গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়া ও বাংলাদেশ
অথবা, গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়া 

[ সংকেত : ভূমিকা; গ্রিন হাউস বলতে যা বােঝায়; গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়া; গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়ার হেতু এবং মাধ্যম; গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়ার প্রভাব; বাংলাদেশে গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়ার প্রভাব; যেভাবে প্রতিকার সম্ভব; উপসংহার। ]

ভূমিকা : বিশ্বায়নের যুগে মহাবিশ্ব যেসব মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে সেগুলাের মধ্যে ‘Greenhouse effect’ বা ‘গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়া সর্বাপেক্ষা বিবেচনাযােগ্য। ‘Greenhouse effect’ পরিবেশ দূষণেরই একটি বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া, যা বিশ্ববাসীকে নিশ্চিত ভয়ংকর এক ধ্বংসের মুখােমুখি দাঁড় করিয়েছে। অথচ এই অভিশপ্ত পরিণামের জন্য মানুষই দায়ী। আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থান্বেষী ভােগবিলাসী মানুষ তার অবিমৃষ্যকারী কর্মকাণ্ডের দ্বারা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এনে দাঁড় করিয়েছে স্রষ্টার ভারসাম্যপূর্ণ নিখুঁত সুন্দর পৃথিবী নামক গ্রহটিকে। ভারসাম্য হারিয়ে প্রকৃতি আজ বিপর্যস্ত, অনুকূল অস্বাভাবিক বিরূপ পরিবেশ প্রত্যক্ষভাবে প্রতীয়মান। যার ফলে মানুষ এখন সাক্ষাৎ সলিল সমাধিতে নিমজ্জিত হতে যাচ্ছে। এমন অপ্রীতিকর, সংকটাপূর্ণ অবস্থায় মানুষ সত্যিই বড়াে অসহায়। 

গ্রিন হাউস বলতে যা বােঝায় : ইংরেজি ‘Greenhouse’ শব্দটির অর্থ ‘সবুজ ঘর’। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশসমূহে এবং মরু-ভূঅঞ্চলের তীব্র শীতপ্রবণ এলাকা বছরের একটি দীর্ঘসময় সূর্যের জ্যোতি বঞ্চিত থাকে। সূর্যের অনুপস্থিতি হেতু উক্ত এলাকার মানুষের নিত্যপ্রয়ােজনীয় শাকসবজির সংকট তীব্র আকার ধারণ করে। এ অবস্থার প্ররিপ্রেক্ষিতে বিজ্ঞানিগণ বিশেষ এক ধরনের কাচের ঘর উদ্ভাবন করেন। যে ঘরের ছাদ ও দেওয়াল তাপ বিকিরণরােধী বিশেষ এক প্রকার কাচ দিয়ে তৈরি। গ্রীষ্মকালে এ ঘরে সূর্যালােক ও উত্তাপ প্রবেশ করে, কিন্তু বিকিরণ না ঘটায় তাপ বের হতে পারে না। সঞ্চিত সূর্যতাপে বৈরী ও শীতার্ত পরিবেশেও তাই স্বাভাবিকভাবে শাকসবজি উৎপাদন করা সম্ভব হয়। শীতের দেশের এ ধরনের বিকিরণরােধী বিশেষ কাচের ঘরকে বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন ‘Greenhouse’ বা সবুজ ঘর। 

গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়া : গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়া আবহাওয়ামণ্ডল ও ভূ-প্রকৃতির বিশেষ অবস্থার একটি প্রতীকী নাম, যা কি না শীতপ্রধান দেশে কাচের ঘরের উত্তাপ সঞ্চয়ের প্রক্রিয়ার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। গ্রিন হাউসে সূর্যের উত্তাপ প্রবিষ্ট হলেও তা বিকিরণের মাধ্যমে মহাশূন্যে ফিরে যেতে পারে না। পৃথিবীর আবহাওয়ামণ্ডলে স্বাভাবিক অবস্থার বিপন্নতার কারণে যে পরিমাণ উত্তাপ আসে সে পরিমাণ উত্তাপ বিকিরণ প্রক্রিয়ায় ফিরে না গিয়ে কিছুটা উত্তাপ আবহাওয়ার সঙ্গে সঞ্চিত হচ্ছে। এ তাপ সঞ্চয়ের ফলে পৃথিবীর ভূপ্রাকৃতিক পরিবেশ নানা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে। এ প্রক্রিয়াকেই বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন ‘Greenhouse effect’ বা গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়া। 

গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়ার হেতু এবং মাধ্যম : মহাশূন্যে আবহাওয়ামণ্ডলে ‘ওজোন স্তর নামে অদৃশ্য একটি বেষ্টনী বিদ্যমান। এ ওজোন স্তর পৃথিবীতে সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মির প্রবেশ রােধ করে এবং বিকিরণ প্রক্রিয়ায় পৃথিবী থেকে আসা তাপ মহাশূন্যে পুনরায় ফিরে যেতে সহায়তা করে। ভােগবাদী মানুষের নানা কর্মকাণ্ডে প্রকৃতি প্রদত্ত নিরাপত্তা বেষ্টনী ওজোন স্তর ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে। ফ্রিজ, এয়ারকন্ডিশনার এবং বিভিন্ন ধরনের প্রে প্রভৃতিতে ব্যবহৃত হয় ক্লোরােফ্লোরােকার্বন গ্যাস। এটা শিল্প-কলকারখানাতেও ব্যবহৃত হয়। অবমুক্ত ক্লোরােফ্লোরােকার্বন মহাশূন্যের ওজোন স্তর ক্ষয়কারী অন্যতম উপাদান। তাছাড়া, গৃহস্থালি ও শিল্প বর্জ, কলকারখানা এবং যানবাহনের ধোঁয়া, মানুষের মলমূত্র প্রভৃতি থেকে ক্রমবর্ধমান হারে নির্গত হচ্ছে কার্বন ডাইঅক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, মিথেনসহ নানা ধরনের গ্যাস। এগুলাে বায়ুমণ্ডলে মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধির ফলে ইনফ্লায়েড রেডিয়েশনে ব্যাঘাত ঘটায় এবং সূর্য থেকে আগত কিছু তাপ পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ধরে রাখে। সেই তাপ ‘ওজোন স্তরে’ ক্ষয় বা ফাটল সৃষ্টি করে। এভাবে ওজোন স্তরের ক্ষয়জনিত কারণে মাত্রাতিরিক্ত অতিবেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে পৌছাচ্ছে। অন্যদিকে বায়ুমণ্ডলে প্রতিদিন জমা হচ্ছে উত্তাপ । ফলে পৃথিবী উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। সামগ্রিকভাবে পরিবেশ বিপন্ন হচ্ছে এবং ঘটছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়। 

গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়ার প্রভাব : গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়ার নেতিবাচক প্রভাব সমগ্র বিশ্বের জন্য মারাত্মক পরিণতি বয়ে আনছে এবং দিন দিন তা ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টির ফলে বাস্তুসংস্থান বিপর্যস্ত হচ্ছে । Ecology বা বাস্তুসংস্থান প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় প্রধান ভূমিকা পালন করে। বাস্তুসংস্থান বিপর্যস্ত হওয়ার ফলে মনুষ্য বাসযােগ্য পরিবেশের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। ধ্বংস হচ্ছে বনাঞ্চল, বিলীন হয়ে যাচ্ছে অকৃত্রিম নিসর্গ। পৃথিবীর স্বাভাবিক তাপমাত্রা ১.৭৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৪.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা ২০৫০ সাল নাগাদ এ তাপমাত্রা আরও বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়াবে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, যা রীতিমতাে চমকে ওঠার মতাে দুঃসংবাদ। উচ্চ তাপের কারণে মেরু অঞ্চলে কোটি কোটি বছর ধরে জমে থাকা পর্বত সমান বরফ গলতে শুরু করেছে। বরফ গলা এ পানি নেমে আসছে সমুদ্রে। যার ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, বরফ গলা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মহাপ প্রভৃত সমতল দেশগুলাের বিশাল একটি অঞ্চল চিরতরে পানির নিচে তলিয়ে যাবে। সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি যেমন তকেক্যানসার সৃষ্টিতে সহায়ক তেমনি প্রচণ্ড উষ্ণতার কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন বনাঞ্চলে সৃষ্টি হচ্ছে দাবানল। এর প্রভাবে ক্রমবর্ধমান ক্ষতি ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে দিন দিন আরও চরম সীমায় পৌছে দেবে। অতি বন্যা, খরা, এসিড বৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, জলােচ্ছ্বাস পৃথিবী নামক গ্রহটিকে বিপন্ন করে তুলবে। ধ্বংস হবে জীববৈচিত্র্য। দানবীয় ভূমিকম্পের মতাে গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়া বিশ্বকে একদিন সমুদ্রগর্ভে বিলীন করে দেবে।

