অথবা, ধাতু যুগ সম্পর্কে আলােচনা কর।
ভুমিকাঃ প্রাচীন সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারাবাহিকতায় প্রাচীন যুগকে প্রধানত চার ভাগে ভাগ করা হয়। যথা- ১। প্রস্তর যুগ, ২। তাম্র যুগ, ৩। ব্রোঞ্জ যুগ, ৪। লৌহ যুগ। এর মধ্যে তাম্র, ব্রোঞ্জ ও লৌহ যুগকে একত্রে ধাতু যুগ বলে।
তাম্র যুগঃ যে যুগে হাতিয়ার ব্যবহার শুরু করে সে যুগকে তাম্র যুগ বলে। নব্য প্রস্তর যুগ ও ব্রোঞ্জ যুগের মধ্যবর্তী কাল হলাে তাম্র যুগ। তাম্র যুগে সমাজ অনেকটা এগিয়ে যায়। তুলনামূলক উন্নত ধরনের হাতিয়ার তৈরী হয়।
বিস্তৃতিঃ ইরান, আনাতােলিয়া, নিকটপ্রাচ্য, বলকান, মিশর ইরাক, ভারত প্রভৃতি অঞ্চলে তাম্র যুগের হাতিয়ার পাওয়া গেছে।
জীবনযাত্রাঃ তাম্র যুগে প্রাপ্ত শিল্প কর্ম বিশেষ করে স্থাপত্য কলা, মৃৎপাত্রের মডেলিং, বুনন, কৃষিকাজ, মৎস্য শিকারের হাতিয়ার দেখে বুঝা যায়, সে যুগের জীবনযাত্রা কেমন ছিল। সে সময় গৃহের মধ্যেই কুমারের কারখানা, রান্নার স্থান ও বাসস্থান পৃথকভাবে নির্দিষ্ট থাকতাে।
ব্রোঞ্জযুগঃ খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ থেকে ৩০০০ অব্দের মধ্যে মিশর, ভারত, মেসােপটেমিয়া এবং চীনে ব্রোঞ্জের ব্যবহার শুরু হয় এবং তা ১৪০০ অব্দ পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এ যুগে মানুষ টিনের সঙ্গে তামা মিশিয়ে ব্রোঞ্জ তৈরী করতে ও তা দিয়ে অনেক উন্নতমানের হাতিয়ার তৈরী করতাে। ব্রোঞ্জ যুগের বৈশিষ্ট্যগুলাে হলাে-
(১) ব্রোঞ্জ নির্মিত হাতিয়ারঃ এ যুগের মানুষ ব্রোঞ্জের দ্বারা নানা ধরনের হাতিয়ার নির্মাণ শুরু করে। যেমনঃ বর্ম, শিরস্ত্রাণ, তলােয়ার, বর্শা, তীর এ যুগের উল্লেখযােগ্য হাতিয়ার।
(২) ব্যবসায়-বাণিজ্যের আন্তর্জাতিক রূপঃ ব্রোঞ্জ যুগেই ব্যবসা-বাণিজ্য সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক রূপ লাভ করে। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দ থেকে ভূ-মধ্যসাগর, আরবসাগর, বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরের ওপর দিয়ে নিয়মিতভাবে পাল তােলা বড় বড় নৌকা যাতায়াত করতাে। সমুদ্র পথে যাতায়াতের জন্য মানুষেরা আকাশের তারা দেখে দিক নির্ণয় করতাে ও এ সময় মানুষ সমুদ্র পথে যাতায়াতের নিয়ম-কানুন চালু করেছিল।
(৩) স্থায়ী বসতি নির্মাণঃ ব্রোঞ্জ যুগে মানুষ অধিক জনসমষ্টি মিলে বড় স্থায়ী মানব সমাজ গড়ে তুলেছিল। গাছের গুড়ির ওপর ঘরের ছাউনী দিয়ে ঘর নির্মাণ করতাে। এ যুগের শেষদিকে মানুষ শবদাহ করার রীতি প্রচলন করে।
(৪) লিখন পদ্ধতির উন্নতিঃ নব্য প্রস্তর যুগে যে লিখন পদ্ধতির সূত্রপাত হয়েছিল তা ব্রোঞ্জ যুগে যথেষ্ট উন্নতি লাভ করে।
