কাল, কবি বা রুচি বিচারে, ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যটির অস্বচ্ছ বিষয়-উৎস ইতিহাস রহস্যে সমাচ্ছন্ন। ‘পৌরাণিক’ বা ‘লোকাশ্রয়ী’ ভাবনা, বিবর্তমান জনজীবনের সঙ্গে কাব্য বিষয়ের সম্বন্ধসমতা না পৌরাণিক সংস্কৃতির সসত্ত্ব অনুপ্রাণনা, কার একক আনুগত্যে কবির কাব্যরচনার সূত্রপাত তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। কাব্যটি মূলতঃ এই দ্বৈতভাবনারই স্বরসঙ্গতি।

কাব্যটির প্রধান কাহিনী ভাগবত থেকে নির্বাচিত; মাঝে মাঝে ‘গীতগোবিন্দে’র কিছু কিছু পংক্তি জন্মকাহিনী ও বাল্যলীলা অংশে এবং পুরাণে বিষ্ণুর কৃষ্ণাবতার গ্রহণের যে কারণ বিদ্যমান, কবি আপাতভাবে তারই অনুসারী। এছাড়া ‘রাধাচন্দ্রাবলী’ নামের মধ্যে, কৃষ্ণের ঐশ্বর্য-প্রকাশক শক্তির বারবার উল্লেখে, কালীয়দমন, বস্ত্রহরণ, রাস বা বৃন্দাবনখণ্ডের বর্ণনায় ও প্রসঙ্গ উত্থাপনে ভাগবত ও অন্যান্য পুরাণের প্রভাব দেখা যায়। তবু কয়েকটি ক্ষেত্রে এইসব পুরাণ ও ভাগবত থেকে পার্থক্য এ কাব্যের স্বাতন্ত্র্যের পরিচায়ক।

(ক) জন্মখণ্ডে ভাগবতে কথিত গাভীরূপ ধারণ করে ব্রহ্মার কাছে বসুমতীর দুঃখ নিবেদনের কাহিনী একাব্যে অনুপস্থিত; অন্য পুরাণের আদর্শে একাব্যে কংসবধের জন্য ক্ষীরোদসাগর তীরে হরির সাদা ও কালো দুগাছি চুল থেকে হলী বা বলরাম এবং বনমালী বা কৃষ্ণের উৎপত্তি বর্ণিত হয়েছে।

ভাগবতে কালীয়দমন বস্ত্রহরণ ও রাসলীলা—এইভাবে নির্দিষ্ট ‘ক্রম’ বা পর্যায়ে কৃষ্ণলীলা বর্ণিত; কিন্তু ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে’ বৃন্দাবনখণ্ডে রাস, তারপর যমুনা খণ্ডের অন্তর্গত কালীয়দমন এবং শেষে বস্ত্রহরণপর্ব দেখা যায়। ভাগবতে বা বিষ্ণুপুরাণে ‘রাধা’ চরিত্র নেই : কৃষ্ণের ঐশ্বর্যলীলাই ধ্রুবপদ। কিন্তু এ কাব্যে রাধা-কৃষ্ণের প্রণয়লীলাই প্রধান আকর্ষণ ; কৃষ্ণের বলবীর্যের পরিপূর্ণ উপস্থিতি একমাত্র কালীয়দমন খণ্ডেই লক্ষণীয়। কৃষ্ণের বসন্তকালে দিবাভাগে গোপীজনসঙ্গলাভও ভাগবতের শারদ রজনীর ‘কামগন্ধহীন’ রাসলীলা নয়।

তাছাড়া তাম্বুলখণ্ডে সঙ্গলাভে ব্যাকুল কৃষ্ণকে ‘আইহনের রানী’ রাধাচন্দ্রাবলীর অম্লাক্ত ব্যঙ্গে পরিহার, দানখণ্ডে কৃষ্ণের দেহাসক্তি, নৌকাখণ্ডে নৌকা ডুবিয়ে রাধার সঙ্গলাভ, ভারখণ্ড ও ছত্রখণ্ডে রাধার কৃষ্ণকে ‘মজুরিয়া’ সাজিয়ে স্বকার্যে নিয়োগ, যমুনাখণ্ডে রাধাসহ কৃষ্ণের জলবিহার, হারখণ্ডে কৃষ্ণের রাধার হার অপহরণবৃত্তান্ত ও যশোদার রাধার অভিযোগে কৃষ্ণকে তিরস্কার, কৃষ্ণের পুষ্পবাণে রাধাকে আহত করা, বংশীখণ্ডে বাঁশী চুরি—প্রভৃতি ঘটনা ভাগবত ও অন্যান্য পুরাণ বহির্ভূত।

