মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গীতে রাজনীতি: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার ক্ষেত্রে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গী হল একটি আধুনিক ও গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গী। এই দৃষ্টিভঙ্গী আধুনিক রাষ্ট্রনৈতিক চিত্তাজগতে এক সাড়াজাগানো বিষয়। মাকর্সবাদ উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে একেবারে আলাদা। এই মতবাদে পৃথক দৃষ্টিতে মানুষ, সমাজ ও রাজনীতি সম্পর্কে আলোচনা করে। মার্কসবাদে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে সমাজ বিকাশের ধারাকে ব্যাখ্যা করা হয় এবং তারই পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রনীতির আলোচনা করা হয়। বস্তুত মার্কসবাদ হল এই বিশ্বসংসার এবং তার অংশ স্বরূপ মানবসমাজ সম্পর্কে একটি সাধারণ বা সামগ্রিক তত্ত্ব। মার্কসীয় দর্শনে রাজনীতি সমাজের উপরি কাঠামোর (super-structure) অন্যতম অঙ্গ হিসাবে পরিগণিত হয়। এই অঙ্গটি রাষ্ট্র এবং তার বিভিন্ন সংগঠন ও কার্যাবলীর সঙ্গে যুক্ত। লেনিন (Lenin)-এর অভিমত অনুসারে, “রাজনীতি হল শ্রেণীসমূহের মধ্যকার সম্পর্ক। রাজনীতি হল রাষ্ট্রে ব্যাপারে অংশগ্রহণ, রাষ্ট্র পরিচালনা এবং রাষ্ট্রের কার্যকলাপের রূপ, উদ্দেশ্য ও বিষয়বস্তু নির্ধারণ।” বিভিন্ন জাতি ও রাষ্ট্রের সম্পর্কও রাজনীতির অন্তর্ভুক্ত। তবে শ্রেণীসমূহের মধ্যকার সম্পর্কই হল রাজনীতির মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। আর সমগ্র সমাজব্যবস্থার ভিত হল অর্থনীতি। লেনিনের মতে রাজনীতি হল অর্থনীতির ঘনীভূত রূপ (Politics is the most concentrated expression of economics.)।
বনিয়াদ ও উপরি-কাঠামো: উৎপাদন ব্যবস্থাকে বলা হয় সমাজের অর্থনৈতিক বনিয়াদ। এই বনিয়াদের উপর সমাজের উপরি-কাঠামো গড়ে ওঠে। আইন, আদালত, কারাগার, পুলিশ বাহিনী, সৈন্য বাহিনী প্রভৃতি সকল রাষ্ট্রীয় সংগঠন; কলা, সাহিত্য, ধর্ম, দর্শন, রাজনীতি এবং সমাজের বিভিন্ন ভাবাদর্শের বহুবিধ অভিব্যক্তির সমন্বিত রূপকে উপরি-কাঠামো বলা হয়। সমাজের উপরি-কাঠামোর এই বিশাল ইমারত অর্থনৈতিক বনিয়াদের উপর দাঁড়িয়ে থাকে; এবং এই বনিয়াদের দ্বারাই বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়। সুতরাং মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গী অনুসারে সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থাই হল সকল কিছুর মূল। বৈষয়িক জীবনের উৎপাদন পদ্ধতির দ্বারা সাধারণভাবে সামাজিক, রাজনীতিক ও মনন বিষয়ক জীবনধারা নির্ধারিত হয়। মার্কস বলেছেন: “The mode of production of material life determines the social, political and intellectual life process in general.” এর উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠে রাজনীতি, ধর্ম, দর্শন, সভ্যতা-সংস্কৃতি, সংক্ষেপে বিভিন্নভাবে অভিব্যক্ত সমাজ-জীবনের বহুবিধ বিষয়। তাই মার্কসের রাজনীতিক, সামাজিক বা ঐতিহাসিক তত্ত্বকে তাঁর অর্থনৈতিক তত্ত্ব থেকে পৃথক করা যায় না।
