স্বৈরতন্ত্র বা একক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ক্ষমতা প্রয়োগের রাষ্ট্রনৈতিক ব্যবস্থা হল উদারনীতিক গণতন্ত্রের বিপরীত রাজনীতিক আদর্শ। উদারনীতিক গণতন্ত্রের নাগরিক স্বাধীনতা এখানে থাকে না। শুধু তাই নয় স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রনৈতিক ব্যবস্থায় অবাধ রাজনীতিক প্রতিযোগিতা, জনমত প্রকাশের স্বাধীন সুযোগ, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা প্রভৃতি অস্বীকৃত ও অনুপস্থিত। এখানে আইনের অনুশাসন, গণতন্ত্রের মূল্যবোধ পরিলক্ষিত হয় না। স্বৈরতন্ত্রে জনমতের কণ্ঠ রুদ্ধ হয়। এই সকল কারণে অনেকে স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সর্বাত্মক ব্যবস্থার (Totalitarian System) অনুপন্থী বলে মনে করেন। কিন্তু স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং সর্বাত্মক ব্যবস্থার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। অ্যালান বল-এর মতে এ কোন স্বল্পস্থায়ী বা অস্থায়ী ব্যবস্থাও নয়।

স্বৈরতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য:

স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঠিক সংজ্ঞা নির্দেশ করা সহজসাধ্য নয়। বল তাঁর Modern Politics and Government শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “…autocracy, probably gives rise to more difficulties of conceptualisation than either liberal democracy or totalitarianism.” অ্যালান বলকে অনুসরণ করে স্বৈরতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থার কতকগুলি মৌলিক বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করা যায়।

(১) স্বৈরতন্ত্রে রাজনীতিক দল গঠন এবং বিভিন্ন রাজনীতিক প্রতিযোগিতার উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। বলের কথায়: “There are important limitations on open political competition.”

(২) স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কোন সুনির্দিষ্ট রাজনীতিক মতাদর্শ থাকে না। কিন্তু জাতীয় বৈশিষ্ট্য ও‌ জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে রাজনীতিক সমতা বা সংহতি বজায় রাখার প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়। বল বলেছেন: “There is an absence of a strongly articulated and coherent ideology, although many of these autocratic regimes lay great stress on nationalism.” 

(৩) এরকম ব্যবস্থায় বলপ্রয়োগ ও জবরদস্তির দ্বারা নাগরিকদের রাজনীতিক আনুগত্য লাভ করার ব্যবস্থা করা হয়। বল বলেছেন: “There is more open use of force and coercion to enforce political obedience.”

(৪) স্বৈরতন্ত্রে নাগরিক অধিকার সরকার কর্তৃক কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। গণসংযোগের মাধ্যমগুলির স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা এখানে থাকে না। সরকারী নিয়ন্ত্রণাধীনে এগুলি পরিচালিত হয়। বল বলেছেন: “Civil liberties are weakly supported and the mass media is usually firmly controlled by the government.”

(৫) স্বৈরতন্ত্রে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা থাকে না বললেই চলে। বল বলেছেন: “There is little judicial independence.”

(৬) একটি একক কর্তৃপক্ষ বা নির্দিষ্ট কোন একটি গোষ্ঠী রাজনীতিক কর্তৃত্ব কায়েম করে এবং সামগ্রিকভাবে সমাজজীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে। 

(৭) ঐতিহ্যগত কোন গোষ্ঠীর শাসন, আধুনিকীকরণের প্রচেষ্টা সঞ্জাত কিছু ব্যক্তি (modernising elite)-র শাসন, স্বাধীনতা সংগ্রামের ফলে উদ্ভূত কোন অবিসংবাদিত নেতার আবির্ভাব, সামরিক অভ্যুত্থান প্রভৃতি বিভিন্ন সূত্রে স্বৈরতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।

(৮) স্বৈরতন্ত্রে রাজনীতিক ক্ষমতার কোন সুনির্দিষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পরিলক্ষিত হয় না। ক্ষমতা ন্যস্ত থাকে সাধারণত কোন সাবেকী রাজনীতিক এলিট বা আধুনিক কোন এলিট বা প্রায়শই সামরিক বাহিনীর হাতে। বল বলেছেন: “Political power is less institutionalised and the basis for rule is either found in a traditional political elite or in a new modernising elite, often the military.”

