‘গানের আড়াল’ কবিতাটির বিষয়বস্তু প্রেম। প্রেম এমনই এক সম্পর্ক যাকে কেন্দ্র করে মানবজীবনে তৈরি হতে পারে নানান জটিলতা। প্রেমের একদিকে যেমন আছে’ মিলনের অসীম আনন্দ, অন্যদিকে তেমনি আছে বিরহের, তীব্র যন্ত্রণা হাহাকার-বিষণ্ণতা। কবি জীবনে হয়তো এমনই কোনো প্রেমের অনুভব কখনো এসেছিল যা তাকে মিলনের আনন্দ নয়, উপহার দিয়েছিল বিরহের তীব্র শূন্যতাবোধ-এর উপলব্ধি। আর প্রিয় বিচ্ছেদের সেই অভিজ্ঞতাই হয়তো শিল্পী কবিরত লেখনীতে কাব্যিক অবয়ব লাভ করেছে, প্রকাশ করেছে প্রেম সম্পর্কে কবির অন্যতর এক বোধকে।

সমগ্র কবিতাটি পড়বার পর বোঝাই যায় যে কবি তাঁর প্রণয়িনীকে তাঁর মন প্রাণ সর্বস্ব সমর্পণ করলেও কবি-প্রিয়ার কাছে তিনি কেবল তার কণ্ঠের হার হয়েই থেকে গেছেন, হৃদয়ের একান্ত আপনার জন হয়ে উঠতে পারেননি। আর সেখানেই কবির অভিমান প্রচ্ছন্ন রূপে প্রকাশ পেয়েছে। প্রেয়সীকে বাহুলতা বন্ধনে আবদ্ধ করতে না পারার যন্ত্রণা অবশ্যই তীব্র, তবে হৃদয়ের গভীর প্রেমকে প্রেমাম্মদের হৃদয় দুয়ার পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার বা ব্যক্ত করবার মতো অবকাশ না পেলে সে প্রেমের যন্ত্রণা আরও তীব্র। যদি সে প্রেম কেবল হৃদয়ের কথা হয়ে হৃদয়েই থেকে যায়, আর সেই বেদনাকে বুকে নিয়েই জীবনের বাকীটা পথ চলতে হয়, অথচ প্রেমাম্মদ তাকে বুঝেও না বোঝার ভান করে বা তাকে উপেক্ষা করে চলে যায় সে যন্ত্রণা সত্যিই গভীর যন্ত্রণা। ‘গানের আড়াল’ কবিতাটি-তে তেমনই এক যন্ত্রণা প্রকাশ পেয়েছে কবিতাটির ছত্রে ছত্রে। হৃদয়ের অনুভূতিই কথা আর সুরকে অবলম্বন করে গান-এর ভিতর দিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। আর সেই গানের আড়ালেই তো অনেক সময় হৃদয়ের অনেক না বলা কথা, অনেক গোপন বেদনা নীরবে লুকিয়ে থাকে। কিন্তু যে জন প্রেমের ভাব জানে না সে কি কখনো গানের আড়াল ছিন্ন করে তার অন্তরের অন্দর মহলের খোঁজ নিতে চায় ? বরং, সে তার হৃদয়ের এই অভাব প্রেমের মূল্যকে অবহেলা করে তার কাছে মিলন-মালার ফুল চেয়ে বসে আর নয় তো ‘অপরের বেদনার ঝুম্‌ঝুমি’ বাজিয়ে খেলা করে আনন্দ পায়। প্রেমের যে গভীর অনুভূতি, তাতেই প্রেম সবচেয়ে সত্য, প্রাপ্তি বা অপ্রাপ্তিটুকুই সব নয়, কিন্তু সবাই চাওয়া-পাওয়ার তুচ্ছ সীমাকেই প্রেমকে বেঁধে ফেলে আর প্রকৃত যে প্রেমিক সে তার ‘অন্তর তলের অন্তর-তর’ ব্যথা পরিচয় গ্রহণের কোনো চেষ্টাই কখনো করে না। এই সত্যটিকেই কবি তার অপূর্ব নির্মাণক্ষম প্রজ্ঞার সাহায্যে উপযুক্ত বাক্য বিন্যাস, শব্দচয়ন, বাক্যবিন্যাস ও সর্বোপরি তার উপস্থাপন ভঙ্গিমার ভেতর দিয়ে সুন্দরভাবে ব্যক্ত করেছেন। কবিতার বাক্য গঠন, শব্দ ব্যবহার অবশ্যই কবিচিত্তের প্রেমানুভব জনিত রোমান্টিক বিষণ্ণতার অনুগামী হয়েই প্রকাশ পেয়েছে। কবিতার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সর্বত্রই ব্যবহৃত বাক্যগুলি বেশ দীর্ঘ। রয়েছে একাধিক প্রশ্ন বাক্য যার মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে ‘প্রেম’ নামক মানবজীবনের এই জটিলতম সম্পর্কটিকে ঘিরে কবির নানা জিজ্ঞাসা, সংশয়, দ্বিধা, কৌতূহল ও বিস্ময়।

