গ্রামের হাট

[ সংকেত: সূচনা; হাট ও বাজারের পার্থক্য; হাটের স্থান ও বর্ণনা; হাটের উপকারিতা; উপসংহার। ]

সূচনা : আমাদের বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। এদেশের প্রায় শতকরা আশি জন মানুষ গ্রামে বাস করে। পঁচাশি হাজার গ্রাম নিয়ে বাংলাদেশ। এসব গ্রামের মানুষেরা কষিপণ্যসহ নিত্য প্রয়ােজনীয় দ্রব্যসামগ্রী ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য নির্দিষ্ট দিনে যে উন্মুক্ত স্থানে মিলিত হয় তাকেহ হাট বলে । গ্রাম-বাংলার সর্বত্রই হাট রয়েছে। এসব হাট হলাে গ্রামের আর্থনীতিক জীবনের প্রাণকেন্দ্র। 

হাট ও বাজারের পার্থক্য : হাট-বাজার এই সমাসবদ্ধ শব্দ প্রায় একই অর্থে ব্যবহৃত হলেও হাট ও বাজারের বৈশিষ্ট্য কিছুটা ভিন্ন। যেসব জায়গায় সপ্তাহে একদিন বা দুইদিন পণ্যসামগ্রী বেচা-কেনার জন্য প্রচুর লােকের সমাগম হয় সেসব স্থানকে হাট বলে । আর যেসব স্থানে প্রাতাদন দোকান বসে কিংবা যেসব স্থানে স্থায়ীভাবে অনেকগুলাে ছােটো-বড়াে দোকান আছে সেসব স্থানকে বাজার বলে। এসব বাজারের উন্মুক্ত স্থানে প্রতিদিন সকালে মাছ, দুধ, তরি-তরকারি ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য গ্রামের লােকজন জমায়েত হয়; সেগুলাে গ্রাম্য বাজার। তবে এইসব কোনাে কোনাে বাজারকে কেন্দ্র করেই বাজারের আশপাশের উক্ত ব্যাপক জায়গা জুড়ে বসে। সাপ্তাহিক হাট। হাটের দিনে দূর-দূরান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা বিপুল পণ্যসামগ্রী নিয়ে সমবেত হয়। আর আশপাশের গ্রামের মানুষেরা। সাপ্তাহিক প্রয়ােজনীয় জিনিসপত্রাদি কেনার জন্য দলে দলে আসতে থাকে হাটে। বেচাকেনাও হয় প্রচুর। সন্ধ্যার পর ক্রেতারা পণ্যসামগ্রী নিয়ে বাড়ি ফিরতে শুরু করে। অতঃপর বিক্রেতারা দোকান গুছিয়ে চলে যায় যার যার গন্তব্যে। তাই এসব হাটকে বাজার। বলা যায় না। তবে অঞ্চলভেদে হাটকে বাজারও বলে । 

হাটের স্থান ও বর্ণনা : দু-একটি গ্রাম নিয়ে একটি বাজার বসলেও হাট বসে বেশ কয়েকটি গ্রাম নিয়ে। বেশ কয়েকটি গ্রামের মাঝখানে, যেখানে সব গ্রামের মানুষের যাতায়াতের সুবিধা আছে; এমন জায়গায় হাট বসে। তবে সাধারণত নদী, খাল কিংবা সড়কপথ বা রেলপথে যাতায়াতের সুবিধা আছে, এমন স্থানেই হাট বসে। তবে দেখা যায়, পল্লির অধিকাংশ বড়াে বড়াে হাট-বাজার নদীর তীরেই অবস্থিত। নদীর তীরবর্তী কোনাে উন্মুক্ত জায়গায় যেখানে এক বা একাধিক প্রাচীন বৃক্ষ, আশপাশে সারিবদ্ধ কিছু দোকানপাট আর সামনে বৃক্ষরাজি পরিবেষ্টিত বিস্তীর্ণ মাঠ, এইতাে আমাদের নদীমাতৃক পল্লি বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য গ্রামের হাট। যেদিন হাট বসে সেদিনটিকে বলা হয় হাটবার। হাটবারে দেখা যায়, সকাল থেকেই মাল বােঝাই নৌকা আসতে শুরু করে হাটে। লঞ্চ কিংবা কার্গোতেও পণ্যসামগ্রী আসে। আসে ক্রেতা, আসে বিক্রেতা। এভাবেই ক্রেতা-বিক্রেতার সমাগম হয় হাটে। আবার যেসব অঞ্চলে নদী নেই, সেখানে বড়াে রাস্তার পাশে কিংবা রেলস্টেশনের পাশে হাট বসে। বাস, ট্রাক কিংবা রেলপথে পণ্য আনানেওয়া হয়। এভাবে শহরের কলকারখানায় উৎপাদিত পণ্য গ্রামীণ জনগােষ্ঠীর কাছে এবং গ্রামে উৎপাদিত কৃষিপণ্য শহরের মানুষের কাছে পৌঁছায়। 