অর্থনৈতিক ব্যবস্থার গুরুত্ব: মার্কসীয় দর্শন অনুসারে অর্থনীতি-নিরপেক্ষ কোন আলোচনাই বিজ্ঞানসম্মত হতে পারে না। অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে সমাজজীবনের আর সবকিছুই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অতএব রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় রাষ্ট্র, সরকার, আইন ও অন্যান্য সকল প্রাসঙ্গিক বিষয় সমাজের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্নভাবে আলোচনা করলে সে আলোচনা একপেশে ও অসম্পূর্ণ হতে বাধ্য। কোন দেশের প্রশাসন ব্যবস্থাকে সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে হলে বা রাজনীতিক ভাবে বিশ্লেষণ করতে হলে সেই দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার-বিশ্লেষণ আবশ্যক। তবে এও উল্লেখযোগ্য যে, মার্কসবাদে সমাজের সব কিছুর ভিত্তি হিসাবে অর্থনৈতিক উপাদানের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে; কিন্তু সমাজের উপরি-কাঠামোর বিভিন্ন উপাদানের প্রভাব ও গুরুত্বকে একেবারে অস্বীকার করা হয় না।
রাজনৈতিক গুরুত্ব: মার্কসবাদ অনুসারে অর্থনীতি-নিরপেক্ষ যে কোন আলোচনা অবৈজ্ঞানিক। কিন্তু এই তত্ত্বে রাজনীতির গুরুত্বকেও অস্বীকার করা হয় না। রাজনীতি অর্থনীতির ঘনীভূত ও সম্পূর্ণরূপ হলেও, রাজনীতি অর্থনীতিকে প্রভাবিত করতে পারে। লেনিন বলেছেন: ‘অর্থনীতির উপর রাজনীতির অবশ্যই পূর্বাধিকার থাকবে।’ (‘Politics must take precedence over economics.”)। অর্থনৈতিক বনিয়াদ থেকে সৃষ্ট উপরি-কাঠামোর কোন অংশই নিষ্ক্রিয় নয়। এই অংশগুলিও বনিয়াদকে প্রভাবিত করতে পারে। তবে অর্থনীতির ঘনীভূত রূপ হিসাবে রাজনীতি প্রচলিত ব্যবস্থার সমর্থন ও সংরক্ষণের মাধ্যমে অর্থনীতির সেবা করে থাকে। যাই হোক, বনিয়াদ ও উপরি-কাঠামো মিলিতভাবে প্রত্যেক সমাজব্যবস্থার চেহারা-চরিত্রকে প্রতিপন্ন করে। ভিত ও বনিয়াদে ব্যক্ত হয় ব্যবস্থার অর্থনৈতিক ভিত্তি। এবং রাজনীতিক ও ভাবদর্শগত রূপ ব্যক্ত হয় উপরি কাঠামোতে। প্রত্যেক সামাজিক ব্যবস্থার অর্থনৈতিক ও রাজনীতিক কাঠামোর পরিপ্রেক্ষিতে অন্য সামাজিক ব্যবস্থার সঙ্গে তার পার্থক্য নিরূপণ করা যায়। একটি সমাজব্যবস্থা থেকে অপর একটি সমাজব্যবস্থায় উত্তরণের সময় বনিয়াদের মত উপরি-কাঠামোতেও পরিবর্তন ঘটে। এই পরিবর্তনের ফলে নতুন সমাজের সৃষ্টি হয়।
ঐতিহাসিক বস্তুবাদ: মার্কসবাদে ঐতিহাসিক বস্তুবাদের সাহায্যে বৈজ্ঞানিকভাবে মানবসমাজের ক্রমবিবর্তনের ধারাকে ব্যাখ্যা করা হয়। সমাজের অগ্রগতি সম্বন্ধে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গী ঐতিহাসিক বস্তুবাদ নামে পরিচিত। ঐতিহাসিক বস্তুবাদ, দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের অংশ বিশেষ। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ অনুসারে জগত প্রকৃতিগতভাবেই বস্তু বা পদার্থ। জগতের প্রত্যেক বস্তু পরস্পরের উপর নির্ভরশীল এবং সম্পর্কযুক্ত। এই বস্তুজগৎ পরিবর্তনশীল ও গতিময়। বস্তুজগতের এই পরিবর্তন ও বিকাশের মূলে আছে বস্তুর অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব বা স্ববিরোধ। এঙ্গলস মন্তব্য করেছেন যে, “ডারউইন যেমন জৈব প্রকৃতির বিকাশের নিয়ম আবিষ্কার করেছেন, তেমনি মার্কস আবিষ্কার করেছেন মানব ইতিহাসের বিকাশের নিয়ম।” দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের তত্ত্ব বা সূত্র মানবসমাজের ইতিহাসের ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হলে তাকে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বলা হয়। সমাজের বিকাশ ও অগ্রগতির মধ্যে যে বিধান ও চালিকাশক্তির সন্ধান পাওয়া যায়, সে বিষয়ে সাধারণ তত্ত্বই হল ঐতিহাসিক বস্তুবাদ।
