প্রশ্নঃ অগবার্নের সাংস্কৃতির ‘অসম অগ্রগতি’ তত্ত্বটি পর্যালােচনা কর।

অথবা, অগবার্নের সাংস্কৃতিক পশ্চাদমুখী তত্ত্বটি আলােচনা কর।

ভূমিকাঃ সংস্কৃতি সভ্যতার বাহন। সমাজজীবনকে সার্থক ও সুন্দর করে গড়ে তুলে সংস্কৃতি মানবজীবনের ভিত্তি রচনা করে। আদিম সমাজ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সভ্যতার উৎপত্তি, বিকাশ ও উৎকর্ষসাধনে সংস্কৃতির অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে। মানুষের দীর্ঘদিনের লালিত জীবনপ্রণালী সংস্কৃতির গতিকে সচল রেখেছে। সংস্কৃতির পথপরিক্রমার মধ্যদিয়ে সভ্যতা বিকাশ লাভ করে।

সাংস্কৃতিক ব্যবধান তত্ত্বঃ সমাজবিজ্ঞানী অগবার্ন তার ১৯২২ সালে প্রকাশিত ‘Social change’ নামক গ্রন্থে ‘সাংস্কৃতিক ব্যবধান’ তত্ত্বটি প্রদান করেন। তত্ত্বটি বেশ সাড়া জাগায়। অগবার্ন সংস্কৃতির দুটি অংশ তথা বস্তুগত সংস্কৃতি ও অবস্তুগত সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করেই তার তত্ত্বটি দাঁড় করান।


অগবার্ন বলেন, আধুনিক সংস্কৃতির বিভিন্ন অংশ একই গতিতে পরিবর্তিত হচ্ছে না। সংস্কৃতির কোনাে কোনাে অংশ অন্যান্য অংশ থেকে দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। যেহেতু সংস্কৃতির বিভিন্ন অংশের মধ্যে রয়েছে একটি সহ-সম্পর্ক এবং অংশগুলাে পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল, সেহেতু সংস্কৃতির যে অংশের মধ্যে দ্রুত পরিবর্তন হয়, তার সাথে খাপখাইয়ে নেয়ার জন্য সংস্কৃতির অন্যান্য অংশের পরিবর্তন জরুরি হয়ে পড়ে।

তার মতে, যান্ত্রিক আবিষ্কার ও প্রযুক্তিগত উন্নতির ফলে সংস্কৃতির বস্তুগত উপাদানের ক্ষেত্রে যত দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে, অবস্তুগত উপাদানের ক্ষেত্রে তত দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে না। ফলে সংস্কৃতির অবস্তুগত উপাদান বস্তুগত উপাদানের পেছনে পড়ে থাকে। এতে বস্তুগত সংস্কৃতি ও অবস্তুগত সংস্কৃতির মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি হয়। এটিই সাংস্কৃতিক ব্যবধান তত্ত্ব।

অগবার্ন সাংস্কৃতিক ব্যবধানের উদাহরণ দিতে গিয়ে বলেন, সমাজে যান্ত্রিক প্রযুক্তি এবং শিল্পায়ণ যত দ্রুতগতিতে পরিবর্তিত হচ্ছে, তার সাথে মিলিয়ে সমাজের আচার-অনুষ্ঠান, রীতিনীতি ও মানুষের চিন্তাধারা পরিবর্তিত হচ্ছে না। ১৯৫৩ সালে অগবার্ন এবং নিমকফ তাদের ‘A Hand Book of Sociology’ গ্রন্থে সাংস্কৃতিক ব্যবধানের সংজ্ঞায় বলেন, কোনাে সংস্কৃতির মধ্যে অসমগতিতে চলমান দুটি অংশের মধ্যে বিদ্যমান Strain (চাপ, প্রবল আকর্ষণ) হলাে সাংস্কৃতিক ব্যবধান। অগবার্নের সাংস্কৃতিক ব্যবধান তত্ত্বের প্রতিপাদ্য বিষয়গুলাে হলাে-

(১) সমাজ বা সংস্কৃতির বিভিন্ন অংশ পরস্পরের সঙ্গে কার্যকারণ সূত্রে আবদ্ধ।

(২) সংস্কৃতির বিভিন্ন অংশ অসমগতিতে এগিয়ে চলে।

(৩) সাধারণত বস্তুগত সংস্কৃতি অবস্তুগত সংস্কৃতির তুলনায় বেশি দ্রুতগতিসম্পন্ন।

(৪) সংস্কৃতির অংশগুলাে অসমভাবে এগিয়ে চলার কারণে ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়।

(৫) গােটা সংস্কৃতির মধ্যে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার প্রয়ােজনে পিছিয়ে পড়া সংস্কৃতিকে এগিয়ে আনতে হয়।

(৬) উভয়ের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা সত্ত্বেও বস্তুগত সংস্কৃতির সাথে অবস্তুগত সংস্কৃতি তাল মিলিয়ে চলতে পারে না।

সমালােচনাঃ মােটামুটিভাবে সমাজবিজ্ঞানীরা অগবার্ণের এ মতবাদেক গ্রহণ করে নিলেও কিছু কিছু সমাজবিজ্ঞানী মনে করেন যে, আবিস্কার ও উদ্ভাবনের ফলে সংস্কৃতির অবস্তুগত উপাদান সব সময় পরিবর্তিত হয় না। নিচে বিভিন্ন তাত্ত্বিকের সমালােচনা উল্লেখ করা হলাে-

প্রথমত, বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী এস.সি. গিলফি মনে করেন যে, সামাজিক পরিবর্তন প্রকৃতপক্ষে বহুবিধ জটিল উপাদানের ফলশ্রুতি। অতএব সেখান থেকে বিশেষ কোনাে উপাদানকে প্রধান রূপে চিহ্নিত করা বাস্তবিকই অসম্ভব।

দ্বিতীয়ত, সমাজবিজ্ঞানী সিন্স গিলফিনারের বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করে বলেন যে, সামাজিক ও প্রযুক্তিগত উপাদানের প্রাধান্য নির্ণয় অনেক ক্ষেত্রে কঠিন হলেও বহুক্ষেত্রে প্রযুক্তির উপাদানের প্রাধান্য এতই সুস্পষ্ট যে, তা প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না।

তৃতীয়ত, মার্কসীয় ধারণার সাথে সাংস্কৃতিক ব্যবধান তত্ত্বের মিল রয়েছে। কেননা মার্কসীয় ধারণায় বলা হয়েছে যে, উৎপাদন কৌশলে পরিবর্তন আসলে তা ক্রমে উৎপাদন সম্পর্কেও পরিবর্তন আনে। উৎপাদন কৌশলের সাথে খাপখাইয়ে নিতে প্রয়ােজন হয় নতুন উৎপাদন সম্পর্কের, যা সমাজে ভারসাম্য এনে দেয়। তাই নতুন উৎপাদন সম্পর্ক সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত সেখানে সাংস্কৃতিক ব্যবধান পরিলক্ষিত হয়।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, আধুনিক বিজ্ঞান ও সভ্যতার বিকাশে বস্তুজগতের উন্নতির সাথে তাল মিলিয়ে মনােজগতের উন্নতি সম্ভব হচ্ছে না। একটি সুস্থ, সাবলীল ও গতিশীল সমাজের জন্য সমাজ ও সংস্কৃতির বিভিন্ন অংশ ও উপাদানের মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ বজায় থাকা বাঞ্ছনীয়। আর যদি এই ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ রক্ষিত না হয় তাহলে সাংস্কৃতিক ব্যবধান সৃষ্টি হবে।

Rate this post