উত্তরঃ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস [১৯৪৩-১৯৯৭] বাংলা সাহিত্যের একজন প্রতিশ্রুতিশীল লেখক। তিনি মাত্র দুটি উপন্যাস ও কয়েকটি গল্পগ্রন্থ রচনা করে বাংলা সাহিত্যে বিশেষ স্থান অধিকার করে আছেন। চিলেকোঠার সেপাই [১৯৮৬] লেখকের খুব অসাধারণ একটি উপন্যাস। তার এই সার্থক উপন্যাস সৃষ্টির পিছনে সবচেয়ে বড়াে নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে তার চরিত্র চিত্রণের অসাধারণ দক্ষতা। তিনি তার নিপুণ হাতে চরিত্রগুলাে সৃষ্টি করে ব্যতিক্রমী শিল্পীর মর্যাদা লাভ করেছেন। ওসমান, আনােয়ার, আলাউদ্দিন, হাড্ডি খিজির, আলী বক্স, জালাল মাস্টার, রানু, রঞ্জু, মকবুল হােসেন প্রভৃতি সবগুলাে চরিত্রই প্রায় নিপুণভাবে সেই সময়ের মানসকে ধারণ করে আছে।
ওসমান চরিত্রটিকে এ উপন্যাসের প্রতীকী ও কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ওসমান ও তার পরিপার্শ্ব এবং পরিচিতের সীমার মধ্যেই উপন্যাসের মূলভাষ্য ঘনীভূত হয়ে উঠেছে। ফলে ওসমানের প্রতি লেখকের মনােযােগ ছিল সবচেয়ে বেশি। সামাজিক অবস্থানের দিক থেকে ওসমানও মধ্যবিত্তের সন্তান। তার মনােজগৎ মধ্যবিত্ত সুলভ মানসিকতায় পূর্ণ। উনসত্তরের সংগ্রাম ও মিছিলে তরঙ্গিত রাজনৈতিক শহর ঢাকা। মধ্যবিত্তের ব্যক্তিসর্বস্ব, আত্মপ্রেম ও আত্মনিগ্রহপরায়ণ চেতনা প্রবল গণআন্দোলনের টানে কীভাবে চিলেকোঠার বিচ্ছিন্ন জগৎ থেকে বেরিয়ে আসে, ওসমান গনি তার দৃষ্টান্ত।
লেখক এই উপন্যাসে যে আন্দোলনের কথা বলেছেন, সে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র রঞ্জু ওরফে ওসমান, ওসমানের বন্ধু আনােয়ার আর আলতাফ। আছে রিকশা শ্রমিক বস্তি বাসিন্দা খিজির। আনােয়ার বামপন্থি আর আলতাফ ডানপন্থি। আনােয়ার আর আলতাফের কথােপকথনের মাধ্যমে লেখক অনেক জটিল রাজনৈতিক জটিলতাকে মুক্তি দিতে চেয়েছেন। গল্পের ফোকাস কখনাে ছিল হাড্ডি খিজিরের উপর, কখনাে বা আনােয়ারের উপর। তবে পুরাে গল্পে অস্তিত্ব ছিল ওসমানের। ঢাকার এক ঘিনজি গলির মধ্যে ওসমানের বাস। তার বন্ধু আলতাফ, আনােয়ার বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে কিন্তু ওসমান কোনাে কিছুতেই নেই। সে যেন চিলেকোঠাতে বন্দি। লেখক ওসমান চরিত্রটিকে রহস্যময় করে তৈরি করেছেন। উপন্যাসের শেষে খিজিরের সন্ধানে যে ওসমানকে সমগ্র ঢাকা শহরে পরিভ্রমণরত দেখি, সে বিবরবাসী আত্মপ্রেমিক ওসমান নয়। ওসমান চরিত্রের প্যাটার্নের মধ্যে মধ্যবিত্তমানসের যে সকল বৈশিষ্ট্যের বিন্যাস ঘটেছে, তা উনসত্তরের প্রগতিশীল রাজনীতি সচেতন বুদ্ধিবিলাসী মধ্যবিত্তের জন্য স্বাভাবিক ও সংগত। ওসমানের আত্মরূপান্তরের দর্পণে বাঙালি জাতিসত্তার সম্মুখগামী উত্তরণের সত্যই যেন প্রতীকায়িত হয়েছে।
