সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের নীতি স্বীকৃত হওয়া সত্ত্বেও স্ত্রীলোকের ভোটাধিকার সম্পর্কে বিতর্ক বহুদিন চলেছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে স্ত্রীলোকের ভোটাধিকারের অনুকূলে বিভিন্ন দেশে আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। নারীজাতির ভোটাধিকারের জন্য আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৮৬১ সালে। কালক্রমে এই আন্দোলন সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্ত্রীলোকের ভোটাধিকার স্বীকৃত হয় ১৯২০ সালে। ইংল্যান্ডে ১৮৯৮ সালে ত্রিশ বৎসর বয়স্ক বা তদূর্ধ্ব স্ত্রীলোকের ভোটাধিকার প্রদত্ত হয়। পরে ১৯২৮ সালে স্ত্রীলোকের ভোটাধিকার প্রাপ্তির বয়স পুরুষের সমান করা হয়। ফ্রান্স ও ইতালীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এবং জাপানে ১৯৪৭ সালে নারীর ভোটাধিকার স্বীকৃত হয়েছে। আর গণতন্ত্রের পীঠস্থান সুইজারল্যাণ্ডে কেবল ১৯৭১ সালে স্ত্রীলোকের ভোটাধিকার কার্যকরী হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের সকল গণতান্ত্রিক দেশেই নারীর ভোটাধিকার স্বীকৃত হয়েছে। তবে স্ত্রীলোকের ভোটাধিকার এখনও পৃথিবীর সকল দেশে সমভাবে সম্প্রসারিত হয়নি। কিন্তু প্রকৃত গণতন্ত্রের পীঠস্থান সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে নারী ও পুরুষ সকল ক্ষেত্রে সমমর্যাদা ও সমানাধিকারসম্পন্ন।

স্ত্রীলোকের ভোটাধিকারের বিপক্ষে যুক্তি:

স্ত্রীলোকের ভোটাধিকারের বিরোধী রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ তাঁদের বক্তব্যের সমর্থনে বিভিন্ন যুক্তির অবতারণা করেন।

(১) গুণগণ যোগ্যতার অভাব: জ্ঞান-বুদ্ধি ও চিন্তা-ভাবনার ক্ষেত্রে নারী পুরুষ অপেক্ষা নিকৃষ্ট মানের। অন্তঃপুরবাসিনী নারী রাজনীতিক জটিলতার আবর্তে পুরুষের দ্বারা পরিচালিত হবে, এটাই স্বাভাবিক। অর্থাৎ স্ত্রীলোকের ভোটাধিকার পুরুষের ইচ্ছায় ও স্বার্থে ব্যবহৃত হবে। কিন্তু তা সমর্থন করা যায় না।

(২) পারিবারিক অশান্তির আশংকা: অনেকের মতে নারীর ভোটাধিকার স্বীকৃত হলে পারিবারিক জীবনের আদর্শ ও সুখশান্তি নষ্ট হবে। রাজনীতিক ক্ষেত্রে স্ত্রী ও পুরুষের মধ্যে মতপার্থক্যের সৃষ্টি হলে গার্হস্থ্য জীবনের প্রীতিপূর্ণ পরিবেশ বিঘ্নিত হয়। তা ছাড়া, এটি নারীত্বের সুকুমার বৃত্তিগুলিকে নষ্ট করে। 

(৩) গার্হস্থ্য জীবনের অবহেলা: মানুষের সমাজজীবনে রাষ্ট্রনীতির মত গার্হস্থ্য নীতির গুরুত্ব কোন অংশে কম নয়। সুষ্ঠুভাবে গার্হস্থ্য জীবন পরিচালিত হলে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের সৃষ্টি হয়। এটিই নারীর প্রাথমিক ও প্রধান কর্তব্য। কিন্তু গার্হস্থ্য জীবনকে অবহেলা করে নারীকে রাষ্ট্রনীতিক ক্ষেত্রে ঠেলে দিলে নারীত্বের সার্থকতা নষ্ট হবে এবং পরিবার জীবন বিপন্ন হবে।