(৫) চাকা তৈরিঃ চাকা আবিষ্কৃত হওয়ায় এ যুগের মানুষ চাকাওয়ালা গাড়ি যানবাহন হিসেবে ব্যবহার করতাে। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দে মেসােপটেমিয়া ও সিরিয়ায় যাত্রীবাহী, পণ্যবাহী প্রভৃতি নানা ধরনের চাকাওয়ালা গাড়ির প্রচলন শুরু হয়।
(৬) ব্রোঞ্জযুগে মানুষের জীবনযাত্রাঃ ব্রোঞ্জ যুগের প্রাপ্ত নিদর্শন যেমন:মৃৎপাত্র, হাতিয়ার, যন্ত্রপাতি, স্থাপত্য ইত্যাদি থেকে বুঝা যায়, তাদের জীবনযাত্রা কেমন ছিল। আনাতােলিয়ার কৃষকদের জীবনধারা সাদাসিধে ছিল। তারা পাথরের ভিতের ওপর ঘর নির্মাণ করতাে। কাঠ দিয়ে তারা ছাদ নির্মাণ করতাে। গরু, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি নানা গৃহপালিত পশু পালন করতাে।
লৌহ যুগঃ খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে মধ্যপ্রাচ্যে ও খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দে ব্রিটেনে লৌহের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়। এশিয়া মাইনরে হিটটিদের মধ্যে সর্বপ্রথম লৌহ শিল্পের ব্যবহার জানা যায়। এ যুগে লৌহ নির্মিত কুঠার ও লাঙ্গলের ফলা আবিষ্কৃত হয়। ফলে অকর্ষিত ভূমি পরিষ্কার ও কৃষিকাজ আরাে সহজতর হয়। লােহার যন্ত্রপাতি ব্যবহারে জমির ফলন আগের তুলনায় বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ লৌহ কৃষিতে আনে এক নবতর বিপ্লব। আধুনিক সভ্যতার ভিত্তি হচ্ছে লৌহ। মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশে উচ্চস্তর হলাে লৌহযুগ। মিশর ছাড়াও আফ্রিকার মানুষ প্রস্তর যুগ থেকে সরাসরি লৌহ যুগে প্রবেশ করে। ইউরােপ ও মিশরে আবিষ্কৃত ধ্বংসাবশেষ থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। হিব্রাইটকেই সাধারণত লৌহ সংস্কৃতির আদি উৎপত্তিস্থল হিসেবে ধরা হয়। ১২৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মিশরের ফারাও হিটাইট রাজার কাছ থেকে লােহা সরবরাহের অনুরােধ করে চিঠি লিখেন। ইউরােপের ছানিয়ুন, ক্রীট দ্বীপ ও গ্রিসে খ্রিস্টপূর্ব ১১ শতকে লৌহ যুগের সূচনা হয়।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, ধাতু যুগ মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ধাতুর যুগে মানুষের জীবনযাত্রা প্রস্তর যুগের তুলনায় অনেক উন্নত ছিল। ধাতু যুগের ধারাবাহিকতায় মানব সমাজ-আজকের এই আধুনিক যুগে এসে পৌছেছে। ধাতু যুগের অনেক আবিষ্কার এখনাে আধুনিক সমাজে হুবহু ব্যবহৃত হয়। সুতরাং বলা যায়, সভ্যতার বিকাশে ধাতু যুগ অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। ধাতু যুগ থেকেই মানুষের ব্যবহৃত হাতিয়ারের ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয়।