বাংলাদেশে গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়ার প্রভাব : বাংলাদেশে গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়ার নেতিবাচক প্রভাব হিসেবে প্রথমেই ভূমি জলমগ্ন। হওয়ার বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচ্য। যেহেতু বাংলাদেশ একটি সমতল ভূমির দেশ, সেহেতু সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা অনেক কম। সমুদ্রের পানি যদি মাত্র ৩ ফুট বৃদ্ধি পায় তাহলেই বাংলাদেশের শতকরা দশ ভাগ সমতলীয় ভূমি পানির নিচে তলিয়ে যাবে। যার ফলে ১৫% আবাদযােগ্য ও ৩.৩০% বনভূমি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় প্রায় আড়াই কোটি মানুষ হবে উদ্বাস্তু। পরিবেশ ও ভূ-বিজ্ঞানীদের গবেষণালব্ধ অভিমত, সমুদ্রের পানি মাত্র ১ মিটার বৃদ্ধি পেলে সুন্দরবনের ৭০% তলিয়ে যাবে। ফলে ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন হারাবে তার নিসর্গ সমৃদ্ধি, বাংলাদেশ হারাবে ঐতিহ্যগত গর্ব। সমুদ্রস্ফীতির কারণে খুলনা, বাগেরহাট, পিরােজপুর, লক্ষ্মীপুর, নােয়াখালী, পটুয়াখালী, বরগুনা প্রভৃতি জেলার আবাদি জমি লবণাক্ত হয়ে যাওয়ার ফলে কৃষিকাজ ব্যাহত হবে। বিলুপ্ত হবে স্বাদু পানির প্রচলিত মৎস্য সম্পদ। গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়ায় সাগর উত্তাল হয়ে উঠেছে। নিমচাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার ফলে অতি বন্যা, সুনামি, ঘূর্ণিঝড়ের প্রাদুর্ভাব ঘন ঘন দেখা দিচ্ছে। ১৯৮৮ সালের দুই মাসব্যাপী বন্যায় বাংলাদেশের ৫৩টি জেলা প্রাবিত হয়েছিল। ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশে দেখা দিয়েছিল ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি বন্যা। ২০০৪ সালের বন্যা অন্য যেকোনাে সময়ের বন্যার চেয়ে মারাত্মক রূপ ধারণ করেছিল। ১৯৯১ সালে উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হেনেছিল ভয়াবহ জলােচ্ছ্বাস। তাছাড়া প্রতিবছরই কোনাে না কোনাে অঞ্চল অভ্যন্তরীণ বন্যার প্রকোপে আক্রান্ত হচ্ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার ফলে কৃষিপণ্য বিনষ্ট হয়েছে। এর ফলে শাকসবজির অত্যধিক মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে, যা নিম্ন আয়ের মানুষকে করেছে ভােগান্তির শিকার । চিরাচরিত ঋতুচক্র ভেঙে যাচ্ছে। দেখা দিচ্ছে অতি শীত বা অতি গ্রীষ্মের দাপট। ক্রমশ নাতিশীতােষ্ণমণ্ডলের এই দেশটিতে আবহাওয়া চরম ভাবাপন্ন হয়ে উঠেছে, যা কৃষিসহ দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার ওপর ভীষণ নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। 

যেভাবে প্রতিকার সম্ভব : গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়ার বৈশ্বিক সংকটে বাংলাদেশও এর অসহায় শিকার । যদিও গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়া প্রতিরােধে বাংলাদেশের এককভাবে করার কিছু নেই। বিশ্বের উন্নত-অনুন্নত সকল দেশের আন্তরিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে সুষ্ঠু কর্মপন্থা গ্রহণ করা হলেই কেবল এক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত সুফল প্রত্যাশা করা যায়। সারা বিশ্বে ক্লোরােফ্লোরােকার্বন গ্যাসের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা তথা বন্ধ করা সর্বাগ্রে জরুরি। বন্ধ করতে হবে শিল্প বর্জ্য নিষ্কাশনসহ পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযােগিতা। বৃক্ষ নিধন রােধ করতে হবে। করতে হবে জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প ব্যবস্থা উদ্ভাবন। সর্বোপরি, পরিবেশ দূষণ প্রতিরােধ করাকে দেশসমূহের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। হিসেবে মূল্যায়ন করতে হবে। বৈজ্ঞানিক কলাকৌশলে বিনিয়ােগ বাড়াতে হবে। এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করলে হয়তাে গ্রিন হাউস। প্রতিক্রিয়ার ভয়ংকর প্রভাব থেকে বিশ্ববাসী অপেক্ষাকৃত মুক্তির আশ্বাস পেতে পারে। 

উপসংহার : গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়া মানবসৃষ্ট পরিবেশ দূষণজনিত এক মহাবিপর্যয়ের নাম । সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত বসবাসের অনুকূল সুন্দর। পৃথিবীকে মানুষ অবিবেচকের মতাে দিন দিন ধ্বংস করছে। নষ্ট করছে তার নৈসর্গিক নির্মল পরিবেশ। তারপরও বিপর্যয়। বিভীষিকারূপে আঘাত হানার পূর্বে সাবধান হওয়ার সময় এখনও নিঃশেষ হয়ে যায়নি। বিশ্বের ধনী ও শিল্পোন্নত দেশগুলাে গ্রিন। হাউস প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিতে সবচেয়ে বেশি দায়ী। তাদের অবিবেচনাপ্রসূত কর্মকাণ্ডের ফলে আমাদের মতাে তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহের জন্য বিপর্যয়ের আশঙ্কা সর্বাধিক।

Rate this post