সাম্যের প্রকৃতি সমাজের আর্থিক কাঠামোর উপর নির্ভরশীল: সকল সমাজব্যবস্থায় সাম্যের প্রকৃতি একই রকম নয়। মার্কসীয় দর্শন অনুসারে সাম্যের প্রকৃতি সমাজের আর্থিক কাঠামো নিরপেক্ষ হতে পারে না। স্বাধীনতার ন্যায় সাম্যের প্রকৃতিও সমাজের আর্থিক কাঠামোর দ্বারা স্থিরীকৃত হয়। ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় যে ধরনের সাম্য পরিলক্ষিত হয়, সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সাম্যের প্রকৃতি তা অপেক্ষা স্বতন্ত্র।

আদিম সাম্যবাদী সমাজ: কোনো একটি সমাজে সাম্যের প্রকৃতি সেই সমাজের আর্থনীতিক ব্যবস্থা অনুসারে নির্ধারিত হয়। স্বভাবতই সমাজ বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়ে সাম্যের প্রকৃতি বিভিন্ন রকম হয়েছে। আদিম সাম্যবাদী সমাজে উৎপাদন-উপাদানসমূহের উপর ব্যক্তিগত মালিকানা ছিল না। উৎপাদনের উপাদান ও উৎপাদন ব্যবস্থা ছিল অনুন্নত সংগ্রহ সঞ্চয় ছিল না বললেই হয়। সামান্য যে সম্পত্তি ছিল তাতে ছিল সকলের সম্মিলিত অধিকার। সংগৃহীত খাদ্য সকলে মিলে-মিশে ভাগ করে খেত। মানব জীবন ছিল যূথবদ্ধ। এই যৌথ জীবনের ভিত্তি ছিল সাম্য। এই সময় শ্রেণী-বৈষম্য বা শ্রেণী-শোষণ ছিল না। তেমনি নারী পুরুষের মধ্যে মর্যাদা বা অধিকারের পার্থক্য ছিল না। তবে মানুষ ছিল প্রকৃতির উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। তাই এই সমাজে মানুষের জীবন ছিল অত্যন্ত দরিদ্র।

দাস-সমাজ ও সামন্ত-সমাজ: কিন্তু দাস সমাজে অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। দাস-সমাজে ও সামস্ত সমাজে উৎপাদনের সকল উপাদানের মালিকানা কেন্দ্রীভূত হয় দাস-মালিক ও সামন্ত শ্রেণীর হাতে। তার ফলে ধনবৈষম্য ও শ্রেণীবৈষম্য শুরু হয় এবং অব্যাহত থাকে। এই দুই সমাজব্যবস্থায় প্রভুত্বকারী দাস মালিক ও সামত্ত শ্রেণীর স্বার্থে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রযুক্ত হয়। তার ফলে দাস সমাজে দাসরা এবং সামন্ত সমাজে কৃষকেরা সামাজিক, রাজনীতিক, আর্থনীতিক প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রে অসাম্য-বৈষম্যের শিকার হয়। সমাজের অসংখ্য সাধারণ মানুষ সাম্য ও যাবতীয় অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়।

ধনতন্ত্রে সাম্য: ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় উদারনীতিক গণতান্ত্রিক আদর্শের কথা বলা হয়। এই ধরনের সমাজব্যবস্থায় সামাজিক ও রাজনীতিক সাম্যের আদর্শ প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করা হয়। তা ছাড়া আইনের অনুশাসন তথ্য আইনের দৃষ্টিতে সাম্যের কথা বলা হয়। ধনতান্ত্রিক দেশগুলিতে মূলত সামাজিক ও রাজনীতিক সাম্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। রাষ্ট্র জাতি, ধর্ম, বর্ণ, অর্থ, প্রতিপত্তি প্রভৃতির ভিত্তিতে নাগরিকদের মধ্যে ভেদাভেদ করে না। আইনের চক্ষে সকলে সমান বলে গণ্য হয়। রাষ্ট্র আইনের মাধ্যমে প্রত্যেক ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশের উদ্দেশ্যে সমান সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে। বিশেষ সুযোগ-সুবিধা বা বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা স্বীকৃত হয় না। রাজনীতিক ক্ষেত্রে নাগরিকদের নির্বাচন করার বা নির্বাচিত হওয়ার ব্যাপারে সমান সুযোগ থাকে। ধর্মীয় ক্ষেত্রেও বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয় না। সংক্ষেপে, ধনতান্ত্রিক দেশগুলিতে সামাজিক ও রাজনীতিক সাম্যের উপর অতিমাত্রায় গুরুত্ব আরোপ করা হয়ে থাকে। কিন্তু আর্থনীতিক সাম্যকে অগ্রাহ্য করা হয়। উদারনীতিক ধ্যান-ধারণা অনুসারে সামাজিক ও রাজনীতিক সাম্যের ভিত্তিতেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। উদারনীতিক মতবাদীরা আর্থনীতিক সাম্যের গুরুত্বকে স্বীকার করেন না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যাণ্ড ফ্রান্স প্রভৃতি ধনতান্ত্রিক দেশগুলিতে এই রকম সামাজিক ও রাজনীতিক সাম্যের স্বীকৃতি পরিলক্ষিত হয়।

সমাজতন্ত্রে সাম্য: সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় মার্কসীয় দর্শন অনুসাবে আর্থনীতিক সাম্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। আর্থনীতিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হলে আয় ও ধনসম্পত্তির বৈষম্য বিলুপ্ত হয়। উৎপাদনের উপাদানসমূহের উপর সামাজিক মালিকানাই হল আর্থনীতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারের অবসান ঘটে। তার ফলে শ্রেণী-বৈষম্য ও শ্রেণী-শোষণেরও অবসান ঘটে। সমাজের একশ্রেণীর লোক আর্থনীতিক ক্ষমতাকে হস্তগত করে অপর সকলকে শোষণ করার সুযোগ পায় না। ফলে শ্রেণীহীন, শোষণহীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এই রকম সমাজব্যবস্থাতেই কেবল সমান আর্থনীতিক সুযোগ-সুবিধার ভিত্তিতে প্রত্যেকে নিজের ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ সাধন করতে পারে এবং সামাজিক, রাজনীতিক ও অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে প্রকৃত সাম্যের আদর্শ উপলব্ধি করতে পারে। আর্থনীতিক ক্ষেত্রে অসাম্যের অবসান ঘটলে সামাজিক ও রাজনীতিক সাম্যের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। সমাজতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী দেশগুলিতেই আর্থনীতিক সাম্য পরিলক্ষিত হয়। গণ-প্রজাতন্ত্রী চীনের মতো সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্রে নাগরিকদের আর্থনীতিক সাম্য সংরক্ষিত হয়েছে। শ্রেণীহীন, শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক সমাজেই সাম্যের প্রকৃত তাৎপর্য উপলব্ধি করা যায়।

Rate this post