(খ) পদ্মপুরাণে লক্ষ্মী সাগর দুহিতা এবং রাধাও বৃষভানুকন্যা। কিন্তু ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে’ লক্ষ্মী রাধা রূপে জন্ম নিলেও রাধা এখানে (সম্ভবতঃ কবির পৌরাণিক তথ্যের অসতর্ক প্রয়োগে) সাগর গোপের কন্যা। পদ্মপুরাণে পাতালখণ্ডে ও ভাগবতে কৃষ্ণের সখা এবং রাধার সখীদের নামের উল্লেখ আছে। কিন্তু একাব্যের বংশীখণ্ডে শুধু কৃষ্ণকথিত ‘বলভদ্রে’র নাম ছাড়া অন্য সখাদের অস্তিত্ব নেই। রাধার সখীদের প্রসঙ্গ থাকলেও তাদের কোন বিশেষ নাম চিহ্ন নেই।

(গ) ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে রাধা কৃষ্ণের স্বকীয়া নায়িকা ; সেখানে উভয়ের আনুষ্ঠানিকভাবে বিবাহ প্রদর্শিত হয়েছে। কিন্তু এ কাব্যে রাধা-কৃষ্ণের বিবাহ নয়, প্রত্যক্ষভাবেই কেলি বিলাস-কলার উলঙ্গ উপস্থাপনা দেখা যায় যেমন কৃষ্ণের কণ্ঠে— “ভোর বহিল এবে দেহ আলিঙ্গন”, তেমনি রাধার উক্তিতে—“ছত্র ধর কাহ্নাঞি দিব সুরতি।”

অনেকে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে তথাকথিত গ্রামীণ আদর্শকে বিভিন্ন সংস্কৃত গ্রন্থে বর্ণিত আদর্শের সঙ্গে সম্বন্ধ সমতায় প্রয়াসী। যেমন, ‘রাধাপ্রেমামৃত’ কাব্যে বস্ত্রহরণ, ভারখণ্ড, নৌকাখণ্ড ও দানখণ্ডের (যেমন, শ্রীদামা, বসুদামা, সুদামা, স্তোককৃষ্ণ, অংশুভদ্র ইত্যাদি কৃষ্ণসখা, ললিতা, হরিপ্রিয়া, ভদ্রা চন্দ্রাবলী ইত্যাদি রাধার সখী) সঙ্গে সাদৃশ্যবোধে, বা ‘রাধাতন্ত্রে’র নৌকালীলা ও দানলীলার সঙ্গে অথবা ‘ব্রহ্মাণ্ড পুরাণে’ ভারখণ্ডের বর্ণনার সঙ্গে ঐক্য দেখা যায়। কিন্তু এইসব গ্রন্থগুলি ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে’র পূর্ববর্তী কিনা তা নিঃসংশয়ে জানা যায় নি।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে গ্রামীণ সংস্কৃতির স্বীকারান্তর স্পষ্টরেখ্। শুধু প্রবাদ-প্রবচনে বা রুচির অনুসরণে নয়, কোন কোন সমালোচকের অনুমান, পৌরাণিক কৃষ্ণলীলার পাশে একটি গ্রামীণ কৃষ্ণকথাও প্রচলিত ছিল, সেখানে গ্রাম্য গোপনন্দন কৃষ্ণ ছিল মাতুলানির রূপমুগ্ধ। তবে এ কাব্য যে সম্পূর্ণভাবে গ্রামীণ তথা লৌকিক সাহিত্যের পর্যায়ভুক্ত নয় বা বড়ু চণ্ডীদাস যে নিছক গ্রাম্য কবি নন, কাব্যের মধ্যে প্রতি খণ্ডের প্রথমে সংস্কৃত শ্লোকের উল্লেখ, তার বিদগ্ধ ও রসচাতুর্য দৃষ্টিভঙ্গি এবং কিছু ক্ষেত্রে আঙ্গিকগত অভিনবত্ব তার নিঃসংশয় নিদর্শন।

Rate this post