ওসমান যে বাসায় ভাড়া থাকে সেটা আবার আইয়ুবপ্রেমী মহাজন রহমতউল্লাহর। খিজির ছােটোবেলা থেকে রহমতউল্লাহর খেয়ে মানুষ। শ্রমিক হিসেবে থাকে তার গ্যারেজে। কিন্তু এই খিজিরই একসময় হয়ে ওঠে বিপ্লবী। বিভিন্ন প্রকার রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের সাথে সাথে খিজির তার মহাজন রহমতউল্লাহর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তােলে। সৈনিকের গুলিতে নিহত হয় খিজির।
আনােয়ার কলেজের শিক্ষক। ঢাকার উত্তাল আন্দোলন ছেড়ে সে চলে যায় গ্রামে। শ্রেণি বৈষম্য ভাঙতে সে বদ্ধ পরিকর। আফসার গাজী, খয়বার গাজী, হােসেন আলী নামক শােষক মহাজনদের হাতে জিম্মি খেটে খাওয়া যমুনা পাড়ের সাধারণ মানুষদের মুক্তি দেওয়া তার প্রধান উদ্দেশ্য। আফসার গাজী, খয়বার গাজীরা লতায় পাতায় আনােয়ারের আত্মীয় হলেও সে তাদের ক্ষমা করতে রাজি নয়। কিন্তু না, শেষ পর্যন্ত তা আর হয়ে ওঠে না। শহরের রাজনৈতিক হাওয়া গ্রামে লাগলে পাল্টে যায় সবকিছু। যে মহাজনদের গ্রামের মানুষ শাস্তি দিতে চেয়েছিল, আলীবন্ধু আর আনােয়ারের দাপটে মহাজনদের অবস্থা যখন নড়বড়ে তখন সেই মহাজনেরাই নতুন রাজনৈতিক হাওয়ায় ফিরে আসে আগের অবস্থানে। সাধারণ মানুষের ভাগ্যের কোনাে পরিবর্তন হয় না।
আলাউদ্দিন এই মধ্যবিত্তের প্রতিনিধি। ওসমান মধ্যবিত্তসুলভ দোদুল্যমান একটি চরিত্র। এদিকে হাড়ি খিজির ছিন্নমূল মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে শােষণমুক্তির প্রত্যাশা করে। গণআন্দোলনের যে অংশটা লেখকের অনুমােদন পেয়েছে, নাগরিক পরিসরে তার যথার্থ প্রতিনিধি নিঃসন্দেহে খিজির। খিজির একেবারে শুরু থেকেই ‘চার্জড’। সক্রিয় এবং উত্তেজিত। তালেবের মৃত্যুর সময়ে তাকে প্রথম দেখা যায় লােবান জ্বালাচ্ছে। পঞ্চম পরিচ্ছেদে দেখা যায়, খিজির বহুত চার্জড হয়ে ইটা মারছে। খিজির তার ব্যক্তিগত ইতিহাসসহ লম্বা জায়গা জুড়ে মুর্তি পেয়েছে ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ থেকে শুরু করে পরের কয়েক পরিচেছদ জুড়ে। অবশ্য তার ব্যক্তিগত ইতিহাস সামষ্টিক ইতিহাসের সমান্তরালে বা অধীনে বর্ণিত।
রহমতউল্লাহহ মহাজন আর তার ভাগনে আলাউদ্দিন মিয়ার বগল ঘেঁষে, তাদের আয়-উপার্জন আর শারীরিক-মানসিক, প্রবৃত্তিগত সক্রিয়তার সাথে জড়িয়ে পেঁচিয়ে খিজির বিশিষ্ট হয়ে ওঠার পরিসর পায়। লেখক তাকে বেশ খানিকটা পরিসর ছেড়ে দেন তাতে আলবত পক্ষপাত আছে; কিন্তু এক ফোঁটা আবেগ নেই। আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক কাঠামাের মধ্যে তার অবস্থান একবিন্দও মহিমান্বিত হয় না। দশম পরিচ্ছেদেই পরিষ্কার বুঝা যায়, মহাজনের প্রতি পুষে রাখা ঘৃণা আর ক্ষোভই খিজিরের