আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় যে কোন দেশের রাজনীতিক প্রক্রিয়া পর্যালোচনার ক্ষেত্রে রাজনীতিক দল-ব্যবস্থা ও রাজনীতিক দলের ভূমিকার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। আবার রাজনীতিক দলের ভূমিকা বিচার-বিশ্লেষণের জন্য প্রচলিত নির্বাচন-ব্যবস্থার উপর জোর দেওয়া হয়। বস্তুত বর্তমানে নির্বাচন ব্যবস্থা এবং রাজনীতিক দল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হিসাবে বিবেচিত হয়। আধুনিককালের গণতন্ত্র হল প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র। এখানে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য রাজনীতিক দল ও নির্বাচন ব্যবস্থা অত্যাবশ্যক। এখনকার প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনী প্রক্রিয়ার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শক্তিশালী হাতিয়ার হল রাজনীতিক দল। বর্তমানে নির্বাচনী রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র হিসাবে রাজনীতিক দলের কথা বলা হয়। রাজনীতিক দল নির্বাচনের প্রক্রিয়া ও ফলাফলকে প্রভাবিত করে। অনুরূপভাবে রাজনীতিক দলের গঠন-ব্যবস্থা এবং দলের সংখ্যা, ভূমিকা, পরিচালনা প্রভৃতি প্রভাবিত হয় নির্বাচন-পদ্ধতির দ্বারা। Modern Politics and Government শীর্ষক গ্রন্থে বল বলেছেন: “The electoral system is only one factor in the evolution of a party-system but the effects of different electoral systems can be found in the structure, ideology, the pattern of party interaction and in the number of parties that compete in the political system.” এ প্রসঙ্গে বল আরও বলেছেন: “A full description of an electoral system would include such factors as the extent of the franchise …..the rules relating to candidates and parties and those regulating the administra tion of election,…”

বিভিন্ন উপাদান নির্বাচন ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত থাকে। এই সমস্ত উপাদান রাজনীতিক দলের ভূমিকা ও পরিচালনাকে প্রভাবিত করে। সুতরাং নির্বাচন-ব্যবস্থার দ্বারা রাজনীতিক দলের উপর প্রভাব বিস্তারের বিষয়টি বিশেষভাবে জটিল। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন ব্যবস্থার বিভিন্ন উপাদানের ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা করা আবশ্যক।

নির্বাচনী এলাকার আয়তন:

নির্বাচন কেন্দ্রের আয়তন এ ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে বিবেচিত হয়। বল বলেছেন: “The size of constituency is an important aspect of electoral systems….” নির্বাচনী এলাকার আয়তন বলতে ভৌগোলিক আয়তন ও ভোটদাতাদের সংখ্যাকে বোঝায়। রাজনীতিক দল ও প্রার্থীর প্রভাব নির্বাচনী ক্ষেত্রের আয়তনের উপর নির্ভরশীল। নির্বাচন কেন্দ্রের আয়তন অপেক্ষাকৃত ছোট বা সীমাবদ্ধ হলে এক ধরনের অবস্থার সৃষ্টি হয়। তখন নির্বাচন কেন্দ্রের ভোটদাতাদের সঙ্গে সরাসরি ব্যক্তিগত সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারে অসুবিধা কম থাকে। ভোটদাতাদের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা পান। এই অবস্থায় নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রার্থীদের মধ্যে ব্যক্তিগত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পরিণত হয়ে থাকে। অর্থাৎ তখন নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা কেবলমাত্র রাজনীতিক দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। নির্বাচকদের সঙ্গে নির্বাচন প্রার্থীর ব্যক্তিগত সংযোগের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিক দলের ভূমিকার গুরুত্ব হ্রাস পায়। দলীয় উদ্যোগ আয়োজন তখন অতটা অপরিহার্য বিবেচিত হয় না। অপরদিকে নির্বাচনী এলাকা অতিমাত্রায় বিশালায়তনযুক্ত হলে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ব্যক্তিগতভাবে প্রার্থীরা অসহায় বোধ করেন। ভোটদাতাদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে সংযোগ স্থাপন করা প্রার্থীদের পক্ষে সম্ভব হয় না। এই অবস্থায় রাজনীতিক দলের উদ্যোগ-আয়োজন অপরিহার্য প্রতিপন্ন হয়। রাজনীতিক দল তার সাংগঠনিক শক্তির সাহায্যে বিশাল আয়তনবিশিষ্ট নির্বাচন কেন্দ্রের অসংখ্য ভোটদাতার সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থা করে এবং নির্বাচকদের কাছে দলীয় প্রার্থীর বক্তব্য ও আবেদন পৌঁছে দেয়। নির্বাচন-প্রার্থী ও নির্বাচকদের মধ্যে সংযোগ সাধনের ক্ষেত্রে রাজনীতিক দলের প্রতীক তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠে। অর্থাৎ নির্বাচনী এলাকার আয়তন বিশেষভাবে বিশাল হলে রাজনীতিক দলের প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায় এবং রাজনীতিক দলের অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য হয়ে পড়ে।

নির্বাচন পদ্ধতিও এক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক উপাদান হিসাবে বিবেচিত হয়। রাষ্ট্রের মধ্যে রাজনীতিক দলের সংখ্যা ও শক্তি বহুলাংশে নির্বাচন পদ্ধতির উপর নির্ভরশীল। বল বলেছেন: “It is inevitable that the electoral system does affect the relative strength and number of parties in the legislature.”

সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও এক ভোটপত্র পদ্ধতি এবং দ্বিদলীয় ব্যবস্থা:

এ প্রসঙ্গে প্রথমে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং এক ভোটপত্র পদ্ধতি (Single member constituency and single vote-first past-the-post’)-র কথা বলা যায়। এই ধরনের নির্বাচন পদ্ধতি দ্বি-দলীয় ব্যবস্থার উদ্ভব ও বিকাশে সাহায্য করে। এই ধরনের নির্বাচন পদ্ধতিতে একটি নির্বাচন কেন্দ্র থেকে একজন প্রার্থী নির্বাচিত হন এবং সর্বাধিক সংখ্যক ভোটপ্রাপ্ত প্রার্থীই নির্বাচিত হন। এই অবস্থায় অধিকতর প্রভাবশালী দলের প্রার্থীই নির্বাচিত হন। গ্রেট ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, নিউজিল্যাণ্ড প্রভৃতি দেশে এই ধরনের নির্বাচন ব্যবস্থা বর্তমান। এই কারণে গ্রেট ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। বল, মরিস দ্যুভারজারকে অনুসরণ করে বলেছেন: “Duverger argues that the electoral system restored two-party politics in Britain by hastening the decline of the Liberal Party…” তবে এমন কথা বলা যায় না যে এই নির্বাচন পদ্ধতি গৃহীত হলে দ্বি-দল ব্যবস্থার সৃষ্টি হবেই। অর্থাৎ সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও এক ভোটপত্র পদ্ধতির সঙ্গে দ্বি-দল ব্যবস্থার এমন কোন ওতপ্রোত সম্পর্ক নেই। ভারতে এই ধরনের ভোটদান পদ্ধতি বর্তমান। এতদসত্ত্বেও ভারতে দ্বি-দলীয় ব্যবস্থার উদ্ভব বা বিকাশ ঘটেনি। তবে এ কথা বলা যায়। যে, এই ধরনের নির্বাচন পদ্ধতি দ্বি-দলীয় ব্যবস্থার অনুকূল প্রবণতার সৃষ্টি করে।

সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের পদ্ধতি ও বহু দল-ব্যবস্থা:

আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভোট-পদ্ধতি হল সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের পদ্ধতি (Proportional Representation)। এই ধরনের নির্বাচন পদ্ধতিতে প্রতিটি নির্বাচন কেন্দ্র একাধিক আসন-বিশিষ্ট (multi-member constituency) হয়। এবং প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যার অনুপাতে আসন প্রদত্ত হয় বা সফল প্রার্থী বাছাই করা হয়। প্রতিনিধি নির্বাচনের সমানুপাতিক পদ্ধতি বহুদলীয় ব্যবস্থার সহায়ক বলে বিবেচিত হয়। মরিস দ্যুভারজারকে অনুসরণ করে বল বলেছেন: “… proportional representation ‘always coincides with a multi-party system.” উদাহরণ হিসাবে বলা হয় যে ফ্রান্স, জার্মানী ও ইতালীতে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের জন্য রাজনীতিক দলের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বহু দল-ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এই ধরনের নির্বাচন পদ্ধতির ফলে কোন রাজনীতিক দল সাধারণত এককভাবে আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারে না। বহু-দল-ব্যবস্থার জন্য স্থায়ী সরকার গঠনের ক্ষেত্রে সমস্যার এবং রাজনীতিক অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের পদ্ধতি অনেক রকমের হয়। তারমধ্যে অন্যতম হল তালিকা পদ্ধতি (The List System)। তালিকা পদ্ধতি অনুসারে প্রতিটি রাজনীতিক দলের মনোনীত প্রার্থী তালিকার উপর ভোট প্রদত্ত হয়। এবং দলীয় তালিকার পক্ষে প্রাপ্ত ভোট সংখ্যার ভিত্তিতে রাজনীতিক দল সংশ্লিষ্ট নির্বাচন কেন্দ্রে আসন লাভ করে। ইতালী, বেলজিয়াম, সুইডেন, ডেনমার্ক প্রভৃতি দেশে এই পদ্ধতি পরিলক্ষিত হয়। এই তালিকা পদ্ধতি সম্পর্কে বল মন্তব্য করেছেন: “The list system will increase the power of the parties over the candidates since the party decides the order of the candidates on the party list, but there is no evidence for countries such as Sweden or Italy that the list system encourages party splits or increases the number of parties.” এ প্রসঙ্গে বলের আরও অভিমত হল: “This is not to say that proportional representation ’causes’ an increase in the number of parties, but that it tends to prevent a reduction.”

