের ফলেই মন্টেঙ্কু ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণের কথা বলেছেন।

মন্টেস্কুর ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির বৈশিষ্ট্যসমূহঃ মন্টেস্কুর ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি পর্যালােচনা করলে নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নরূপ-

১. সরকারের তিনটি বিভাগ আইন, শাসন ও বিচার বিভাগের ক্ষমতা পৃথকভাবে প্রতিটি বিভাগের উপর ন্যস্ত থাকবে। এক বিভাগ অপর বিভাগের উপর হস্তক্ষেপ করবে না।

২. প্রতিটি বিভাগের ক্ষমতা ও কার্যাবলি সীমাবদ্ধ থাকবে এবং পৃথক ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ বা বিভাগ কর্তৃক ক্ষমতা ও কার্যাবলি আলাদা আলাদাভাবে সম্পাদিত হবে।

৩. প্রতিটি বিভাগ তার ক্ষমতা ও কার্যাবলি প্রয়ােগে চূড়ান্ত ক্ষমতা ভােগ করবে।

৪. প্রতিটি বিভাগ স্বতন্ত্র বিধায় এক বিভাগ অন্য বিভাগের ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করবে না এবং প্রত্যেক বিভাগ নিজ নিজ ক্ষমতা প্রয়ােগে স্বাধীন থাকবে।

সমালােচনাঃ মন্টেস্কুর প্রদত্ত ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি নানাভাবে সমালােচনার সম্মুখে পতিত হয়। যেমন- ১. ক্ষমতার পূর্ণ স্বতন্ত্রীকরণ অসম্ভবঃ ক্ষমতার পূর্ণ স্বতন্ত্রীকরণ কখনাে সম্ভব নয়। সরকারের তিনটি বিভাগ একে ‘অপরের সাহায্য ছাড়া চলতে পারে না। মানবদেহ থেকে যেমন- হাত, পা, মস্তক বাদ দিলে তা অচল তেমনি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষায় তিন বিভাগ আলাদা করা যায় না। মন্টেস্কু এটা উপেক্ষা করে গেছেন।

২. সরকারের বিভিন্ন বিভাগকে বিভক্তকরণ সম্ভব নয়ঃ জেঙ্কস এর মতে, মন্টেস্কু ক্ষমতাকে যে তিনটি ভাগে বিভক্ত করেছেন, তা ঠিক নয়। কারণ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা মূলত দুটি শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগ এবং বিচার বিভাগ মূলত শাসন বিভাগের অন্তর্ভুক্ত। উইলােবির মতে, মন্টেস্কু সরকারকে যে তিনটি বিভাগের কথা বলেছেন তাছাড়াও সরকারের আরাে দুটি বিভাগ রয়েছে। যথাঃ নির্বাচন কমিশন ও পাবলিক সার্ভিস কমিশন বিভাগ।

৩. ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি কাম্য নয়ঃ অনেকেই রাষ্ট্রকে জীবদেহের সঙ্গে তুলনা করেছেন। জীবদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেমন পরস্পরের সাথে রক্তমাংসের সাথে সম্পর্কিত, তেমনি রাষ্ট্রের বিভাগগুলােও তেমনি ঘনিষ্ঠভাবে পরস্পরের সাথে সম্পর্কযুক্ত। তাই ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি কাম্য নয়।

৪. দায়িত্বহীনতাঃ লাস্কি বলেন, “আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ যদি সম্পূর্ণ পৃথকভাবে কাজ করে, তাহলে প্রত্যেক বিভাগের দায়িত্বশীলতা সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হবে। ফলে বিভাগগুলাে পরস্পরের সঙ্গে সংঘাত সৃষ্টি হতে পারে।

৫. এ মতবাদ ভ্রান্ত ও অনৈতিকঃ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিকে অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ভ্রান্ত ও অনৈতিক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। মন্টেস্কু বলেছিলেন যে, ইংল্যান্ডের জনগণের ব্যক্তিস্বাধীনতা উপভােগের প্রধান কারণ হলাে সে দেশে ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ নীতি কার্যকরী হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তার কোন প্রয়ােগ লক্ষ্য করা যায় না।

৬. মন্টেস্কুর অভিমত অসম্পূর্ণঃ মন্টেস্কুর অভিমত ব্যক্ত করে বলেন যে, “ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ ব্যতীত ব্যক্তি রক্ষিত হতে পারে না।” কিন্তু তার এ অভিমত সম্পূর্ণ নয়। কারণ অনেক দেশেই ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়ােগ না থাকলেও ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষিত হচ্ছে।

৭. সরকারের বিভিন্ন বিভাগের ক্ষমতা সমান নয়ঃ আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকারের তিনটি বিভাগের ক্ষমতা কোনভাবেই সমান করে দেখা হয় না, কিংবা সমান করে চিন্তা করা সম্ভব নয়। সুতরাং সরকারের বিদ্যমান বিভাগগুলাের মধ্যে ক্ষমতা ও কার্যাবলি সমান না থাকার কারণে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ সম্ভব নয়।

৮. অচলাবস্থা সৃষ্টিঃ মিল বলেছেন, ক্ষমতা যদি পূর্ণ স্বতন্ত্রীকরণ করা হয়, তাহলে এক বিভাগ অন্য বিভাগকে সাহায্য করে না। তাই অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়।

৯. ফাইনারের অভিমতঃ ফাইনার বলেছেন, পরিপূর্ণ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি প্রয়ােগ করলে সরকার কখনাে মূৰ্ছিত হবে, কখনাে হাত পা ছুড়তে থাকবে।

১০. কর্মক্ষমতা হ্রাসঃ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির যথাযথ প্রয়ােগ করলে সরকারের বিদ্যমান বিভাগগুলাের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এর ফলে পারস্পরিক সহযােগিতা ও কর্মক্ষমতা হ্রাস পাবে, যা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা সৃষ্টি করবে।

উপসংহারঃ উপযুক্ত আলােচনা শেষে বলা যায় যে, মন্টেস্কু আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রবক্তা হিসেবে অধিক খ্যাত। তার এ নীতি প্রশংসার দাবিদার, বিশেষ করে ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষার ক্ষেত্রে। ইংল্যান্ডের আইন বিশারদ Block Stone তার ‘Commentaries on the Laws of Englands’ গ্রন্থে বলেছেন, “যেখানেই আইন তৈরি করবার ক্ষমতা ও তা বাস্তবায়নের ক্ষমতা একই ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের হাতে ন্যস্ত থাকে, সেখানে জনসাধারণের অধিকার থাকতে পারে না।

Rate this post