সাহিত্য ক্ষেত্রে প্রথম আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই যে সব কবি বা সাহিত্যিক সহৃদয় পাঠক বর্গের মুগ্ধ ও বিস্মিত দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, যাঁদের প্রথম যুগের রচনাই একটা সুষ্পষ্ট পরিণতি ও পরিপক্কতার চিহ্ন লক্ষ্য করা যায়, তাঁদের ভেতরে বাংলা মায়ের দামাল ছেলে জগন্মাতার বিদ্রোহী ও অভিমানী সন্তান, সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত, যুগ-প্রতিনিধি নজরুল ইসলাম একটি বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী।
কবি নজরুল সর্বপ্রথম কাব্যের আঙিনাতে পদার্পণ করেন বিদ্রোহের রণতূর্য বাজিয়ে তিনি সোচ্চার কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন—
মহা বিদ্রোহী রণক্লান্ত-
আমি সেইদিন হব শান্ত ৷৷
তাই তো তিনি বিদ্রোহী কবিরূপে আখ্যাত ! তবে তাঁকে শুধু বিদ্রোহী রূপে চিহ্নিত করলে বিশেষ অবিচার করা হবে। তার ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যে প্রেম বিরহে রাঙানো দিনগুলি একদা ঝলমলিয়ে উঠেছিল, তারই নিরিখে লেখা যে কবিতা আছে সেগুলি বিচার বিশ্লেষণ করলে কবি নজরুলকে নবরূপে নবভাবে চেনা যায় তার এই পর্বের কবিতাগুলি চক্রবাক কাব্যে সংকলিত হয়েছিল, প্রেম ও বিরহ এ কাব্যের মূল উপজীব্য প্রকাশ কাল–১২ আগস্ট, ১৯২৯, প্রকাশক ডি. এম. লাইব্রেরি। গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়—“বিরাট প্রাণ, কবিদরদী প্রিন্সিপাল শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্রনাথ মৈত্রকে”। মোট ২১টি কবিতা আছে গ্রন্থে। তার মধ্যে ‘বাদল রাতের পাখী’ ‘বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি’, তোমারে ‘পড়িছে মনে’, মৃত্যুর উৎসবে,’ এবং সমালোচ্য ‘গানের আড়াল’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য কবিতা ৷
বিষয়বস্তুর দিক থেকে ‘গানের আড়াল’ কবিতাটি বিশেষ বৈচিত্র্য সাধনকারী। কবি কণ্ঠের গানের আড়ালে থাকে শ্রোতার একটা ভালো লাগার দিক, শ্রোতা মৃদু কণ্ঠে তা আলাপ করতে থাকে। বোধ করি কবি ও শ্রোতার মধ্যে এইটুকুই পরিচয় আদান-প্রদান হয়ে থাকে এর বেশি কিছু নয়। তবে এখানে কবি তাঁর গানের শ্রোতারূপে এক কল্পিত রমণীর উদ্দেশ্যে অকাতরে বলতে সচেষ্ট হয়েছেন—
তোমার কণ্ঠে রাখিয়া এসেছি মোর কণ্ঠের গান-
এইটুকু শুধু ‘রবে পরিচয় ? আর সব অবসান ?”
এই শ্রোতারূপী নারীটি কবির নিকট প্রেমিকা সাধন শালীনী রূপিণী। তাই তো কবির এ হেন নারীর নিকট সকাতর জিজ্ঞাসা—
“অন্তর তলে অন্তরতর যে ব্যথা লুকায়ে রয়
গানের আড়ালে পাও নাই তার কোনদিন পরিচয়।”
কবি কেবলই আত্মজিজ্ঞাসায় মুখর—তিনি নিয়ত যে গান গেয়ে গেছেন তা হয়তো কেবলি কাহিনি কথা কিংবা যে গানের বাণী কেবল বিলাসিতায় মুখরিত, তার আকুল করা সুর মিছে বলে মনে হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ কখন যে সেই গানের সুরের প্রতিধ্বনি এসে হৃদয় সাগরে জোয়ার বইয়ে দিয়েছে, কিংবা কণ্ঠের তটভূমিতে ঝংকৃত হয়েছে তা কবির জানা ছিল না, তবে তাঁর প্রেমিকা নারীর উদ্দেশ্যে শুধু এইটুকুই অভিমান সঞ্চারিত হয়েছে—
“উপকূলে বসে শুনেছ সে সুর, বোঝ নাই তার মানে?
