খেলাফত আন্দোলনের ইতিহাস


প্রশ্নঃ খেলাফত আন্দোলন বলতে কী বুঝ? ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে এর গুরত্ব নিরূপণ কর।

অথবা, খেলাফত আন্দোলনের ইতিহাস সংক্ষেপে আলোচনা কর।

ভূমিকাঃ ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের ক্রমবিকাশে খেলাফত আন্দোলন একটি যুগান্তকারী ঘটনা। মুসলমানদের পক্ষ থেকে ব্রিটিশ বেনিয়া গােষ্ঠীর বিরুদ্ধে এ আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল এ আন্দোলন। তাৎক্ষণিকভাবে সফলতা বয়ে না আনলেও এ আন্দোলনের ফলস্বরূপ ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা লাভ ত্বরান্বিত হয়।

ক. খেলাফত আন্দোলনের পরিচয়ঃ খেলাফত যে একটি প্রয়ােজনীয় প্রতিষ্ঠান এবং আল্লাহর হুকুমত প্রতিষ্ঠার একমাত্র মাধ্যম তা মুসলমান মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। এরই ফলে উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে উপমহাদেশের মুসলিম নেতৃবৃন্দের চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে Pan Islamism ভাবধারার প্রভাব প্রকাশ পায়। তারা ইসলামকে দেখেছেন একটি বিশ্বজনীন মতাদর্শ হিসেবে। কাজেই বিশ্বের সর্বত্র ইসলামী শক্তির জাগরণ তাদের কাম্য ছিল। এদিকে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক বঙ্গভঙ্গ রদ ঘােষণার মধ্য দিয়ে মুসলমানগণ বুঝতে পারে, এ সরকার কখনােই মুসলানদের পক্ষে নয়। ফলে তারা ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তােলেন। এ আন্দোলন তুরস্কের খেলাফত রক্ষা নামে পরিচালিত হয় বলে একে ‘খেলাফত আন্দোলন’ বলা হয়।

খ. খেলাফত আন্দোলনের পটভূমিঃ ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ইউরােপে যে মহাযুদ্ধ সংঘটিত হয়, ঐ যুদ্ধে তুরস্ক জার্মানির পক্ষে এবং ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স প্রভৃতি শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে। এ যুদ্ধে তুরস্ক ও জার্মানি পরাজিত হয়। উপমহাদেশে খেলাফত আন্দোলন তুরস্কের এ অবস্থা থেকেই আরম্ভ হয়।

গ. খেলাফত আন্দোলনের কারণঃ নিম্নে খেলাফত আন্দোলনের কারণসমূহ উল্লেখ করা হলো-

১. ইংরেজদের দমননীতিঃ ১৯১৪ সালে ইংরেজ ও জার্মানিদের মধ্যে প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে তুর্কি সরকার ইংল্যান্ডের চির শত্রু জার্মানিকে সমর্থন দেয়ায় পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করে। সে মুহর্তে ইংরেজরা ভারতীয়দের সমর্থন লাভের প্রত্যাশায় প্রতিশ্রুতি দেয়, যুদ্ধে ইংরেজরা জয় লাভ করলে খেলাফত ও ইসলামের মর্যাদা রক্ষা করা হবে, কিন্তু পরবর্তীতে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ ও বিশ্বাসঘাতকতার কারণে ইংরেজ বিরােধী আন্দোলন শুরু হয়। ফলে ইংরেজ সরকার কঠোর দমন নীতির মাধ্যমে মাওলানা মােহাম্মদ আলী ও শওকত আলীসহ অসংখ্য নেতা কর্মীকে যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কারাগারে বন্দি করে রাখে।

২. ত্রিপােলী আক্রমণঃ ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে ইতালি তুর্কি সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ত্রিপােলী অধিকার করলে ইংরেজ সরকার এটা সমর্থন করে। এতে উপমহাদেশের মুসলমানগণ দারুণভাবে মর্মাহত হয় এবং মুসলিম লীগের আহ্বানে ইতালির পণ্য বর্জন ও ত্রিপােলীর দুর্গতদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা হয়।