স্বৈরতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থায় বিভিন্ন উপাদানের অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। বিভিন্ন দেশের স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত্তি হিসাবে বিভিন্ন রাজনীতিক মতাদর্শের অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। আবার পীড়নমূলক ব্যবস্থাদিও সকল স্বৈরতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থায় সমজাতীয় নয়। বস্তুত অনেকে উদারনীতিক গণতন্ত্র ও সর্বাত্মক রাজনীতিক ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত সকল রাজনীতিক ব্যবস্থাকে স্বৈরতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষপাতী। বল বলেছেন: “This … category is very heterogeneous and it seems to contain all those political system that cannot be fitted into the liberal democratic and totalitarian moulds.”

অ্যালান বল-এর মতানুসারে স্বৈরতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থার শ্রেণীবিভাজন:

অ্যালান বল-এর মতানুসারে স্বৈরতন্ত্রে দু-ধরনের রাজনীতিক ব্যবস্থা দেখা যায়— ঐতিহ্যগত এবং আধুনিক। ইথিওপিয়া, জর্ডান, নেপাল, ভুটান, ইরান, সৌদি আরব প্রভৃতি দেশে ঐতিহ্যগতভাবে কোন এক বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হাতে রাজনীতিক কর্তৃত্ব ন্যস্ত আছে। সেইজন্য এই সকল দেশের রাজনীতিক ব্যবস্থা ঐতিহ্যগত স্বৈরতন্ত্রের দৃষ্টান্ত হিসাবে গণ্য হয়। সৌদি আরবে সাবেকী ক্ষমতাধিকারী বর্তমান। নাইজিরিয়ায় সামরিক বাহিনী থেকে রাজনীতিক এলিটদের নিয়োগ করা হয়। আবার কোন কোন স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আধুনিকীকরণের ব্যাপক প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু শাসন কাঠামো এবং সামাজিক বিন্যাস অপরিবর্তিত রেখে আর্থিক, সাংস্কৃতিক ও সামরিক ব্যবস্থার আধুনিকীকরণই এরকম স্বৈরতন্ত্রের উদ্দেশ্য। আধুনিকীকৃত স্বৈরতন্ত্রের দৃষ্টান্ত হিসাবে সংযুক্ত আরব সাধারণতন্ত্র আলজিরিয়া প্রভৃতি দেশের রাজনীতিক ব্যবস্থার উল্লেখ করা হয়।

স্বৈরতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা:

অনেকে স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে স্বল্পকালস্থায়ী ব্যবস্থা বলে মনে করেন। কারণ উদারনীতিক ব্যবস্থা বা সর্বাত্মক ব্যবস্থার আর্থনীতিক ও শিল্পগত বিকাশ এখানে অনুপস্থিত। আবার অনেকের মতানুসারে উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মাঝে মাঝে স্থিতিশীলতার অভাব দেখা যায়। সেই রকম অবস্থায় স্বৈরতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থা কাম্য। এই শ্রেণীর ব্যক্তিরা মনে করেন যে দেশের সংকটকালীন অবস্থায় এক রাজনীতিক ব্যবস্থা বিশেষভাবে উপযোগী। কিন্তু গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার ব্যাপক বিকাশ ও বিস্তারের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিক্রিয়াশীল এই রাজনীতিক ব্যবস্থাকে এখন আর কোনভাবেই সমর্থন করা হয় না।

উপসংহার: বিভিন্ন স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিভিন্ন তাদর্শের প্রাধান্য থাকে। তা ছাড়া, আর্থনীতিক উন্নতির তারতম্য, দমন-পীড়নের ব্যবস্থার উৎপত্তিগত তারতম্য প্রভৃতিও থাকে। আফ্রিকার জাতীয় আন্দোলনের ফলশ্রুতি হিসাবে জ্বেমো কেনিয়াট্টা ও ইদি আমিন তাঁদের স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তবে কেবলমাত্র রাজনীতিক কাঠামো ও তার কার্যাবলী সংক্রান্ত উপাদানের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতির ভিত্তিতে কোন রাজনীতিক ব্যবস্থার মূল প্রকৃতি অনুধাবন করা যায় না। এ ক্ষেত্রে মতাদর্শগত মাপকাঠি দরকার হয়। রাজনীতিক ব্যবস্থার শ্রেণীবিভাজনের ক্ষেত্রে সাবেকী মতামতের মত আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিও সীমাবদ্ধ। বল মন্তব্য করেছেন: “Certainly we cannot produce our all purpose system of classification which would answer all questions.”

Rate this post