ধান

ভূমিকা : ধান বাংলাদেশের প্রধান কৃষিজাত ফসল ও প্রধান খাদ্যশস্য। ধান থেকে চাল পাওয়া যায়; চাল থেকে ভাত পাওয়া যায়। ভাত বাঙালির প্রধান খাদ্য। পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক মানুষ ভাত খেয়ে জীবন ধারণ করে।

প্রাপ্তিস্থান : পৃথিবীর অনেক দেশেই ধান উৎপন্ন হয়ে থাকে। তন্মধ্যে চীন, জাপান, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, উত্তর আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ, মিশর, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি দেশে ধানের চাষ বেশি হয়। স্পেন, পর্তুগাল, ইতালি, আমেরিকার মেক্সিকো উপসাগরীয় অঞ্চলেও অধিক পরিমাণে ধান জন্মে। বাংলাদেশের বরিশাল বিভাগে প্রচুর ধান উৎপন্ন হয় বলে একে বাংলাদেশের শস্যভাণ্ডার নামে অভিহিত করা হয়।

ধান গাছের বর্ণনা : ধান গাছ এক ধরনের তৃণজাতীয় উদ্ভিদ। একবার ফসল দিয়ে ধান গাছ মরে যায় বলে একে ‘ঔষধি গাছ’ও বলা হয়। ধান গাছ সাধারণত দুই থেকে তিন ফুট উঁচু হয়। তবে বেশি পানির মধ্যে রােপা আমন ধানের গাছ সাড়ে চার ফুট পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। ধান গাছের অগ্রভাগে ধানের শীষ বের হয়। ধান গাছ যখন কাচা থাকে তখন মাঠের দিকে তাকালে মনে হয় যেন সবুজের মেলা বসেছে। এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে শীষ পাকলে সারা মাঠ সােনালি ধানে ভরে যায়।

প্রকারভেদ : বিশেষজ্ঞদের মতে, পৃথিবীতে প্রায় পঞ্চাশ রকমের ধান আছে। আমাদের দেশে ধান প্রধানত তিন প্রকার: আউশ, আমন ও বােরাে। এছাড়া বর্তমানে অধিক ফলনশীল ‘ইরি’ ও ‘ব্রি’ ধানের চাষও বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে হচ্ছে। এসব উন্নতজাতের ধানের চাষ বছরের যে কোনাে সময়েই করা যায়। তবে এগুলাের জন্যে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি সেচের প্রয়ােজন।

চাষ প্রণালী : ধান উৎপাদনের জন্যে উত্তমরূপে জমি চাষ করতে হয়। ভালভাবে জমি চাষ করে মই দিয়ে ধানের ক্ষেত প্রস্তুত করতে হয়। পরে প্রয়ােজনমতাে সার দিতে হয়।

আউশ ধানের চাষ : জমি ভালভাবে চাষ করে চৈত্র বৈশাখ মাসে আউশ ধানের বীজ বপন করা হয়। বপনের প্রায় দশ দিনের মধ্যে বীজ অঙ্কুরিত হয়। চারা একটু বড় হলে আঁচড়া দিয়ে মাটি আলগা করে দিতে হয়। তারপর নিড়ানি। দিয়ে আগাছা তুলে ফেলতে হয়। আষাঢ় মাসের শেষ কিংবা শ্রাবণ মাসের প্রথম দিকে আউশ ধান পাকে।

আমন ধানের চাষ : আমন ধানের চাষে বপন ও রােপণ উভয় প্রক্রিয়া লাগে। সাধারণত নিচু জমিতে আষাঢ় মাসে বীজতলা তৈরি করতে হয়। চারা একটু বড় হলে বীজতলা থেকে তুলে নিয়ে জমিতে রােপণ করা হয়। অগ্রহায়ণ পৌষ মাসে আমন ধান পাকে। 

বােররা ও ইরির চাষ : সাধারণত পৌষ মাঘ মাসে বােরাে ও ইরি ধানের চারা রােপণ করতে হয়। চারার গােড়ায় অল্প পরিমাণে পানি জমে থাকার প্রয়ােজন হয়। ইরি ধানের ক্ষেতে প্রচুর সার প্রয়ােগ করতে হয় এবং সেচ দিতে হয়। ইরি ধান প্রায় নব্বই দিনের মধ্যে ফসল দেয়। এর ফলন অত্যন্ত বেশি। জ্যৈষ্ঠ মাসের দিকে ইরি-বােরাে ধান কাটা হয়।

চাল প্রস্তুত প্রণালী : ধান পাকলে কৃষকেরা তা কেটে আঁটি বেঁধে বাড়িতে এনে স্তুপ করে রাখে। দুচারদিন পর গরু-মহিষের সাহায্যে ‘মলন’ দিয়ে বা মাড়িয়ে ধানকে খড় থেকে আলাদা করা হয়। এরপর ধান রােদে শুকিয়ে রাখা হয়। পরে কলে বা কেঁকিতে হেঁটে ধান থেকে চাল বের করা হয়। এইরূপ চালকে আতপ চাল বলে। গরম পানিতে সিদ্ধ করে। তারপর রােদে শুকিয়েও ধান থেকে এক ধরনের চাল বের করা হয় তাকে সিদ্ধ চাল বলে।

ধানের প্রয়ােজনীয়তা : ধান মানুষের সবচেয়ে প্রয়ােজনীয় ফসল। পৃথিবীর অধিকাংশ লােকের প্রধান খাদ্য চাল। চাল থেকে ভাত ছাড়াও খৈ, চিড়া, মুড়ি, পায়েস, ফিরনি প্রভৃতি উপাদেয় খাদ্য এবং নানারকম পিঠে তৈরি হয়। ধানের। কোনাে কিছুই ফেলা যায় না। ধান আলাদা করে নেওয়ার পর খড়-বিচালি গরু-মোষের খাদ্যরূপে ব্যবহৃত হয়। খড় গরিব লােকের ঘরের চালা তৈরি করতেও কাজে লাগে। ধানের খােসা বা তুষ জ্বালানিরূপে ব্যবহৃত হয়। ধান ভানার পর যে কঁড়া বের হয়, তা হাঁস-মুরগি ও গরু-বাছুরের খাদ্য। এভাবে দেখা যায়, ধান মানুষের অনেক উপকারে আসে। ধানের ওপর নির্ভর করে পৃথিবীর অসংখ্য জনগােষ্ঠী জীবন ধারণ করে।

উপসংহার : খাদ্যশস্যের দিক দিয়ে বাংলাদেশ একসময় স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও চাল রপ্তানি করা হতো। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বর্তমানে বাংলাদেশে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এদেশের কৃষককুল এখনাে মান্ধাতার আমলের চাষপ্রণালী অবলম্বন করে। বৈজ্ঞানিক উপায়ে চাষাবাদ করা হলে এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে সার কীটনাশক ও পানিসেচের ব্যবস্থা করা গেল খাদ্য ঘাটতি হ্রাস পাবে এবং বাংলাদেশ থেকে আবারও চাল রপ্তানি করা সম্ভব হতে এতে কোনাে সন্দেহ নেই।

Rate this post