(৪) দৈহিক অক্ষমতা: বলা হয় যে, দৈহিক শক্তিতে নারী পুরুষের সমকক্ষ নয়। দেশরক্ষার মত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনে নারী অক্ষম। সুতরাং রাষ্ট্রনীতিক ব্যাপারে নারীর হস্তক্ষেপ অনভিপ্রেত।

(৫) আবেগপ্রবণতা: প্রকৃতিগতভাবে নারীজাতি আবেগপ্রবণ। যুক্তি-তর্ক ন্যায়-নীতির পরিবর্তে নারীজাতি ভাবাবেগের দ্বারা পরিচালিত হয়। রাষ্ট্রনীতিক ক্ষেত্রে ভাবাবেগের স্থান নেই। সুতরাং নারীজাতিকে ভোটাধিকার দেওয়া যায় না। 

(৬) ধর্মীয় প্রভাব: স্ত্রীলোকের উপর ধর্মীয় প্রভাব বিস্তারের সম্ভাবনা অত্যন্ত বেশী। ক্যাথলিক চার্চের যাজকগণ ধর্মীয় কারণে স্ত্রীলোককে সহজে প্রভাবিত করতে পারেন এবং সেই সূত্রে রাজনীতিক কর্তৃত্ব কায়েম করার সুযোগ পান। স্ত্রী জাতির ভোটাধিকারের বিরুদ্ধে ক্যাথলিক্ প্রধান দেশসমূহে এই যুক্তি দেখান হয়।

স্ত্রীলোকের ভোটাধিকারের সপক্ষে যুক্তি:

নারীজাতির ভোটাধিকারের বিরুদ্ধে যেসব যুক্তির অবতারণা করা হয়, গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে সেগুলি ভিত্তিহীন প্রতিপন্ন হয়। জন স্টুয়ার্ট মিল স্ত্রীলোকের ভোটাধিকারের প্রবল প্রবক্তা হিসাবে পরিচিত। স্ত্রী-ভোটাধিকারের সপক্ষে সমর্থকগণ বিভিন্ন যুক্তি প্রদর্শন করেন।

(১) মিলের যুক্তি: মিলের মতে ব্যক্তি নারী বা পুরুষ এটি একান্ত গৌণ বিষয়। পুরুষ তার স্বার্থপরতার জন্যই স্ত্রী-ভোটাধিকারের বিরোধিতা করে।

(২) ন্যায়সঙ্গত: রাষ্ট্রীয় আইন ও ক্রিয়াকলাপ নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলকে সমানভাবে স্পর্শ করে। সুতরাং যে প্রতিনিধিগণ সরকারী নীতি নির্ধারণ করেন ও আইন প্রণয়ন করেন, তাঁদের নির্বাচনের ব্যাপারে পুরুষের মত নারীরও সমান অধিকার থাকা উচিত। এটিই ন্যায়সঙ্গত। সরকার নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের। এই কারণে সরকারী নীতি নির্ধারণ সংক্রান্ত বিষয়ে সকলের সমানাধিকার অপরিহার্য। এ হল সাম্য তথা গণতন্ত্রের মূল কথা।

(৩) শারীরিক অক্ষমতার অজুহাত অচল: শারীরিক অক্ষমতার অজুহাতে নারীকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা যায় না। কারণ ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য দৈহিক শক্তির প্রয়োজন হয় না। তা ছাড়া যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ না করলেও নারী-রক্ষীবাহিনীর ভূমিকা উপেক্ষা করা যায় না। বর্তমানে নারী পুরুষের সঙ্গে সমান তালে পা ফেলে চলেছে। পুলিশী ও অন্যান্য শ্রমসাধ্য কাজে তারা আজ আর পিছিয়ে নেই। ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধে, স্ত্রীজাতির সংগ্রামের সপ্রশংস ইতিহাস সকলের জানা। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ঝালীর রাণী লক্ষ্মীবাঈ, মাতঙ্গিনী হাজরা প্রভৃতি বীরাঙ্গনার নাম স্বর্ণাক্ষরে উজ্জ্বল হয়ে আছে। আবার দৈহিক ক্ষমতা বিচার্য বিষয় হলে দুর্বল পুরুষদেরও ভোটাধিকার থেকে বাদ দিতে হয়।

