প্রশ্নঃ বস্তুগত সংস্কৃতির উন্নতির ফলে কীভাবে সাংস্কৃতিক ব্যবধান সৃষ্টি হয়? অগবার্নের তত্ত্বের আলােকে আলােচনা কর।

অথবা, বস্তুগত সংস্কৃতির উন্নতির ফলে কীভাবে সাংস্কৃতিক ব্যবধান সৃষ্টি হয়। অগবানের তত্ত্বের আলােকে বর্ণনা কর।

ভূমিকাঃ মানুষের সৃষ্টির সমষ্টিই হলাে সংস্কৃতি। আবার বলা হয়, ‘Culture is the way of life.’ তাই মানুষের বিভিন্ন সৃষ্টি ও জীবনপদ্ধতির ভিন্নতা সংস্কৃতিকে বিভিন্ন অংশে বিভক্ত করেছে। একটি সমাজের জীবন ও জীবনযাপন প্রণালির সমন্বিত ধরনই সংস্কৃতি। সংস্কৃতির প্রধান দুটি রূপই হলাে বস্তুগত সংস্কৃতি ও অবস্তুগত সংস্কৃতি। মানুষের জীবনের সাথে সংস্কৃতির এ দুটি ধারা ওতপ্রােতভাবে জড়িত। তা ছাড়াও সংস্কৃতির একটি অংশ অন্য অংশকে প্রভাবিত করে।

সাংস্কৃতিক ব্যবধানঃ মানুষের জীবনধারণের পদ্ধতিই হলাে সংস্কৃতি। বিশ্ব প্রকৃতির মাঝে মানুষ জন্ম লাভের পর তাকে বিভিন্ন সময়ে অনেক প্রতিকূল অবস্থা এবং নানাবিধ চ্যালেঞ্জ বা বাধা বিপত্তির মুখােমুখী হতে হয়েছে। এসব পরিস্থিতি মােকাবিলা করতে গিয়ে মানুষ অনেক কিছু চিন্তাভাবনা করেছে এবং অনেক কিছু উদ্ভাবন করেছে। কিন্তু সমাজভেদে এ উন্নয়ন ধারার মধ্যে পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। আমরা যেকোনাে সমাজের দিকে তাকালে দেখতে পাই যে, প্রতিটি সমাজে বসবাসকারী মানুষের খাদ্যাভ্যাস ও খাদ্যগ্রহণ রীতি, আচার-অনুষ্ঠান, চিন্তাধারা পােশাক-পরিচ্ছদ ও মূল্যবোেধ, জীবনদর্শন ও উৎপাদন রীতিতে সাদৃশ্য রয়েছে। আবার একটি নির্দিষ্ট সমাজের মানুষের আহার-বিহার, চিন্তাধারা। ও আচার অনুষ্ঠানের সাথে অন্য সমাজের পার্থক্য রয়েছে। এ অবস্থায় সাংস্কৃতিক বিকাশের ক্ষেত্রে সমাজের সব অংশে সমানভাবে এর প্রভাব পড়ে না। কোনাে অংশ সংস্কৃতির বিকাশের ধারার সাথে এগিয়ে যায় কোনােটি পিছিয়ে পড়ে। সংস্কৃতির এ অসম অগ্রগতির ফলে একটা ব্যবধান সৃষ্টি হয়। এ বিষয়টি ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে, উইলিয়াম এফ. অগবান তার ‘Social Change’ গ্রন্থে একটি তত্ত্ব উপস্থাপন করেন, যা সাংস্কৃতিক দীর্ঘসূত্রিতার তত্ত্ব নামে পরিচিত।

সাংস্কৃতিক ব্যবধানের সৃষ্টিঃ সংস্কৃতির প্রধান দুটি ধারা হলাে বস্তুগত সংস্কৃতি ও অবস্তুগত সংস্কৃতি।


Figure: W.R Ogburn’s cultural unequal theory.

মানুষের সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও ব্যাপক পরিবর্ধন, পরিমার্জন ও পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু বস্তুগত সংস্কৃতির উন্নতির সাথে তাল মিলিয়ে অবস্তুগত সংস্কৃতি এগিয়ে যেতে পারে না। ফলে উভয় ধারার মধ্যে একটি ব্যবধান সৃষ্টি হয়। বস্তুগত সংস্কৃতি যে গতি ও হারে বৃদ্ধি পায় বা এগিয়ে চলে অবস্তুগত সংস্কৃতি সে তুলনায় অনেক ধীরগতিতে এগিয়ে চলে। ফলে উভয় সংস্কৃতির মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি হয়। নিম্নে অগবানের তত্ত্বের আলােকে সাংস্কৃতিক ব্যবধান আলােচনা করা হলাে।