মোট পাঁচটি স্তবকে ২৮টি পঙ্ক্তিতে সমগ্র কবিতাটি রচিত। প্রথম স্তবকেই আছে প্রেমাদর্শ ঘিরে কবির পূর্বস্মৃতি—

‘তোমার কণ্ঠে রাখিয়া এসেছি মোর কণ্ঠের গান-

এইটুকু শুধু রবে পরিচয়? আর সব অবসান?’

কবির ভালোবাসা এতটাই গভীর যে বাইরের বিচ্ছেদ তার অন্তরের বিশ্বাসে ফাটল ধরাতে পারছে না। এই বিশ্বাসযোগ্যতার অভাবই কবির মনকে বারে বারে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন করে তুলেছে।

প্রথম স্তবকে এ জাতীয় মোট ৩টি প্রশ্ন বাক্য আছে—

১) “এইটুকু শুধু রবে পরিচয় ? আর সব অবসান?

অস্তর-তলে অস্তর তর যে ব্যথা লুকায়ে রয়, গানের আড়ালে পাও নাই তার কোনোদিন পরিচয়?”

২য় ও ৩য় স্তবকেও এসেছে একাধিক প্রশ্ন—

১) ‘গানের বাণী সে শুধু কি বিলাস, মিছে তার আকুলতা? (২য় স্তবক)

২) …উপকূলে ব’সে শুনেছ সে সুর, বোঝ নাই তার মানে? (২য় স্তক)

৩) ‘বেঁধেনি হৃদয়ে সে সুর, দুলেছে দুল হ’য়ে শুধু কানে? (২য় স্তবক)

৪) ‘সাগরের সেই ফুলে ফুলে’ কাঁদা কূলে কূলে নিশিদিন? (৩য় স্তবক)

৫) ‘সুরের আড়ালে মূৰ্চ্ছনা কাঁদে, শোনে নাই তাহা বীণ্?

৬) ‘আমার গানের মালার সুবাস ছুঁল না হৃদয়ে আসি’? 

৭) ‘আমার বুকের বাণী হ’ল শুধু তব কণ্ঠের ফাসি?

কবি তাঁর বিরহ-ব্যাকুলতা, শোকার্ত হৃদয়ের যন্ত্রণাকে ‘চাঁদ’, ‘সাগর’, ‘সুর’, ‘বীণা’ প্রভৃতির চিত্রকল্প প্রয়োগ করেছেন। যে চাঁদের আকর্ষণে সাগরে জোয়ার আসে, সেই চাঁদ অবশ্যই সাগরের জনস্ফীতির কারণ জানে।

প্রথম ও শেষ স্তবকটি চার পঙক্তির ২য় স্তবক ও ৩য় স্তবক ছয় পক্তির আর চতুর্থ স্তবক ছোটো পঙ্ক্তির। প্রথম ও শেষ স্তবকটিই সবচেয়ে ছোটো আর চতুর্থ স্তবকটি সবচেয়ে দীর্ঘ। স্তবকগুলি ভাবের প্রবাহকে ধারে রেখেছে। আবেগের প্রাবল্য বেশি হওয়ায় চতুর্থ স্তবকটি অন্যান্যদের তুলনায় একটু দীর্ঘ হয়েছে। শেষ স্তবকে মাত্র ৪টি পঙ্ক্তিতে কবির হৃদয়ের বক্তব্য অত্যন্ত সংহত আকারে প্রকাশ পেয়েছে। সমস্ত কবিতায় মূল কেন্দ্রবিন্দুটি যেন এই চারটি পঙ্ক্তিতেই নিহিত।