ঐতিহাসিক বস্তুবাদের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়: ঐতিহাসিক বস্তুবাদের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হল সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থার বিকাশের ইতিহাস পর্যালোচনা করা। সমাজের বৈষয়িক জীবনযাত্রা উৎপাদন-পদ্ধতির উপর নির্ভরশীল। উৎপাদন পদ্ধতির দুটি দিক আছে : উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্ক। উৎপাদন শক্তি বলতে বোঝান হয়েছে সেই মানুষদের যাদের উৎপাদনের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা আছে এবং সেই যন্ত্রপাতি যার সাহায্যে দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদিত হয়। আর উৎপাদন সম্পর্ক বলতে সেই সম্পর্ককে বোঝায় যা উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় এবং বাস্তব সামগ্রীর বণ্টন ও বিনিময়ের প্রক্রিয়ায় উদ্ভূত হয়। এদের মধ্যে উৎপাদন শক্তি অধিক গতিশীল। উৎপাদন-শক্তির বিকাশ এবং তার ফল হিসাবে উৎপাদন সম্পর্কের পরিবর্তনের ইতিহাসই হল সমাজ বিকাশের ইতিহাস। উৎপাদন শক্তির উন্নতি ও পরিবর্তন হয়, তার প্রতিঘাত পড়ে উৎপাদন-সম্পর্কের উপর এবং তার ফলে সামগ্রিকভাবে সামাজিক অবস্থারও পরিবর্তন ঘটে। অর্থাৎ সমাজের অর্থনৈতিক ভিত্তিতে পরিবর্তন, সমাজের উপরি- কাঠামোতেও তার প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। তার ফল হিসাবে রাষ্ট্রব্যবস্থা, আইনব্যবস্থা, এক কথায় উপরি-কাঠামোর সকল অঙ্গেই পরিবর্তন সূচীত হয়।
ঐতিহাসিক বস্তুবাদ অনুসারে সমাজ বিকাশের ধারা: উৎপাদান-পদ্ধতির পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে সমাজের বিকাশের ধারায় পাঁচ ধরনের সমাজব্যবস্থা পরিলক্ষিত হয় : আদিম সাম্যবাদী সমাজ, দাস-সমাজ, সমাস্তুতন্ত্র, ধনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র। সমাজ বিবর্তনের প্রতিটি স্তরেই গড়ে উঠে সেই সমাজব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নিজস্ব রাষ্ট্রব্যবস্থা। এই ভাবে আদিম শ্রেণীহীন প্রাক্-সভ্য সাম্যতন্ত্র এবং আধুনিক শ্রেণী বর্জিত সুসভ্য সাম্যতন্ত্রের মধ্যবর্তী পর্যায়ে যে তিন ধরনের শ্রেণী সমাজ (দাসতন্ত্র, সামন্ততন্ত্র, ধনতন্ত্র) পরিলক্ষিত হয় তাদের সবকটি সমাজেই রাষ্ট্রব্যবস্থা, আইনব্যবস্থা, প্রভৃতি এমনভাবে গড়ে উঠেছিল যাতে সমাজের বিত্তবান শ্রেণীর স্বার্থ বজায় থাকে। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সমাজের উৎপাদন পদ্ধতি এবং উপরি-কাঠামো এমনভাবে গড়ে উঠে যাতে ক্রমশঃ শ্রেণীহীন এবং শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। মার্কস বলেছেন : “এই বনিয়াদের (অর্থনৈতিক) সঙ্গে নির্দিষ্ট ধরনের সমাজচেতনার সামঞ্জস্য আছে। বাস্তব ভিত্তির উপরেই আইনগত ও রাজনীতিক ইমারত (supper-structure) খাড়া হয়। সামাজিক, রাষ্ট্রিক ও মনন বিষয়ক জীবনধারাকে বাস্তব জীবনের উৎপাদন পদ্ধতিই নিয়ন্ত্রণ করে। মানুষের চেতনা মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে না। মানুষের সামাজিক সত্তাই তার চেতনাকে নিয়ন্ত্রণ করে। মানুষের ধ্যান-ধারণা বা ভাবধারা হল বস্তুময় জগতের অভিব্যক্তি।” মার্কস আরও বলেছেন : “The ideal is nothing else than the world reflected by the human mind, and translated into forms material of thought.”
