বাংলাদেশের সংবিধানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিষয়ে কিছু বলা নেই। আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে বিধান ছিল, সেটিও ২০১১ সালে বাতিল করা হয়েছে।
তাহলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হবে কীভাবে? নতুন এই সরকার গঠিত হলে তার আইনি প্রক্রিয়াই-বা কী হবে?
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কেন?
মঙ্গলবার সংসদ ভেঙে দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। ফলে দেশ পরিচালনার জন্য যে ধরনের সাংবিধানিক সরকার কাঠামো দরকার হয়, সেটি এখন নেই।
সে কারণে সংসদ ভেঙে দিয়ে দ্রুত অন্তর্বর্তীকালীন একটি সরকার গঠনের তাগিদ দিচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হওয়ার বিষয়ে ইতোমধ্যেই তারা অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে কথা বলেছেন বলেও জানিয়েছেন এই সমন্বয়ক।
“ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গেও আমাদের কথা হয়েছে। তিনি ছাত্র-জনতার আহ্বানে বাংলাদেশকে রক্ষা করতে এই গুরু দায়িত্ব নিতে সম্মত হয়েছেন,” বলেন মি. নাহিদ ইসলাম।
সংবিধানে কী আছে?
বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানে ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’ নামে কোন ব্যবস্থার উল্লেখ নেই।
তবে কাছাকাছি ধরনের একটি ব্যবস্থার কথা আগে বলা ছিল, যেটি ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ ব্যবস্থা নামে পরিচিত।
সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান ও ক্ষমতা হস্তান্তরের লক্ষ্যে ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
পরবর্তীতে এই পদ্ধতি অনুসরণ করেই তিনটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
কিন্তু ২০১১ সালে এই ব্যবস্থা বাতিল করে সংবিধান সংশোধন করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার।
বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী, নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ক্ষমতায় থাকা সরকারের অধীনেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
এরপর ওই সরকারই বিজয়ী রাজনৈতিক দল বা জোটের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।
কিন্তু নির্বাচন ছাড়াই হুট করে সরকারের পতন ঘটায় বর্তমানে দেশে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, সেটি বিবেচনায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের দাবি উঠেছে।
“অথচ এ ব্যাপারে সংবিধানে কিছুই বলা নেই,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক।
মূলতঃ সে কারণেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ঘিরে আইনগত এক ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে।
কোন উপায় আছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের?
এখন সংবিধানে উল্লেখ না থাকলেও প্রয়োজনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা যেতে পারে কি? কোন উপায় কি আছে?
“বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, এককভাবে সংসদ বিলুপ্ত করার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির নাই,” বলেন আইনজীবী শাহদীন মালিক।
তিনি আরও বলেন, “সংবিধানের ৭২ অনুচ্ছেদে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রীর লিখিত পরামর্শ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি সংসদের অধিবেশন আহ্বান, সমাপ্তি এবং সংসদ বিলুপ্তি করবেন।”
সংবিধানের ৭২ অনুচ্ছেদের এক নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, “সরকারী বিজ্ঞপ্তি দ্বারা রাষ্ট্রপতি সংসদ আহ্বান, স্থগিত ও ভঙ্গ করিবেন….তবে আরও শর্ত থাকে যে, এই দফার অধীন তাহার দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক লিখিতভাবে প্রদত্ত পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন।”
কিন্তু নির্বাহী আদেশে ইতোমধ্যেই সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। সেক্ষেত্রে এখন কী করার আছে?
“পোস্ট ভ্যালিডিটি দিয়ে ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’ গঠন করা যাবে,” বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল।
উদ্ভূত পরিস্থিতি বিবেচনায় বিশেষ ক্ষমতাবলে কোন পদক্ষেপ নেওয়ার পর সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে পরবর্তীতে সেটির বৈধতা দেওয়াকে আইনের ভাষায় ‘পোস্ট ভ্যালিডিটি’ বা দায়মুক্তি বলা হয়ে থাকে।
১৯৭৫ সালের ১৫ই অগাস্টের পর গৃহিত সামরিক শাসনের সব কর্মকাণ্ডকে ১৯৭৯ সালে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বৈধতা দেয়া হয়েছিল।
একইভাবে, ১৯৮৮ সালে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে বৈধতা দেওয়া হয়েছিলে আরেক সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের যাবতীয় কর্মকাণ্ডকে। যদিও সামরিক শাসনের বৈধতা দেয়ার পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনীকে ২০১০ সালে অবৈধ ঘোষণা করে উচ্চ আদালত।
গণঅভ্যূত্থানে ১৯৯০ সালের ৬ই ডিসেম্বর জেনারেল এরশাদ সরকারের পতনের পর পঞ্চম সংসদের নির্বাচন পরিচালনার জন্য তিন মাসের অন্তর্বর্তীকালীন বা অস্থায়ী একটি সরকার গঠন করা হয়েছিল।
সে সময় আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিসহ আন্দোলনকারী সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে সেই অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়েছিল।
সেজন্য বিচারপতি আহমদকে প্রথমে উপরাষ্ট্রপতি হিসাবে দায়িত্ব দেয়া হয় এবং এরপর তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন।
এছাড়া তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসাবে দায়িত্ব পালনের পর নির্বাচন শেষে প্রধান বিচারপতির পদে ফিরে গিয়েছিলেন।
এই দু’টি বিষয়ে বৈধতা দেয়া হয়েছিল সংবিধানের একাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে।
উনিশ’শ একানব্বই সালে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত পঞ্চম সংসদে এই সংশোধনী পাস করা হয়।