৩. তুর্কিদের প্রতি সহানুভূতিঃ তুর্কি সাম্রাজ্য বলকান যুদ্ধের ফলে বিপদগ্রস্ত হলে তুরস্কের সুলতান ইউরােপীয় শক্তিবর্গের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করে ব্যর্থ হন। মুসলমানগণ তুরস্কের এ বিপদে ব্যথিত হয়ে মাওলানা মুহাম্মদ আলী ও শওকত আলীর নেতৃত্বে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তােলে। কেননা মুসলমানরা অনুসরণ করতেন কবি সম্রাট আল্লামা ইকবালের অমর বাণীঃ

“আরব আমার ভারত আমার

চীনও আমার নয় গাে পর

বিশ্বজোড়া মুসলিম আমি।

সারাটি জাহানে বেঁধেছি ঘর।”

৪. স্যাভারস চুক্তিঃ স্যাভারস চুক্তিতে তুর্কিদের প্রতি যে কঠোর শর্ত চাপিয়ে দেয়া হয়, তাতে উপমহাদেশের মুসলমানদের ব্রিটিশ বিরােধী ক্ষোভ অধিকতর প্রজ্বলিত হয়ে ওঠে। তাদের এবারের আন্দোলন ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বুনিয়াদ পূর্ববর্তী আন্দোলনের তুলনায় অধিক মাত্রায় কাঁপিয়ে তােলে।

৫. রাওলাট আইনঃ ১৯১৯ সালে ইংরেজ সরকার রাওলাট নামক এক কালাে আইন পাস করে। এ আইনে যে কোনাে ব্যক্তিকে বিনা অপরাধে সাক্ষ্য প্রমাণ ছাড়াই গ্রেফতার ও দণ্ড দেয়ার ক্ষমতা পুলিশকে প্রদান করা হয়। এ আইনের ফলে সমগ্র ভারতবর্ষের জনগণ ইংরেজ শাসনের প্রতি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে।

ঘ. খেলাফত আন্দোলন সংগঠনঃ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্কের পরাজয় হলো মুসলমানগণ পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ইংরেজদের নিকট তুরস্কের সাথে ভালাে ব্যবহারের দাবি জানায়, কিন্তু ইংরেজরা তা প্রত্যাখ্যানপূর্বক তুর্কি সাম্রাজ্য নিজেদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ফলে মাওলানা মুহাম্মদ আলী, মাওলানা শওকত আলী ও মাওলানা আবুল কালাম আযাদের নেতৃত্বে ব্রিটিশ বেনিয়া গােষ্ঠীর বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন শুরু হয়। এ আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য ১৯১৯ সালে খেলাফত কমিটি গঠন করা হয়।

ঙ. খেলাফত আন্দোলনের বিস্তৃতিঃ করমচাঁদ গান্ধী কংগ্রেসের নেতৃত্ব গ্রহণ করলে খেলাফত আন্দোলন আরাে তীব্রতর হয়। ১৯২০ সালের ১ জুন কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ও খেলাফত কমিটি এলাহাবাদ সম্মেলনে মিলিত হয়ে ইংরেজ নীতির তীব্র নিন্দা করে। খেলাফত কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মাওলানা মুহাম্মদ আলী ইংরেজ প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জের সাথে সাক্ষাৎ করে দাবি জানান যাতে তুর্কি সাম্রাজ্যের কোনাে ক্ষতি না করা হয় এবং মক্কা মদিনা, জেরুজালেম, বাগদাদ যেন খলিফার অধীনে রাখা হয়। অবশেষে তার সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে ১৯২০ সালে অসহযােগ আন্দোলনের সূচনা হয়।

চ. খেলাফত আন্দোলনের ব্যর্থতাঃ নেতারা এ আন্দোলনকে গান্ধীর অসহযােগ আন্দোলনের সাথে একাকার করে ফেলায় খেলাফত আন্দোলন সাময়িকের জন্য সফলতা লাভে ব্যর্থ হয়। বিভিন্ন কারণে গান্ধী হঠাৎ অসহযােগ আন্দোলন প্রত্যাহার করলে খেলাফত আন্দোলন আরাে স্তিমিত হয়ে পড়ে।