সমগ্র সমাজ একটি সামগ্রিক সত্তা: মার্কসীয় তত্ত্ব অনুসারে রাজনীতি সম্পর্কে অনুশীলন সমগ্র সমাজের পরিপ্রেক্ষিতেই করা হয়। কেবল রাজনীতি নয়, সমাজের যে-কোন বিষয় সম্বন্ধে পর্যালোচনা সমগ্র সমাজব্যবস্থার পটভূমিতে করা হয়। মার্কসবাদে সমগ্র সমাজকে একটি অখণ্ড, অবিভাজ্য এবং সামগ্রিক সত্তা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। সেই জন্য সমাজবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত সকল বিচার-বিশ্লেষণ সামগ্রিকভাবেই সম্পাদিত হয়। আপাত বিচারে এক্ষেত্রে আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সাদৃশ্য দেখা যায়। আচরণবাদিগণও সমাজকে বিভিন্ন অংশ সমন্বিত একটি অবিভাজ্য সামগ্রিক সত্তা অর্থে গ্রহণ করেন। বস্তুতপক্ষে, এক্ষেত্রে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে স্বতন্ত্র। আচরণবাদে সমাজের বিভিন্ন অংশকে আলাদাভাবে অনুশীলন করা হয়। এবং তারপর এই অনুশীলনের ফলগুলিকে একত্র করে সমগ্র সমাজব্যবস্থার স্বরূপ বিচার করা হয়। সুতরাং স্পষ্টতই মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি পৃথক প্রকৃতির। মার্কসীয় তত্ত্ব অনুসারে মানুষের সমগ্র সামাজিক অস্তিত্বই রাজনীতির অঙ্গীভূত। তা ছাড়া, আচরণবাদী তত্ত্বে কেবল ঘটনাকে নিয়ে আলোচনা করা হয় এবং ধারণার প্রাধান্য বর্তমান থাকে। এই তত্ত্বে ইতিহাসের প্রভাবকে উপেক্ষা করা হয়। কিন্তু মার্কসবাদে ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি প্রভৃতিকে আলোচনা করা হয়। আবার আচরণবাদী তত্ত্ব মার্কিন রাজনীতিক ব্যবস্থার সমর্থক এবং রক্ষণশীল। কিন্তু মার্কসবাদ প্রগতিশীল এবং সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন সাধনের পক্ষপাতী।
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী: মানুষ ও জড় পদার্থের ক্ষেত্রে সার্বজনীনভাবে প্রযোজ্য সাধারণ সূত্র বা নিয়মগুলির ভিত্তিতেই মার্কসীয় দর্শনের সৃষ্টি। মানবসমাজের গতিপ্রকৃতি যে সকল সাধারণ নিয়মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। সেগুলি বর্হিজগতের সাধারণ নিয়মের ন্যায় একই রকমের। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার মাধ্যমে লব্ধ জ্ঞান উদ্দেশ্যমূলকভাবে বহিঃপ্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার কাজে ব্যবহার করা যায় এবং হয়। অনুরূপভাবে সমাজকে অধ্যয়নের দ্বারা যে জ্ঞান লাভ করা যায় তাকে সমাজব্যবস্থা পরিবর্তন বা বিকাশের কাজে ব্যবহার করা সম্ভব। মার্কসবাদ কোন বিমূর্ত নৈতিক সূত্র বা ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। বৈজ্ঞানিক সত্য হিসাবেই এই তত্ত্ব স্বীকৃতি দাবী করে। মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গীর সাহায্যে বাস্তব রাজনীতির স্বরূপ সঠিকভাবে অনুধাবন করা যায়। তাই এ হল একটি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি।
মার্কসবাদ গতিশীল: বিজ্ঞানের অপরাপর শাখার মত মানবসমাজের বিকাশ সম্পর্কে মার্কসীয় তত্ত্বের সৃষ্টি হয়েছে অভিজ্ঞতা ও ইতিহাস এবং পৃথিবী সম্পর্কিত তথ্যের ভিত্তিতে। সেইজন্য তত্ত্ব হিসাবে মার্কসবাদ গতিশীল। এর শেষ সীমারেখা টানা হয়নি। ইতিহাসের অগ্রগতি এবং মানুষের অগ্রগতি এবং মানুষের অধিকতর অভিজ্ঞতা অর্জন মার্কসবাদকে গত সমৃদ্ধ করে। মার্কস ও এ্যঙ্গেলসের মৃত্যুর পর মার্কসবাদকে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে লেনিন ও স্তালিনের অবদান উল্লেখযোগ্য। এঙ্গেলের মতানুসারে মার্কসের সমগ্র বিশ্ববিক্ষা একটা বদ্ধ ধারনা নয়, এ হল একটি পদ্ধতি; কতকগুলি অনড় সিদ্ধান্তের সমষ্টি নয়, তা হল অনুসন্ধানের প্রারম্ভিক বিন্দু ও পূর্ণতর অনুসন্ধানের ভিত্তি।
সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তন সাধনের উদ্দেশ্য: পরিশেষে স্মরণ করা দরকার যে, মার্কসবাদ নিছক জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যে সমাজ ও রাষ্ট্রকে নিয়ে গবেষণা করে না। মার্কসবাদীদের মূল উদ্দেশ্য হল বর্তমান সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তন সাধন। তা ছাড়া মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে মানুষের সমগ্র সামাজিক অস্তিত্বই রাজনীতির অন্তর্ভুক্ত। মানবসমাজের সকল স্তরে রাজনীতি জড়িত। রাজনীতির আওতার বাইরে মানবজীবনের কোন অংশই থাকতে পারে না।