প্রতিনিধিদের সংজ্ঞা সম্পর্কে মতপার্থক্য

জনগণের সরাসরি শাসন বা প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের দিন অতিক্রান্ত। কারণ বর্তমানে প্রতিটি রাষ্ট্রের আয়তন বিশাল এবং জনসংখ্যা বিপুল। এই অবস্থায় প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অসম্ভব। তাই বর্তমানে গণতন্ত্র বলতে প্রতিনিধিত্বমূলক পরোক্ষ গণতন্ত্রকে বুঝায়। প্রতিনিধিত্বের তাত্ত্বিক বিন্যাসের উপর প্রতিনিধিত্বের প্রকৃত লক্ষ্য এবং প্রতিনিধিত্বের যথার্থ পদ্ধতি নির্ভরশীল। তাই প্রতিনিধিত্বের তত্ত্বের উপর আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বিশেষভাবে জোর দেন। কিন্তু প্রতিনিধিত্বের একটি যথার্থ ও সর্বজনগ্রাহা সংজ্ঞার ব্যাপারে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা যায়। উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের প্রতিনিধি হিসাবে আইনসভাকে নির্দেশ করা হয়। এই দিক থেকে অনেকে ব্রিটিশ জনগণের প্রতিনিধি হিসাবে ব্রিটিশ কমন্সসভার কথা বলেন। আবার হিটলারের মত নাৎসীবাদী এবং মুসোলিনীর মত ফ্যাসীবাদী একনায়কগণও নিজেদের জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধি হিসাবে দাবি করেছেন। Modern Government and Politics শীর্ষক গ্রন্থে অ্যালান বল বলেছেন: “… but there is often confusion over what is meant by the term representation’. Adolf Hitler once said that he had the greatest claim to be called representative of his people….. The British House of Commons is said to be a representative assembly, but this does not mean that it mirrors the geographical, class, sex, age and religious distribution of the British population.”

প্রতিনিধিত্বের পদ্ধতি ও প্রকৃতি প্রসঙ্গে মতপার্থক্য

সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থার ধারণা অনুসারে জনসাধারণের প্রতিনিধি হিসাবে শ্রেণীবৈষম্যহীন ও শোষণহীন সমাজব্যবস্থায় আইনসভার কথা বলা হয়। সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থার সমর্থকরা উদারনীতিক রাজনীতিক ব্যবস্থার আইনসভাকে যথার্থ জনপ্রতিনিধি হিসাবে স্বীকার করেন না। তাঁদের মতানুসারে এই আইনসভা হল সমাজের আর্থনীতিক দিক থেকে প্রতিপত্তিশালী সংখ্যালঘু শ্রেণীর প্রতিনিধিপুষ্ট সংস্থা। একে জনসাধারণের প্রকৃত প্রতিনিধি বলা যায় না। কারণ এই আইনসভা যতাদন পর্যন্ত সমাজের প্রাধান্যকারী শ্রেণীর স্বার্থের অনুকূল ভূমিকায় থাকে ততদিন তা বহাল থাকে। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে এই আইনসভা শোষক শ্রেণীর হাতিয়ার হিসাবে কাজ করে। আবার উদারনীতিক রাজনীতিক ব্যবস্থার সমর্থকরা সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থাকে প্রকৃতিগত বিচারে অগণতান্ত্রিক বলে অভিযুক্ত করেন। অর্থাৎ প্রতিনিধিত্বের সংজ্ঞা, পদ্ধতি ও প্রকৃতি প্রসঙ্গে রাষ্ট্র-বিজ্ঞানীদের মধ্যে ব্যাপক মতপার্থক্য বর্তমান। বল বলেছেন: “Naturally, there are wide variations in the form of representative government and the selection process of the representatives….”