(8) অগণতান্ত্রিক: নারীত্বের অজুহাতে স্ত্রীলোককে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করলে দেশের অর্ধেক অংশই এই গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। তার ফলে সমাজের এই বিশেষ অংশ রাজনীতিক বিষয়ে অন্ধকারে থাকবে। এইভাবে যে আইনসভা গঠিত হবে, তাকে জনপ্রতিনিধি সভা বলা যায় না। তা হবে অগণতান্ত্রিক।

(৫) নারী পুরুষের সমকক্ষ: জ্ঞান-বিজ্ঞান, বিদ্যা-বুদ্ধি, মননশীলতা ও রাজনীতিক বিভিন্ন বিষয়ে নারী পুরুষের সঙ্গে ক্ষেত্রবিশেষে সহযোগিতা ও প্রতিযোগিতা করছে। কেবল গৃহের মধ্যেই তাদের কর্মক্ষেত্র আর সীমাবদ্ধ নেই। পৃথিবীর বহু দেশেই আজ মহিলা রাজনীতিবিদ্‌গণ শাসনকার্য পরিচালনা করছেন। আর ভোটাধিকারের সঠিক প্রয়োগ নারীজাতির পক্ষে সম্ভব হবে না—এমন যুক্তি অবাস্তব। রাজনীতিক ক্ষেত্রে স্ত্রীলোকের যোগ্যতার নজির হিসাবে ভারতের শ্রীমতী গান্ধী, ব্রিটেনের থ্যাচার, শ্রীলঙ্কার শ্রীমতী বন্দরনায়েক প্রমুখ বিশিষ্ট মহিলার কথা বলা যায়। প্রকৃত প্রস্তাবে শিল্প-সাহিত্য, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি প্রভৃতি ক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমকক্ষ এমন অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যায়।

(৬) নারী স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারে: ভোটাধিকার প্রয়োগের ব্যাপারে নারীজাতি পুরুষের দ্বারা প্রভাবিত হন—একথা সর্বাংশে সত্য নয়। বর্তমানে তাঁদের মধ্যে রাজনীতিক সচেতনতা যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে এবং গোপন নির্বাচন ব্যবস্থায় তাঁরা স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করে থাকেন।

(৭) পারিবারিক অশান্তির যুক্তি খাটে না: বর্তমানে বহির্বিশ্বের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকা সম্প্রসারিত। তার ফলে গার্হস্থ্য জীবন অচল হয়নি বা পারিবারিক শাস্তি অন্তর্হিত হয়নি। সুতরাং নারী জাতিকে ভোটাধিকার প্রদান করলে পারিবারিক জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে—এমন যুক্তি বাস্তবতা বর্জিত। আবার নারীজাতির ভোটাধিকার স্বীকৃত হলে তাদের সুকুমার গুণাবলী বিনষ্ট হবে এ যুক্তিও ঠিক নয়। বরং নারীসুলভ সুকুমার বৃত্তিগুলি সামাজিক ও রাজনীতিক পরিবেশকে সুস্থ ও সুন্দর করবে।

উপসংহার: বর্তমান বিশ্ব গণতান্ত্রিক চেতনা-সমৃদ্ধ। তাই বর্তমানে স্ত্রী-স্বাধীনতা সম্প্রসারিত হয়েছে। বিশ্বে নারীবর্ষ উদযাপনের মাধ্যমে মহিলাদের উপর আরোপিত সর্বপ্রকারের অক্ষমতা অপসৃত হয়েছে। সকল বিষয়েই নারী ও পুরষের সমানাধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। স্ত্রীলোকগণ সামাজিক, আর্থনীতিক প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রেই পুরুষের সঙ্গে সহযোগিতা ও প্রতিযোগিতা করছে। সুতরাং রাজনীতিক ক্ষেত্র থেকে তাদের বিতাড়িত করা অন্যায় ও অযৌক্তিক।

Rate this post