দ্বিতীয় ব্যালট পদ্ধতি ও দলের সংখ্যা বৃদ্ধি:

এ প্রসঙ্গে দ্বিতীয় ব্যালট (Second Ballot) পদ্ধতির কথাও বলা হয়। নির্বাচনের এই পদ্ধতিও রাজনীতিক দলের সংখ্যা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। দ্বিতীয় ব্যালট পদ্ধতি সম্পর্কে বল মন্তব্য করেছেন: “A second ballot certainly reduces the number of seats held on a minority vote, and it increases the power of the local party organisations. against the central organisations because of the need to bargain with other parties at local level before the second ballot.”

ভোট পদ্ধতি ও দলের ক্ষমতার হ্রাস বৃদ্ধি:

আবার রাজনীতিক দলের শক্তির হ্রাস-বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও ভোট পদ্ধতির পরিবর্তনের প্রভাবকে অস্বীকার করা যায় না। যেমন সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও এক ভোটপত্র পদ্ধতির পরিবর্তে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের পদ্ধতির প্রয়োগ করলে কোন কোন রাজনীতিক দলের আইনসভায় সদস্যসংখ্যার হ্রাস বা বৃদ্ধি ঘটতে পারে। বল বলেছেন: “Thus the electoral sys tem is an important factor in the character of the party system whether it distorts elec toral opinion or whether it is passive reflector of opinion.” আইনসভায় দলীয় প্রতিনিধিদের উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার ব্যাপারে রাজনীতিক দলের ক্ষমতা বহুলাংশে নির্বাচন ব্যবস্থার দ্বারা প্রভাবিত হয়। তা ছাড়া কোন রাজনীতিক দল জাতীয় বা স্থানীয় স্বার্থ ও মতামতকে প্রতিফলিত করবে তাও অনেকাংশে নির্বাচন ব্যবস্থার প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার উপর নির্ভরশীল। বল বলেছেন: “It (electoral system) has some influence on the degree of discipline parties can impose on their legislative representa tive, and whether the parties reflect national or local interests and opinions.”

নির্বাচন ব্যবস্থা একমাত্র নয়, অন্যতম উপাদান প্রবক্তাগণ:

প্রকৃত প্রস্তাবে রাজনীতিক দল-ব্যবস্থার উপর নির্বাচন পদ্ধতির প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার অস্তিত্ব অনস্বীকার্য। তবে এ ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারকারী উপাদান হিসাবে নির্বাচন ব্যবস্থা হল অন্যতম, একমাত্র নয়। অর্থাৎ নির্বাচন ব্যবস্থা রাজনীতিক দলের চেহারা চরিত্রের একমাত্র নির্ধারক নয়। তা যদি হত, তা হলে যে সমস্ত দেশে একই রকম নির্বাচন ব্যবস্থা বর্তমান সেই সমস্ত দেশের রাজনীতিক দলের সংখ্যা, ভূমিকা, প্রভাব-প্রতিপত্তি প্রভৃতি অভিন্ন হত। বাস্তবে কিন্তু তা হয় না। গ্রেট ব্রিটেন ও ভারত উভয় দেশেই পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষের নির্বাচনের ব্যাপারে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও এক-ভোটপত্র পদ্ধতি বর্তমান। কিন্তু এই দু’টি দেশের রাজনীতিক দলের সংখ্যা অভিন্ন নয়। বস্তুত এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, আঞ্চলিক ও জাতিগত বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র্য প্রভৃতিও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে বিবেচিত হয়। বল বলেছেন: “the electoral system is only one factor. Canada has a similar electoral system to that of the Newzealand but federalism and ethnic politics produce more political parties at a national level.”

উপসংহার: রাজনীতিক দল-ব্যবস্থার উপর নির্বাচন ব্যবস্থার প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে তথ্যমূলক। দলীয় ব্যবস্থার চেহারা-চরিত্র নিরূপণের ক্ষেত্রে আনুষঙ্গিক আর্থ-সামাজিক ও ঐতিহাসিক উপাদানের উপর নির্বাচন পদ্ধতির প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার প্রাসঙ্গিকতা পর্যালোচনা করা আবশ্যক। তা ছাড়া জনমতের প্রতিফলনের ব্যাপারে আন্তরিক উদ্যোগের পরিবর্তে সরকারের স্থায়িত্ব অধিকতর কাম্য কিনা এ প্রসঙ্গে মূল্যায়নসূচক বিচার-বিবেচনা বাঞ্ছনীয়। বল বলেছেন: “The arguments over the consequences of electoral systems are firstly factual ones, whether a particular system has certain. effects and the relevance of these effects to other social, economic and historical factors, in regards to the nature of the party system. Secondly, there are evaluative considerations such as whether stability of government is a more desirable aim than an attempt to faithfully represent public opinion.”

Rate this post