গ্রামের হাটে সাধারণত দুই রকমের দোকান লক্ষ করা যায়। কিছু দোকান স্থায়ী হলেও অধিকাংশ দোকানই অস্থায়ী । অস্থায়ী দোকানগুলাে সাধারণত খােলা জায়গায় বসে। বড়াে দোকানগুলাের উপরে একটি সামিয়ানা বা অস্থায়ী ছাউনি টাঙিয়ে দেওয়া হয় । নানান ধরনের পণ্যসামগ্রীতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠে এই হাট। গ্রামের মানুষও উদ্বৃত্ত পণ্য যেমন- চাল, ডাল, মরিচ, পিঁয়াজ, রসুন, আদা, হাঁস-মুরগি, শাক-সবজি, পান, সুপারি, তামাক, গুড় ইত্যাদি নিয়ে হাটে আসে। এসব বিক্রি করে প্রয়ােজনীয় অন্যান্য পণ্য কিনে নেয়। শহর-বন্দর থেকেও ব্যাপারীরা এসে এসব পণ্যসামগ্রী কিনে নৌকা, কার্গো কিংবা ট্রাক বােঝাই করে নিয়ে যায় শহর-বন্দরনগরে। 

হাটে বেচা-কেনার সুবিধার্থে হাটের এক এক অংশ এক এক ধরনের পণ্যের জন্য নির্ধারিত থাকে এবং দোকানগুলাে থাকে সারিবদ্ধভাবে। হাটের একাংশে থাকে কাঁচাবাজার; এখানে: শাক-সবজি, পান-সুপারি ইত্যাদি পাওয়া যায়। এর পাশেই সাধারণত মাছের বাজার ও হাঁস-মুরগির বাজার থাকে। আরেক অংশে থাকে পিয়াজ, মরিচ, ডাল, আদা, রসুন ইত্যাদির বাজার । অন্য আরেক অংশে থাকে চালের বাজার । এক অংশে থাকে শাড়ি, লুঙ্গিসহ স্বল্পমূল্যের তৈরি পােশাকের দোকান। এসব দোকানের আশপাশেই থাকে হােটেল ও চায়ের দোকান। এছাড়া কামার-কুমার, ছুতােরের তৈরি জিনিসপত্র যেমন- দা, কুড়াল, খন্তা, কাস্তে, বেলুন-পিঁড়ি, কলসি, হাঁড়ি-পাতিল এবং সিলভার ও প্রাস্টিকের তৈরি বালতি, ডেকচি, কলসি ইত্যাদি পর্যাপ্ত পাওয়া যায় এসব হাটে। কোনাে কোনাে হাটে গােরু-ছাগল বেচাকেনার বাজারও বসে। তাছাড়া রয়েছে বিচিত্র পােশাকে বিভিন্ন ফেরিওয়ালার নানা পণ্য বিক্রয়ের নানান আওয়াজ, এরা কখনাে বসে, কখনাে ফেরি করে বেড়ায়। হাটের পাশেই বসে বিভিন্ন ক্যানভাসারের জলসা । কোথাও দেখা যায় সবাইকে রসালাে কিংবা আদি রসাত্মক বক্তৃতা কিংবা গান করে নানান কবিরাজি ঔষধ বিক্রি করছে। কোথাও মাইকে রেকর্ড বাজিয়ে কবিরাজি, ইউনানি ঔষধসহ ইঁদুর, তেলাপােকা, পােকামাকড়, উকুন ও ছারপােকা মারার ঔষধ বিক্রি করা হচ্ছে। 

হাটের উপকারিতা : হাটের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলাে সেখানে সব ধরনের পণ্যসামগ্রীর সমাবেশ ঘটে । আর এসব পণ্যসামগ্রী কিছুটা কম। দামে ক্রেতারা কিনতে পারে। এতে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েরই লাভ হয়। বিক্রেতারা বেশি বেশি পণ্য বিক্রি করতে পারে আর অগণিত জনসাধারণ কিছুটা কম দামে প্রয়ােজনীয় দ্রব্যাদি কিনতে পারে। শহর-বন্দর ও দূর-দূরান্ত থেকে আসা পণ্যসামগ্রী গ্রামের মানুষ যেমন হাট থেকে কিনতে পারে তেমনি তাদের উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীও বিক্রি করতে পারে ব্যাপারীদের কাছে। এসব পণ্য শহরের মানুষের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হয়। একথা স্পষ্ট যে, গ্রামের আর্থনীতিক জীবনের সঙ্গে হাটের সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । পল্লির পণ্যসামগ্রী শহরে এবং শহরের পণ্যসামগ্রী গ্রামে পৌঁছানাের ক্ষেত্রে মধ্যস্থল হিসেবে গ্রাম্য হাটের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সুতরাং গ্রামীণ বা পল্লি অঞ্চলে মানুষের জীবনে গ্রাম্য হাটের প্রয়ােজনীয়তা অপরিহার্য।

উপসংহার : গ্রাম্য হাট পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের পাশাপাশি গ্রামীণ মানুষের পারস্পরিক যােগাযােগ, পারস্পরিক প্রীতি ও ভাব বিনিময়ের এক অপূর্ব মিলনস্থল। বিভিন্ন গ্রামের লােকজন প্রতি সপ্তাহে হাটে আসে বলে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজন, পরিচিত পরিজনের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ ও কুশল বিনিময়ের সুযােগ ঘটে। তাই গ্রাম্য হাট পল্লিজীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ মিলনমেলা। এর প্রয়ােজনীয়তা অপরিসীম।

Rate this post