অগবার্ন বলেন, আধুনিক সংস্কৃতির বিভিন্ন অংশ একই গতিতে পরিবর্তিত হচ্ছে না। সংস্কৃতির কোনাে কোনাে অংশ অন্য অংশ থেকে দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। যেহেতু সংস্কৃতির বিভিন্ন অংশের মধ্যে রয়েছে সুসম্পর্ক ও পারস্পরিক নির্ভরশীলতা, তাই একটি অংশের পরিবর্তনের সাথে সাথে অন্য অংশকে তার সাথে খাপখাইয়ে নেয়ার জন্য পরিবর্তনের প্রয়ােজন পড়ে। তিনি বলেন যে, সংস্কৃতির যে দিকটি স্বাধীনভাবে দ্রুত পরিবর্তিত হয়, সেটার সাথে তাল মিলিয়ে সংস্কৃতির অন্য অংশের মধ্যে পরিবর্তন আনার কাজটি ধীর বা বিলম্বে সংঘটিত হয়। এর ফলে সংস্কৃতির দ্রুত পরিবর্তনশীল এবং মন্থর পরিবর্তনশীল অংশের মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি হয়, যা গােটা সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করে।

অগবার্ন বলেন, যান্ত্রিক আবিষ্কার ও প্রযুক্তিগত উন্নতির ফলে সংস্কৃতির বস্তুগত উপাদানের ক্ষেত্রে যত দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে, অবস্তুগত উপাদান তথা মানুষের চিন্তাধারা, চাল-চলন ও আচার-অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে তত দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে না। এতে করে বস্তুগত সংস্কৃতির সাথে অবস্তুগত সংস্কৃতির একটি ব্যবধান সৃষ্টি হচ্ছে- যাকে ‘সাংস্কৃতিক ব্যবধান’ বলা হয়।

১৯৫৩ সালে অগবার্ন ও নিমকফ তাদের ‘A Hand Book of Sociology’ নামক গ্রন্থে সংস্কৃতির ব্যবধানের সংজ্ঞায় বলেন ‘The strain that co-exists between two co-related parts of culture that change at unequal rates of speed.’ অর্থাৎ কোনাে সংস্কৃতির অসমগতিতে চলমান দু’টি অংশের মধ্যে বিদ্যমান Strain (চাপ, প্রবল আকর্ষণ) হলাে সাংস্কৃতিক ব্যবধান। সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে একটি পারস্পরিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকে যা সমাজের ভারসাম্য ও স্বাভাবিক গতিকে ত্বরান্বিত করে। অংশগুলাে যদি আনুপাতিক হারে পরিবর্তিত না হয় তাহলে ভারসাম্য রক্ষিত হয় না। ফলে সৃষ্টি হয় সাংস্কৃতিক ব্যবধান।

সমালােচনাঃ মােটামুটিভঅবে সমাজবিজ্ঞানীরা অগবার্নের এ মতবাদেক গ্রহন করে নিলেও কিছু কিছু সমাজবিজ্ঞানী মনে করেন যে, আবিস্কার ও উদ্ভাবনের ফলে সংস্কৃতির অবস্তুগত উপাদান সবসময় পরিবর্তিত হয় না। নিচে বিভিন্ন তাত্ত্বিকের সমালােচনা উল্লেখ করা হলাে-

প্রথমত, বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী এস.সি. গিলফি মনে করেন যে, সামাজিক পরিবর্তন প্রকৃতপক্ষে বহুবিধ জটিল উপাদানের ফলশ্রুতি। অতএব সেখান থেকে বিশেষ কোনাে উপাদানকে প্রধানরূপে চিহ্নিত করা বাস্তবিকই অসম্ভব।

দ্বিতীয়ত, সমাজবিজ্ঞানী সিমস গিলফিনারের বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করে বলেন যে, সামাজিক ও প্রযুক্তিগত উপাদানের প্রাধান্য নির্ণয় অনেক ক্ষেত্রে কঠিন হলেও বহুক্ষেত্রে প্রযুক্তির উপাদানের প্রাধান্য এতই সুস্পষ্ট যে তা প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না।

তৃতীয়ত, মার্কসীয় ধারণার সাথে সাংস্কৃতিক ব্যবধান তত্ত্বের মিল রয়েছে। কেননা মার্কসীয় ধারণায় বলা হয়েছে যে, উৎপাদন কৌশলে পরিবর্তন আসলে তা ক্রমে উৎপাদন সম্পর্কেও পরিবর্তন আসে। উৎপাদন কৌশলের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে প্রয়ােজন হয় নতুন উৎপাদন সম্পর্কের, যা সমাজে ভারসাম্য এনে দেয়। তাই নতুন উৎপাদন সম্পর্ক সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত সেখানে সাংস্কৃতিক ব্যবধান পরিলক্ষিত হয়।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, সমাজ-সভ্যতা তার গতির ঘােড়ায় চড়ে এগিয়ে যাচ্ছে সম্মুখপানে। মানুষের সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও ব্যাপক উন্নতি ত্বরান্বিত হচ্ছে। বস্তুগত সংস্কৃতির দ্রুত উন্নতি ও প্রসারের ফলে সাংস্কৃতিক ব্যবধান সৃষ্টি হচ্ছে। তাই একটি সুস্থ, সাবলীল ও গতিশীল সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য সংস্কৃতির বিভিন্ন অংশ ও উপাদানের মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ বজায় থাকা বাঞ্ছনীয়।

Rate this post