এখানে চাঁদ ও সাগর পরস্পরের প্রণয়ীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে এমনটা ভাবলে কবি ও কবি প্রিয়ার পারস্পরিক বিরহ যন্ত্রণার ছবিটি সুন্দরভাবে ফুটে ওঠে পাঠকের কাছে—

“যে চাঁদ জাগালো সাগরে জোয়ার, সেই চাঁদই শোনে নাই।

সাগরের সেই ফুলে ফুলে কাঁদা কূলে কূলে নিশিদিন?’

এখানে সাগর কে কবির সাথে আর চাঁদকে কবি প্রিয়ার সাথে তুলনা করা হয়েছে। আর জোয়ার ভাঁটার ফলে সামুদ্রিক যে জলোচ্ছ্বাস তাকে মনে করা হয়েছে কবি হৃদয়ের বিরহ যন্ত্রণারূপ সাগরে ক্ষণিক অশ্রুপাতের মতো সাময়িক জলোচ্ছ্বাস। একই ভাবে চিত্রকল্প হিসেবে এসেছে ‘সুর’, ‘বীণা’-র কথা।—

“সুরের আড়ালে মূৰ্চ্ছনা কাঁদে, শোনে নাই তাহা বীণ্ ?” 

একই ভাবে ফুলের চিত্রকল্পও ব্যবহৃত হয়েছে সেই বিরহের প্রতীক বোঝাতে—

‘প্রভাতে যে হবে বাসি, সন্ধ্যায় রেখো না সে ফুল তুলে’! 

উপবনে তব ফোটে যে গোলাপ প্রভাতেই তুমি জাগি’ 

জানি তার কাছে যাও শুধু তার গন্ধ-সুষমা লাগি’। 

যে কাঁটা লতায় ফুটেছে সে ফুল, রক্তে ফাটিয়া পড়ি

সারা জনমের ক্রন্দন যার ফুটিয়াছ শাখা ভরি’-

দেখ নাই তারে।–মিলন মালার ফুল চাহিয়াছ তুমি,

তুমি খেলিয়াছ বাজাইয়া মোর বেদনার ঝুমঝুমি !

শব্দপ্রয়োগ—কবি এ কবিতায় তৎসম, তদ্ভব শব্দের পাশাপাশি কিছু ধ্বন্যাত্মক শব্দের ব্যবহার করেছেন। যেমন—‘রণরণি’, ‘ঝুমঝুমি’ ইত্যাদি। চলিত ভাষার সাথে একই সাথে কিছু সাধু ক্রিয়াপদের ব্যবহার করেছেন কবি। যেমন— ‘রাখিয়া এসেছি’, ‘গাহিয়াছি’, ‘ফুটিয়াছে’, ‘ফাটিয়া পাড়ি’, ‘চাহিয়াছ’, ‘খেলিয়া’, বাজাইয়া ইত্যাদি ।

ছন্দের ব্যবহার—ছয় মাত্রার মাত্রাবৃত্ত রীতির ছন্দ ও কবিতার বিষয়বস্তু প্রকাশের ক্ষেত্রে বিরহের বেদনাকে ফুটিয়ে তুলতে যথার্থ সহযোগী হয়ে উঠেছে।

অলঙ্কার প্রয়োগ—কবি এখানে বিভিন্ন শব্দালঙ্কার ব্যবহার করেছেন যা কবিতাটিকে অপূর্ব শ্রুতিমাধুর্য দান করেছে।

যেমন—

(১) ‘বেঁধেনি হৃদয়ে সে সুর, দুলেছে দুল হয়ে শুধু কানে? 

(২) ‘অন্তর-তলে অন্তর-তর যে ব্যথা লুকায়ে রয় ;

(৩) ‘সাগরের সেই ফুলে’ ফুলে’ কাঁদা কূলে কূলে নিশিদিন?’

Rate this post