বেঁধেনি হৃদয়ে সে সুর, দুলেছে দুল হয়ে শুধু কানে?”
কবি ভেবেই পান না, যে চাঁদ সাগরের বুকে জোয়ার বইয়ে দেয়, সেই চাঁদ শোনে না, বা শুনতে পায়নি জোয়ারের কলতান। অর্থাৎ যার জন্যে যার প্রেরণায় তিনি আকুল কণ্ঠে গেয়ে উঠেছেন সেই প্রেরণাদাত্রীর তাঁর গানের আকুলতা বা ভাষা বা অর্থ বোঝেনি ? এটা কী করে সম্ভব? তাহলে সাগরের সেই যে তরঙ্গ কেবল দিবানিশি তটের বুকে আছড়ে পড়ে ব্যথায় গুমরে মরেছে দোসর বিহনে; অনুরূপভাবে গানের আড়ালে কেবল মূর্ছনা কেঁদে ফিরছে প্রেয়সী রমণী একবারও সে কি কান পেতে শোনেনি ? হায় ! কবি বুঝি তাই ব্যথাদীর্ণ হাহাকারে ফেটে পড়ে জিজ্ঞাসায় মুখর হয়—
“আমার গানের মালার সুবাস ছুঁলনা হৃদয়ে আমি?
আমার বুকের বাসি হল শুধু তব কণ্ঠের ফাঁসি ?”
এবার কবি সেই অহংকারী প্রেয়সী রমণীর উদ্দেশ্যে স্বগত উক্তির ভঙ্গিতে কয়েকটি কথা বলেন—‘বন্ধু ভুলেও কখনো প্রভাতে যে ফুল বাসি হয় তা সন্ধ্যায় তুলে রেখোনা, আমি জানি প্রভাতের ফোটা গোলাপের সুবাস নিতে তুমি তার কাছে ছুটে যাও। যে কাঁটা লতার মধ্য দিয়ে শাখা-প্রশাখা ভেদ করে ফুলগুলি ফুটেছে, তার সেই সারাজনমের ক্রন্দনের প্রতি তোমার লক্ষ্য সেই কোণ, তুমি শুধু, সুবাস গ্রহণ করতে জান। কারণ তুমি শুধু মিলন মালার ফুল চেয়েই ক্ষান্ত, অন্যের ব্যথার প্রতি তুমি নিস্পৃহ, তুমি গান শুনে আনন্দ পাও, গায়কের ব্যথা বোঝো না, তাই কবি বড়ো অভিমানে তাঁর সেই নিষ্ঠুর প্রেয়সীর উদ্দেশ্যে গেয়ে উঠেছেন—
“ভোলো মোর গান, কি হবে লইয়া এইটুকু পরিচয়,
আমি শুধু তব কণ্ঠের হার, হৃদয়ের কেহ নয়,
জানায়ো আমারে, যদি আসে দিন, এইটুকু শুধু যাচি-
কণ্ঠ পারায়ে হয়েছি, তোমার হৃদয়ের কাছাকাছি।”
অতএব এ থেকে স্বতঃতই প্রমাণিত, আলোচ্য কবিতাটিতে একটা বিরহ দীর্ঘ অভিমান ধ্বনিত হয়েছে। এখানে কবি সমাজ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী নন। তিনি স্পষ্টই অভিমানী তাঁর প্রেয়সীর উদ্দেশ্যে ৷ এ কবিতায় কবি প্রেয়ের কবিরূপে চিহ্নিত হয়েছেন।