অমিতাভ দাশগুপ্তের ‘আমার নাম ভারতবর্ষ’ কবিতায় কবির প্রতিবাদী সংগ্রামের স্বর ও সেই সংগ্রামের প্রতি সহমর্মিতাই গড়ে তুলেছে ভারতবর্ষের মানচিত্র- আলোচনা করো।

কবি অমিতাভ দাশগুপ্তের ‘আমার নাম ভারতবর্ষ’ কবিতাটি আপাতসরল বিবৃতিধর্মিতার মধ্যেও কবির তীব্র ও আন্তরিক স্বদেশচেতনার পরিচয়বাহী। কর্মজীবনে ভারতবর্ষের তথা বাংলা ও সন্নিহিত প্রদেশের মাটি-মানুষের ঘনিষ্ঠ পরিচয় অমিতাভ দাশগুপ্তের কবি চেতনাকে যে নিবিড় রূপ দান করেছিল, তা-ই মূলত তাঁর এই স্বদেশচেতনার বীজ রোপণ করেছিল। সেইসঙ্গে মার্কসবাদ চর্চা ও কমিউনিজমে দীক্ষা এই স্বদেশচেতনাকে পরিপুষ্ট করেছে।

আসলে শ্রমিক বস্তি ও শ্রমজীবী মানুষের সন্নিহিত থাকার কারণেই অমিতাভ দাশগুপ্তের কবিদৃষ্টি প্রথম থেকেই এক মোহহীন বাস্তবদৃষ্টি লাভ করতে পেরেছিল। এই বাস্তবদৃষ্টি, মানুষের প্রতিনিয়ত জীবনসংগ্রামকে কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা এবং মার্কসবাদী জীবনবীক্ষা তাঁর স্বদেশকে রূপ দিয়েছে। এইজন্যই অমিতাভ দাশগুপ্তের স্বদেশ কোনো ভারতমাতার রোমান্টিক মূর্তি নয়, রাজনৈতিক রেখায় আঁকা খণ্ডিত কোনো মানচিত্র নয়। কবির স্বদেশ বা ভারতবর্ষ অগণিত কৃষকশ্রমিকের রক্ত ও জীবনমূল্যে রচিত এক অনাড়ম্বর মানবিক জীবনচর্যা, শ্রমজীবী মানুষের প্রতিনিয়ত জীবনসংগ্রাম এবং যাবতীয় আক্রমণ ও প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধী সংগ্রামেরই প্রতীক।

তবে উনিশ শতকের ভারতীয় স্বদেশ-চেতনার সঙ্গে কমিউনিস্ট আদর্শে দীক্ষিত কবি অমিতাভ দাশগুপ্তের স্বদেশচেতনার স্বভাবতই স্পষ্ট পার্থক্য আছে। কেননা, ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের বজ্রশৃঙ্খল থেকে মুক্তির জন্য উনিশ শতকের স্বদেশ চেতনায় ক্রিয়াশীল ছিল আত্মদানের তীব্র আবেগ এবং এই স্বদেশীর আবেগের পিছনে আসলে প্রেরণা জুগিয়েছিল ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের মন্ত্র। আবেগসর্বস্ব সেই স্বদেশচেতনায় ভাববাদ ও অধ্যাত্মবাদ তাই এমনভাবে পাকাপোক্ত আসন পেতেছিল। হিন্দুমেলা থেকে শুরু করে বন্দেমাতরম্ মন্ত্র, সম্ভানদল থেকে গীতশ্লোক ও মাতৃকামূর্তিরপূজা—এসবের মধ্যেই নিহিত ছিল সেই ভাববাদী ও অধ্যাত্মবাদী দৃষ্টি।

কিন্তু বিশ্বযুদ্ধোত্তর এবং ভারতবর্ষের স্বাধীনতা-উত্তর কবিভাবনা ও কবির স্বদেশ ভাবনা সঙ্গতকারণেই সেই পুরোনো আবেগের দ্বারা অনুসৃত নয়। বিশ্বযুদ্ধ আধুনিক কবিকে যেমন একদিকে দেখিয়ে দিয়েছে পাশ্চাত্য ধনতান্ত্রিক সভ্যতার সাম্রাজ্যবাদী লোভের বীভৎসতা, অন্যদিকে সোভিয়েতে সমাজতান্ত্রিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ শ্রমজীবী মানুষের সংহতির অসামান্য শক্তি।

ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে যে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ আবেগনির্ভর পথে স্বদেশপ্রেমের বন্দনা করেছিল একদিন, দ্বিখণ্ডিত স্বাধীনতার স্বপ্নভঙ্গ সেই স্বদেশপ্রেমের আবেগকে অনেকটাই মুছে দিল। তারপর স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রযন্ত্র গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের মিথ্যা স্তোকবাক্যে ক্রমাগত ধনতন্ত্রেরই তোষণ করে চলল। স্বাধীন দেশের শ্রমিক-কৃষক নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী মানুষের কাছে স্বাধীনতা পরিণত হল অর্থহীন প্রহসনে। স্বাধীন দেশের সরকারের বিরুদ্ধেই জেগে উঠল শ্রমিক-কৃষকের বিদ্রোহ। উন্নয়নের নামে, শিল্পবিকাশের নামে ক্রমাগত নিরাপত্তাহীনতার দিকে ঠেলে দেওয়া হল অগণিত কৃষিজীবী মানুষ ও মেহনতী মানুষকে। আধুনিক কবির কাছে ভারতবর্ষ তাই কোনো মানচিত্র নয়, কোনো মাতৃকামূর্তিও নয়; কবির ভারতবর্ষ এই প্রতিবাদী শ্রমজীবী মানুষের সুস্থ জীবনের স্বপ্ন, তাদের গুলিখাওয়া বুকের আর্তনাদ, তাদের প্রতিবাদী প্রাণের সম্মিলিত শক্তি। কবিতার সূচনাতেই কবি তাই উচ্চারণ করেন সেই নতুন স্বদেশচেতনার কথা— 