ছ. খেলাফত আন্দোলনের ফলাফল/গুরুত্বঃ নিম্নে খেলাফত আন্দোলনের ফলাফল ও গুরুত্ব আলোচনা করা হলো-

১. হিন্দু মুসলিম ঐক্য ব্যাহতঃ খেলাফত আন্দোলন ভারতে হিন্দু মুসলিম ঐক্যের মূলে কুঠারাঘাত করে এবং সর্বভারতীয় পর্যায়ে হিন্দু মুসলমানের ঐক্যের সম্ভাবনা চিরদিনের মতাে তিরােহিত হয়।

২. সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উদ্ভবঃ খেলাফত ও অসহযােগ আন্দোলনের সমর্থকদের মতানৈক্যের ফলস্বরূপ হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উদ্ভব হয়।

৩. মুসলমানদের অগ্রগতি ব্যাহতঃ ঐতিহাসিক আর, সি, মজুমদার বলেন, খেলাফত আন্দোলনের ফলে মুসলমানদের উন্নতি অগ্রগতি ভীষণভাবে ব্যাহত হয়।

৪. রুদ্ররােষে পতিতঃ এ আন্দোলনের ফলে মুসলমানগণ ইংরেজদের রুদ্ররােষে পতিত হয়।

৫. নব উদ্দীপনা লাভঃ প্রায় দু’শ বছরের নির্যাতিত নিষ্পেষিত মুসলমানগণ এ আন্দোলনের ফলে নব উদ্দীপনা লাভ করে।

৬. রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধিঃ খেলাফত আন্দোলনের ফলে মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধি পায়।

৭. ইসলামী উম্মাহকেন্দ্রিক মনােভাব সৃষ্টিঃ খেলাফত আন্দোলন গােটা বিশ্বের মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার মনােভাব বিকশিত করে তােলে। ফলে ভারতের স্বাধীনতা ত্বরান্বিত হয়।

৮. গণআন্দোলনের পদ্ধতি শিক্ষাঃ ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার বলেন, খেলাফত আন্দোলনের অন্যতম সুদূরপ্রসারী ফল হলাে এ আন্দোলন মুসলমানদের গণআন্দোলন গড়ে তােলার নিয়ম কানুন শিক্ষা দেয়।

৯. দাবি আদায়ের চেতনা বৃদ্ধিঃ এ আন্দোলন মুসলমানদের বিপ্লবের মশাল ধারণ করে নিজেদের দাবি আদায়ে সচেতন করে তােলে।

১০. স্বাধীনতালাভের প্রেরণাঃ স্যার সলিমুল্লাহ বলেন, ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশে ও স্বাধীনতা আন্দোলন সুসংহতকরণে খেলাফত আন্দোলনের বিপুল প্রভাব অনস্বীকার্য।

১১. স্বাবলম্বী হওয়ার দীক্ষা লাভঃ আন্দোলনের ফলে মুসলমানরা স্বাবলম্বী হওয়ার দীক্ষা লাভ করে।

১২. পৃথক আবাসভূমির প্রয়ােজনীয়তাঃ এ আন্দোলনের ফলে খেলাফত আন্দোলনকারী নেতা-কর্মীরা তাদের জন্য পৃথক এলাকা ও আবাসভূমির প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করে। পরবর্তীতে দাবি আদায়ের জন্য পাকিস্তান আন্দোলন জোরদার করা হয়।

উপসংহারঃ ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসে খেলাফত আন্দোলন এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। এ আন্দোলনের মধ্যেই ভারতের স্বাধীনতার বীজ নিহিত ছিল। এ জন্যই তদানীন্তন হিন্দু নেতৃত্ব খেলাফত আন্দোলনে অন্তরায় সৃষ্টি করেনি।

Rate this post