প্রশ্নঃ ‘মধ্যযুগ ছিল মূলত অরাজনৈতিক, অবৈজ্ঞানিক ও অসৃজনশীল’- তুমি কী এ বক্তব্যর সাথে একমত? আলােচনা কর।

আথবা, ইউরােপের মধ্যযুগ ছিল মূলত অরাজনৈতিক, অবৈজ্ঞানিক ও অসৃজনশীল- তুমি কী এ বক্তব্যর সাথে একমত? উক্তিটি পরীক্ষা কর।

ভূমিকাঃ রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে মধ্যযুগের শুভ সূচনা ঠিক কখন থেকে তা নিশ্চিতভাবে বলা শক্ত। এ সম্পর্কে দু’ধরনের অভিমত প্রচলিত রয়েছে। এক শ্রেণীর মনীষীগণ মনে করেন যে, খৃষ্টান গির্জার পতনের সময় থেকেই মধ্যযুগের সূচনা। পক্ষান্তরে অপর শ্রেণীর মনীষীগণ মনে করেন যে, খৃষ্টান ধর্মের আবির্ভাবের ফলে রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে যে কিছু কিছু নতুন ভাবধারার সূত্রপাত ঘটে তা মধ্যযুগের আবির্ভাবকে সুগম করে। রাষ্ট্রদর্শনের ইতিহাসকে মােটামুটি তিনভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। যথা- (১) প্রাচীন যুগ (Ancient period), (২) মধ্যযুগ (Middle Age), (৩) আধুনিক যুগ (Modern Age)।

মধ্যযুগ (Middle Age): রাষ্ট্রদর্শনের ইতিহাসে কোন সময়কে মধ্যযুগ বলা যায় সে বিষয়ে যথেষ্ট মতভেদ থাকলেও মােটামুটিভাবে ইউরােপের ইতিহাসে ষাট শতাব্দী হতে ষােড়শ শতাব্দী কালকেই মধ্যযুগ বলা হয়। অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে ষাট শতাব্দীতে টিউটনিক উপজাতিদের হাতে পাশ্চাত্য রােম সাম্রাজ্যের পতনের সময় থেকে প্রকৃতপক্ষে মধ্যযুগের সূচনা এবং ষােড়শ শতাব্দীতে জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভব হওয়া পর্যন্ত তা বিস্তৃত।

মধ্যযুগ অরাজনৈতিক, অবৈজ্ঞানিক ও অসৃজনশীলঃ মূলত মধ্যযুগ ছিল অরাজনৈতিক, অবৈজ্ঞানিক ও অসৃজনশীল। নিম্নোক্ত বিষয়গুলাে আলােচনার মাধ্যমে এই বিষয় সম্পর্কে আরও স্পষ্ট ধারণা লাভ করা যেতে পারে।

(১) অরাজনৈতিক ও অসৃজনশীলঃ মধ্যযুগের প্রথম অংশে রাষ্ট্রচিন্তা কেবলমাত্র ধর্মীয় চিন্তা ভাবনার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ ছিল। এমনকি এ যুগের দ্বিতীয়ার্ধেও রাষ্ট্রচিন্তা সম্পূর্ণরূপে ধর্মীয় প্রভাবের বাইরে ছিল না। পার্থিব জগত ও রাজনৈতিক বিষয়াদীর ব্যাপারে মধ্যযুগ কখনাে মনােনিবেশ করেনি। দর্শন বা রাষ্ট্রচিন্তা সংক্রান্ত বিষয়াদী এ যুগের চিন্তাধারার অন্তর্ভুক্ত ছিল না।

(২) প্রচলিত মতবাদে বিশ্বাসীঃ মধ্যযুগে সাধারণত প্রচলিত ধ্যান-ধারণার অনুসরণ লক্ষ্য করা যায়। এই যুগে জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে গির্জার যাজকদের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। তারা প্রচলিত ধর্মীয় মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। পর্যবেক্ষণ, অনুসন্ধান বা পরীক্ষণের ওপর তাদের তেমন বিশ্বাস ছিল না। যাজকগণ আরােহ পদ্ধতির পরিবর্তে অবরােহ পদ্ধতিতে তাদের যুক্তি বিশ্লেষণ করতেন। তাদের অনুসিদ্ধান্তের উৎস ছিল সাধারণভাবে প্রচলিত কতকগুলি মতবাদ ও ধর্মীয় বিশ্বাস। ফলে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন ধর্মীয় গোঁড়ামীর আবর্তে নিক্ষিপ্ত হয়।

(৩) আধ্যাত্মিক ও পার্থিব সংঘর্ষঃ মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তা মূলত আধ্যাত্মিক ও পার্থিব সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়। রাজনৈতিক চিন্তা জগতে মধ্যযুগ ছিল সভ্যতা জীর্ণ করা যুগ। এ যুগে বিজ্ঞানের আশিস তেমনটা দেখা যায় না। অনেক চিন্তাবিদ বলেছেন, মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তায় রাষ্ট্রও ছিল না আর মুক্তচিন্তাও ছিল না। এ যুগে মূলত ইহকাল ও পার্থিব জগত নিয়ে নানা বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল। মূলত মধ্যযুগ ছিল অবৈজ্ঞানিক ও অসৃজনশীল।