“স্টেনগানের বুলেটে বুলেটে

আমার ঝাঁঝরা বুকের ওপর ফুটে উঠেছে যে মানচিত্র 

তার নাম ভারতবর্ষ।”

কবির এই স্বদেশচেতনা কোনো কলকাতাকেন্দ্রিক নাগরিক স্বপ্নের সংকীর্ণতাতেও বদ্ধ থাকে না। কবির সেই স্বদেশ উঠে আসে উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিমব্যাপী ভূগোলের সামগ্রিকতায়। কফি খেত, চা বাগান থেকে শুরু করে। কয়লাখাদান, পাহাড়, অরণ্য—যেখানেই এই শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম, সেখানেই নেমে আসে শাসকবেশী শোষকের বোমা বন্দুক-বেয়নেট; যেখানেই রক্ত ঝরে খনিতে, খেতে, কলকারখানার মাটিতে, সেখানেই সেই সংগ্রামী মানুষের রক্তচিহ্ন ফুটে ওঠে কবির স্বদেশের মানচিত্র—

‘‘আমার প্রতিটি রক্তের ফোঁটা দিয়ে 

চা-বাগিচায় কফি খেতে, 

কয়লা খাদানে, পাহাড়ে অরণ্যে 

লেখা হয়েছে যে ভালোবাসা

তার নাম ভারতবর্ষ।”

কবির মনে হয়, এই কৃষক-শ্রমিকের অস্থির ফসফেটেই উর্বর হয় এদেশের মাটি, আর তাদেরই স্বপ্নে বোনা ‘ধান ও গানের স্বপ্ন’ দিয়ে গড়া হয় এই ভারতবর্ষকে।

আসলে কবির এই স্বদেশচেতনার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে থাকে হাজার-লক্ষ মানুষের কান্না-ঘাম-রস্তু এবং প্রতিবাদী-প্রতিরোধী সংগ্রাম। স্বদেশকে যারা মুনাফার নেশায় ছিঁড়ে খায়, স্বদেশের সিংহাসন দখল করে, তাদের বিরুদ্ধে যারা স্বদেশকে ভালোবাসে লড়ে, কবির স্বদেশ গড়ে ওঠে তাদেরই ভালোবাসার উন্নতায়। পঞ্জাবের ভাকরা ও নাঙালের বাঁধের বুকে অস্তিত্বের লড়াই করে যে কৃষক ও শ্রমিক, আসামের ডিগবয়ের শ্রমিকের শরীর ভিজে যায় যে তৈলখনির উদ্‌গত তেলে, সেই সব উৎপাদন আর উন্নয়নের পশ্চাতেই রয়েছে শ্রমের মূল্য ও শ্রমিকের ভালোবাসা। তাই আজ যেখানে যেখানে সংগ্রামরত কৃষকের রক্ত ঝরে, শ্রমিকের বুকে বিধে যায় বেয়নেট, সেখানেই সমস্ত ভারতবর্ষের শ্রমিক-কৃষক-মেহনতী মানুষের সহমর্মিতা এসে সংহত হয়। ভাকা-নাঙাল এর মানুষ, ডিগবয়ের খনি শ্রমিক, আমেদাবাদের সুতোকলের মজুর, চা বাগান বা কফি খেতের মজুর, সমস্ত দেশের নানা প্রদেশের ‘হালবহনকারী বলরাম’ কৃষক সেই বিক্ষত রক্তাক্ত সৈনিক শ্রমজীবীর শরীর পাহারা দেয়, তাকে গ্রহণ করে স্নায়ুতে, ধমনীতে, চেতনায়। আর প্রতিটি ধর্ষিতা আদিবাসী যুবতীয় ক্রোধের বহ্নিজ্বালাতেই পরম মমতায় রচিত হয় সেই সৈনিকের চিতা।

শ্রেণিসংগ্রামের চেতনায় ঋদ্ধ কবি অমিতাভ দাশগুপ্তের স্বদেশচেতনাতেও তাই একদিকে থাকে শাসকের স্টেনগান-বেয়নেট, অন্যদিকে হাজার শ্রমিক কৃষকের মমতার স্রোতধারা। এই শ্রেণি-লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই একদিন ছন্দে সুরে জেগে উঠবে উৎসবের লগ্ন—

“ওড়িশির ছন্দে ভারত নাট্যমের মুদ্রায়

সাঁওতালি মাদলে আর ভাঙরার আলোড়নে 

জেগে উঠবে তুমুল উৎসবের রাত।”

সেই উদ্ভাসিত দিনে-রাতে কবি মনে করিয়ে দেন যেন ভারতবর্ষ কখনও এইসব বুকের রক্তঝরানো শ্রমিক কৃষকদের না ভুলে যায়। এই সংগ্রামী প্রতিরোধী মেহনতী মানুষের বুকেই শুধু বেঁচে থাকে কবির স্বদেশ আর ভবিষ্যতের উৎসবমুখর ভারতবর্ষ।

Rate this post