রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি প্রেম তথা পৃথিবী প্রীতি আশৈশব। বিভিন্ন রচনায় তিনি কৈশোর লগ্ন থেকেই সেই পৃথিবীপ্রেমের দুরন্ত আবেগ প্রকাশ করেছেন। ‘মানসী’ পর্বের ‘অহল্যার প্রতি’, ‘সোনার তরী’, ‘সমুদ্রের প্রতি’, ‘বসুন্ধরা’, ‘ছিন্নপত্রের বিভিন্ন পত্রে কবির বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় একাত্মতার অনুভবটি বারবার প্রকাশিত হয়েছে।

‘বসুন্ধরা’ কবিতায় প্রথমেই পৃথিবীমাতৃকার প্রতি কবি আকুল আহ্বান করেছেন ‘নির্জন-বিচ্ছিন্ন-একাকীত্ব থেকে বাৎসল্যসিঙ্খিত স্নেহময় ক্রোড়ে টেনে নেবার জন্য। কবি বর্তমানে নির্জন একাকীত্বে নির্বাসিত। কিন্তু তাঁর হৃদয়ে জন্ম-জন্মান্তরের চেতনাপ্রবাহের স্মৃতি জাগরুক হয়ে আছে। পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকে তিনি শৈবালরূপে, তৃণরূপে, গুস্মরূপে, বৃক্ষলতারূপে প্রাণের প্রবাহ মধ্যে মিশ্রিত হয়েছিলেন। দিগন্তরেখাহীন সমুদ্রের কল্লোলে, আকাশস্পর্শী পর্বতের স্তব্ধতায়, মরুভূমির মহাতৃষ্ণার মধ্যে তাঁর প্রাণপ্রবাহ অভিব্যক্ত হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বিচিত্র মানবগোষ্ঠীর বিভিন্ন জীবনলীলায় তিনি যুগে যুগে প্রাণতরঙ্গে ভেসেছেন। শুধু অতীত নয়, অনাগতকালেও একইভাবে অখণ্ড সেই প্রাণপ্রবাহ প্রবাহিত হবে বলে কবি বিশ্বাস করেন। তাই কবি বসুন্ধরার সঙ্গে এক তীব্র একাত্মতা অনুভব করেছেন।

বিশ্বাত্মক এই অনুভূতি থেকেই কবি বসুন্ধরার স্নেহময় কোলে ফিরতে চেয়েছেন। মা যেমন শিশুকে তাঁর স্নেহময় অঞ্চলতলে টেনে নেন, কবিকেও বসুন্ধরা জননী যেন তেমনি আন্তরিকতায় টেনে নেন—এই প্রার্থনা কবির। কবি চেয়েছেন, পৃথিবীর মৃত্তিকার মধ্যে সম্পূর্ণভাবে মিশ্রিত হয়ে যেতে; মৃন্ময়ী পৃথিবীর সঙ্গে এই মিলনে বসন্তের পুলক অনুভব করেছেন কবি। হৃদয়ের সংকীর্ণ প্রাচীর ভেদ করে প্রবল জীবনাবেগে হিল্লোলিত, বিচ্ছুরিত, শিহরিত হয়ে কবি ভূলোকের চতুর্দিকে ব্যাপ্ত হয়ে যেতে চেয়েছেন। শৈবালে, তৃণে, বৃক্ষ শাখায়, পল্লবের মধ্যে নিগূঢ় জীবনরসে তিনি সরস হয়ে উঠতে চান, স্পর্শ করতে চান স্বর্ণশীর্ষভারে আনত শস্যক্ষেত্র, প্রস্ফুটিত কুসুমের মধ্যে সৌন্দর্যরূপে, গন্ধরূপে, অমৃতরূপে তিনি পূর্ণ হয়ে উঠতে চান। নীল সমুদ্রের ভরঙ্গে তাঁর জীবনোচ্ছ্বাস কল্লোলিত হয়ে উঠতে চেয়েছে, পর্বতশৃঙ্গের নিস্তব্ধতায় তুষাররূপে তাঁর প্রাণ ব্যাপ্ত হতে চেয়েছে।

দুর্গম মরুপ্রদেশে পৃথিবী যেখানে উত্তপ্ত বালুশয্যায় শয়ান, হিমশৈলে যেখানে পৃথিবী ধ্যানগম্ভীর, মেরু অঞ্চলে যেখানে পৃথিবী তুষারাবৃতা নিরাভরণ-প্রকৃতির—সেই বিচিত্র প্রকাশের মধ্যে কবি অভিব্যক্ত হয়ে উঠতে চান। বসুন্ধরার বিচিত্র সেই সৌন্দর্যকে তিনি স্পর্শ করতে চান।

সমুদ্রতটে ছোট্ট গ্রামমধ্যে যেখানে একটি ক্ষুদ্র শাস্ত পল্লীজীবন প্রবাহিত হয়ে চলেছে, কবি সেই জীবনস্রোতকে আকণ্ঠ আস্বাদ করতে চান। উইদুগ্ধপানকারী মরুবাসী আরব সন্তানদের মধ্যে, তিব্বতের বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের শান্ত নির্লিপ্ত জীবনপ্রবাহে, দ্রাক্ষাপায়ী গোলাপকাননবাসী পারসিকদের জীবনে, নির্ভীক অশ্বাবুঢ় তাতারদের জীবনধারায় নিজেকে মিশ্রিত করার তীব্র বাসনা কবির। এমনকি, আদিম অরণ্যবাসী ধর্মহীন-আচারহীন জনগোষ্ঠীর হিংস্র উল্লাসের মধ্যেও তিনি জীবনরস পান করতে চান। শুধু মনুষ্যজীবনই নয়, অরণ্যপ্রাণী—যেমন হিংস্র ব্যাঘ্রের সরল উজ্জ্বল গতিময়তার প্রাণরসও আস্বাদ করতে চান কবি।

প্রভাতসূর্যের নির্মলতায় অরণ্যে ভূধরে পল্লবে-পুষ্পে তিনি হিল্লোলিত হতে চান, শ্যাম তৃণক্ষেত্রে তরঙ্গিত হতে চান, মানব ও পশুপক্ষীর ক্লান্ত নয়নে তিনি নিদ্রারূপে নেমে আসতে চান এবং এইভাবেই তিনি সমগ্র বিশ্বে ব্যাপ্ত হয়ে যেতে চান।

পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন ধারায় যে জীবনস্রোত বিচিত্র সৌন্দর্যে প্রবাহিত, সেই জীবনস্রোতের অন্তঃস্থলে কবি ফিরতে চেয়েছেন। সন্ধ্যার কিরণে গ্রামপথে ধূলি উড়িয়ে যেখানে গাভীগুলি গোষ্ঠে ফেরে, তরুশ্রেণিঘেরা গ্রাম থেকে ধোঁয়া ওঠে আকাশে, জনশূন্য বেলাভূমির প্রান্ত দিয়ে যেখানে চাঁদ ওঠে, কবি সেই রূপময় জীবনের মধ্যে নিজ প্রাণপ্রবাহকে, আত্মচৈতন্যকে মিশ্রিত করতে চান। বসুন্ধরার অণু-পরমাণুর মধ্যে আত্মচৈতন্যের এই নিঃশেষ মিশ্রণের মধ্য দিয়েই তিনি বসুন্ধরার বুকে ফিরতে চেয়েছেন।

Rate this post