(৪) সামন্তবাদী ধারণাঃ মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তায় সামন্তবাদী ধারণার বিকাশ ঘটে। সমগ্র মধ্যযুগে বিশ্বব্যাপী সামন্তপ্রথা প্রচলিত ছিল। এ প্রথার মূল বৈশিষ্ট্য হলাে ভূমিকেন্দ্রিক অর্থব্যবস্থা, ভূমিকেন্দ্রিক অধিকার, সুযােগ-সুবিধা ও পর্যায়ক্রমিক ক্ষমতার বিন্যাস প্রভৃতি। আধুনিক যুগে জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভবের পূর্ব পর্যন্ত সামন্তব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। মধ্যযুগে সামন্ত প্রভুদের অত্যাচার ও নিপীড়নে সৃজনশীলতা লােভ পায়। সামন্তবাদ বা সামন্তব্যবস্থা সমগ্র মধ্যযুগের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।

(৫) অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীন জীবনঃ বস্তুত রােম সাম্রাজ্যের পতনের ফলে পশ্চিম ইউরােপের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে যে বিরাট শূন্যতার সৃষ্ট হয় তা টিউটন বর্বরদের আদিম প্রাকৃতির গােত্রীয় সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার দ্বারা তা পূরণ করা একান্ত অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে মানুষের জীবনে নেমে আসে অব্যবস্থা, অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতা। ফলে সামগ্রিক জীবনে বিরাজ করে অসৃজনশীলতা ও পশ্চাৎপদতা। এ দূর্দিনে শূন্যতা পূরণের জন্য এগিয়ে আসে সামন্তবাদ। সামন্তবাদ সম্পূর্ণ নতুন প্রকৃতির কোন ব্যবস্থা নয় বরং তা রােমান সাম্রাজ্যের উত্তরণমূলক সমাজ ব্যবস্থা।

(৬) প্রশাসনিক দুর্বলতাঃ মধ্যযুগের রাষ্ট্রীয় কাঠামােয় প্রশাসনিক দুর্বলতা লক্ষ্য করা যায়। প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্বলতা দেখা দেয়। প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিশৃংখলা দেখা দেয়। ইউরােপের পশ্চিমাংশে দেখা যায় সাম্রাজ্যের মধ্যে জার্মানদের প্রশাসনিক দূর্বলতার কারণে সুষ্ঠু রাষ্ট্রচর্চার বিকাশ হয়নি। রাষ্ট্রদেহে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হয়। আর সঙ্গত কারণেই মধ্য যুগ ছিল অরাজনৈতিক ও অবৈজ্ঞানিক।

(৭) সনাতনী পুস্তকঃ মধ্যযুগে পুস্তকের বিরলতা রাজনীতিতে একটি অন্যতম বাধা হিসেবে দেখা যায়। দু’একটা পুস্তক যা প্রকাশিত হয় তাও প্রাচীন রচনার পুনরাবৃত্তি। মধ্যযুগে যে সমস্ত পুস্তক রচিত হয়েছে তা নিতান্তই ধর্মকেন্দ্রিক। পুস্তকের বিরলতা রাষ্ট্র চর্চার একান্ত ক্ষতিকারক হিসেবে দেখা দিয়েছে। সঙ্গত কারণে মধ্যযুগ আধুনিকতা তথা বিজ্ঞানের স্পর্শ পায়নি।

(৮) বিশ্বজনীনতাবাদঃ The note of all medieval thought is its Universalism. রােমান সাম্রাজ্য ভৌগােলিক সীমানাকে স্বীকার করেন। বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যকার পার্থক্য করে অখন্ড সম্রাজ্য স্থাপন করার কতিতু রােমান শাসকদের। সুতরাং রাজনীতির দিক থেকে বিশ্বজনীনতা দেখা দিয়েছিল বলে হার্নশ মনে করেন, এ যুগে উপরে লিখিত প্রবাদ বাক্যটি বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।

(৯) দুই ততবারী তত্ত্বঃ মধ্যযুগে সমান্তরালবাদ থেকে দুই তরবারী তত্ত্ব জন্ম নিয়েছে। ডানিং এর মন্তব্য থেকে তাই আমরা পাই, The Starting point is all medieval theorizing on politics was the dogma of the two powers. অর্থাৎ পার্থিব বিষয়ে শাসক ছিলেন রাজা আর অপার্থিব বিষয়ে শাসক ছিলেন পােপ। এটাই হলাে দুই তরবারীতত্ত্ব।

(১০) আইনে সার্বভৌমত্বঃ বর্তমানে আমরা যে আইনের শাসনের কথা বলছি তার সূত্রপাত মধ্যযুগেই হয়েছিল। মধ্যযুগের দার্শনিকগণ আইনের সার্বভৌমত্বের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। শুধুমাত্র জনগণই নয়, স্বয়ং শাসকও আইনের অধীনে ছিলেন।

(১১) নির্বাচন ব্যবস্থাঃ মধ্যযুগে প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ নির্বাচন এমনকি কোনাে কোনাে এলাকায় আঞ্চলিক স্বায়ত্ত্বশাসনের নমুনা লক্ষ্য করা যায়। যেমন- ব্রিটিশ কমন্সসভা কিংবা কাউন্টি কাউন্সিলের মতাে কিছু আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠান স্বায়ত্তশান ভােগ করতাে। সুতরাং দেখা যায়, নির্বাচন ব্যবস্থার মতাে রাজনৈতিক বিষয়গুলাে মধ্যযুগে বিদ্যমান ছিল।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, মধ্যযুগ ছিল অরাজনৈতিক, অবৈজ্ঞানিক ও অসৃজনশীল। এ যুগে রাষ্ট্রনীতি ছিল ন্যায়শাস্ত্র ও ধর্মতত্তের গহ্বরে বন্দী। মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তায় রাষ্ট্র ছিল না আর মুক্তচিন্তাও ছিল না। সুতরাং যুক্তিসিদ্ধ বিশ্লেষণে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় বলা যায় যে, ‘The Middle was unpolitical, unscientific; rudeness, neither political theory nor any ideological developed in the Middle Ages.

Rate this post