মল প্রেরণা। সমবেত জনতাকে মহাজনের বিরুদ্ধে উস্কে দেওয়ার সমস্ত চেষ্টাই সে চালিয়ে যায়। আলাউদ্দিন মিয়ার ধমক খেয়েও মহাজন যে রঙুর বাপকে হুমকি দিয়েছে, নানাভাবে নাজেহাল করেছে, এমনকি আলাউদ্দিন মিয়া না ঠেকালে ‘মনে লয় দুইচাইরখান চটকানা ভি মাইরা দিত’। এ সংবাদ খিজিরের পুনরাবৃত্তিতেই সবার কানে যায়। মিছিলে মহাজনের বিরুদ্ধে ধুয়া ধরে ওই খিজিরই। দেখা যাচ্ছে, গণআন্দোলনে খিজিরদের জান বাজি রাখা ভূমিকার মূলে রয়েছে তাদের শ্রেণি বাস্তবতা। যার হারানাের কিছু নাই, তার পক্ষেই সম্ভব জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নেমে পড়া।
কিন্তু আখতারুজ্জামান ইলিয়াস কেন্দ্রীয় চরিত্রের মর্যাদা দিয়েছিলেন দোদুল্যমান মধ্যবিত্তের প্রতিনিধি ওসমানকে। ওসমান এ দোদুল্যমান থেকে বের হতে চায় বলেই সে সাধারণত হাড্ডি খিজিরের সমর্থক হয়ে ওঠে। কিন্তু হাড্ডি খিজিররা আলাউদ্দিনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় বলে পেরে ওঠে না। ওসমানরা হাড়ি খিজিরের সমর্থন করতে পারলেও ব্যর্থ হয়। আর ব্যর্থ হয় বলেই সে দেখতে পায় যে, হাড়ি খিজির বিদ্যুতের তারে লটকে থাকে। মধ্যবিত্ত ওসমান যে, ‘মুক্তি’ খোঁজে, তার সন্ধান কিন্তু দেয় সর্বহারা শ্রেণির প্রতিনিধি হাড্ডি খিজির।
এই উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু হিসেবে শনাক্ত করা যায় যে, মধ্যবিত্তরা সুবিধাভােগী, পলায়নকারী কারণ তাদের সামনে ঝুলছে ওপরে ওঠার মুলাে। মধ্যবিত্ত শুধু চায় ওপরে উঠতে, নিচে নামার ভীতি তাদের অনাকাঙ্ক্ষিত। ফলে মধ্যবিত্তের কাছে পরিপূর্ণ আত্মােৎসর্গ আশা করা যায় না। সেজন্যই মধ্যবিত্ত ওসমানকে লেখক বারবার হাড়ি খিজিরের পর্যায়ে নামিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন। ওসমানের এই নেমে আসার মধ্য দিয়ে লেখক চেয়েছেন তার নিজের জীবনদৃষ্টিকে প্রকাশ করতে। লেখক মনে করেছিলেন হাড্ডি খিজিরদের মতাে নিম্নবৃত্তরাই বিপ্লব সম্পন্ন করে। কারণ তাদের আর নিচে নামার কিছু নেই। মার্কসীয় দর্শনের এ মূল তত্ত্বকেই ইলিয়াস তার শৈল্পিক দর্শন হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
ইলিয়াস বাংলাদেশের অর্থনীতি, রাজনীতি ও সামাজিক পটভূমিতে শ্রেণিগত অবস্থানকেই চরিত্রের চলাচলের নিয়ামক করে নিয়েছেন। ফলে তার পক্ষে সম্ভব হয়েছে সবসময় এতটা নির্মোহ থাকতে পারা। নির্মোহতা তার এতটাই যে, চরিত্রগুলাের জন্য সমান্যতম মায়া-মমতাও তিনি অবশিষ্ট রাখেননি। ফলে তিনি চরিত্র চিত্রণের ক্ষেত্রে অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। আমার মনে হয়, এ বৈশিষ্ট্যই তাকে এতটা কঠোর ও নির্মোহ মানবিক-আবেগমুক্ত কথাসাহিত্যিকে পরিণত করেছে।