প্রতিনিধিত্বের সংজ্ঞা

বস্তুত জনগণ ও নির্বাচিত ব্যক্তিদের মধ্যে পারস্পরিক আনুগত্য ও দায়িত্বশীল সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে যথার্থ জনপ্রতিনিধিত্বের পরিচয় পাওয়া যায়। সাধারণভাবে বলা যেতে পারে যে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের ভিত্তিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের দ্বারা নির্বাচিত ও সমর্থিত এবং নির্বাচনের প্রাক্কালে জনগণকে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি অনুসারে জনকল্যাণ সাধনে সক্রিয়ভাবে উদ্যোগী ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিগণই জনসাধারণের প্রকৃত প্রতিনিধি হিসাবে পরিগণিত হন।

প্রতিনিধিত্বের আধুনিক তত্ত্ব ও সমস্যাদি সম্পর্কে বলের অভিমত

আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে বল তাঁর Modern Politics and Government শীর্ষক গ্রন্থে প্রতিনিধিত্বের আধুনিক তত্ত্ব ও সমস্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত ও তথ্যনিষ্ঠ আলোচনা করেছেন। আধুনিক অধিকাংশ রাজনীতিক ব্যবস্থা মূলত দুটি মৌলিক ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত। (১) সার্বভৌম ক্ষমতা জনসাধারণের হাতেই ন্যস্ত আছে, তাই সরকার জনসাধারণের কাছে দায়িত্বশীল। (২) সংখ্যালঘিষ্ঠের ইচ্ছার তুলনায় সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছা অধিক গুরুত্বপূর্ণ।

বল বলেছেন: “….most of these political systems share two basic concepts of representation first, that sovereignty lies with the people and therefore the government is responsible to the people, second, that the will of the majority is more important than that of the minorities.” তবে এই দু’টি ধারণা অর্থবহ হতে পারে বিভিন্ন রাজনীতিক ব্যবস্থা ও শাসনতান্ত্রিক কাঠামোয় প্রযুক্ত হলে। আবার জনগণের প্রকৃত অর্থ কি এবং কিভাবে ইচ্ছা প্রকাশিত হবে এ বিষয়েও সমস্যা দেখা দেয়। চুক্তিবাদী ফরাসী দার্শনিক রুশোর মতানুসারে সার্বভৌম ক্ষমতার হস্তান্তর বা কারও মাধ্যমে এই ক্ষমতার প্রকাশ অসম্ভব। রুশো প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রকে সমর্থন করেছেন। তিনি ইংল্যাণ্ডের জনগণের স্বাধীনতার ধারণাকে স্বীকার করেননি। তার মতানুসারে কেবল আইনসভার সদস্য নির্বাচনের সময়েই ব্রিটিশ জনগণ স্বাধীন। আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতারাও ইংল্যাণ্ডের রাজতন্ত্র এবং পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করেননি ঠিক, কিন্তু জনগণের সার্বভৌমত্বের উপরও খুব বেশী গুরুত্ব আরোপ করেননি। বল মন্তব্য করেছেন: “The Euro pean medieval basis of representation was locked in the concept of corporate hierarchies.”

প্রকৃত প্রস্তাবে ঊনবিংশ শতাব্দীর আগে জনগণের সার্বভৌমত্ব ও সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিনিধিত্ব সম্পর্কে তাত্ত্বিক আলোচনা করা মোটেই সহজ ছিল না। বল বলেছেন: “It is difficult to talk of theories of representation with the two underlying concepts of popular sovereignty and majority rule in modern terms before the nineteenth century.”

যাইহোক বল প্রতিনিধিত্ব সম্পর্কিত আধুনিক তত্ত্বগুলিকে দু’ভাগে বিভক্ত করেছেন: (১) প্রতিনিধিত্বের উদারনীতিক গণতান্ত্রিক তত্ত্ব (Liberal Democratic Theories of Representation) এবং (২) প্রতিনিধিত্বের সমষ্টিবাচক তত্ত্ব (Collective Theories of Representation)।

প্রতিনিধিত্বের আধুনিক তত্ত্বসমূহ সম্পর্কিত উপরিউক্ত শ্রেণীবিভাগ প্রসঙ্গে বল মন্তব্য করেছেন: “Neither category can be completely isolated from the other, for as we shall see they both have common intellectual origins, and moreover we shall find several different approaches under these common heading.”

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার যে প্রতিনিধিত্বের প্রাচীন তত্ত্বগুলি একেবারে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায় নি। প্রতিনিধিত্ব সম্পর্কিত তত্ত্বসমূহের ঐতিহাসিক ক্রমবিকাশের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিনিধিত্বের প্রাচীন ও আধুনিক তত্ত্বগুলির আলোচনা করা আবশ্যক। এ প্রসঙ্গে বল মন্তব্য করেছেন: “These older views on representation are important because the break with the past is not a dramatic one, and many of these older theories remain, intertwined with modern theories of representation.”

Rate this post