ই-মেইল (Electronic Mail)

[সংকেত : ভূমিকা; ই-মেইল বলতে যা বোঝায়; ই-মেইল উদ্ভাবন; ই-মেইলের কার্যপ্রক্রিয়া; ই-মেইলের সুযোগ-সুবিধা; বিভিন্ন ক্ষেত্রে ই-মেইল ব্যবহার; বাংলাদেশে ই-মেইলের প্রচলন; ই-মেইলের গোপনীয়তা রক্ষা; ই-মেইলের ক্ষতিকর প্রভাব; উপসংহার ।]

ভূমিকা : বিশ শতকের ধ্যান-ধারণা, নীতিকাঠামো, মানুষে মানুষে যোগাযোগ, রাষ্ট্র ও মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক, দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ধরন, অর্থনীতি, সমাজনীতি সবকিছু উনিশ শতকে এসে প্রযুক্তির কারণে বদলে গিয়ে নাটকীয় এক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। প্রযুক্তির এমন অবাধ-বিস্তার ও ক্রমবিকাশের ধারায় ‘ই-মেইল’ সাম্প্রতিক সময়ের দ্রুত সম্প্রসারণশীল একটি যোগাযোগ মাধ্যম । আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে এটি এক বিস্ময়কর আবিষ্কার । বস্তুত বিশ্বব্যাপী যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও প্রসারে এটা সর্বাধুনিক ও সর্বশেষ মাধ্যম । মুহূর্তের মধ্যে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে খবরাখবর পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে এর চেয়ে উন্নত মাধ্যম আর নেই । এ অদৃশ্য যোগাযোগ প্রক্রিয়াটি পৃথিবীর সকল মানুষকে একসূত্রে গেঁথে ফেলেছে। এভাবে ই-মেইল বিশ্বমানবের যোগাযোগের ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।

ই-মেইল বলতে যা বোঝায় : ই-মেইল বা ইলেকট্রনিক মেইল হলো কম্পিউটার নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে এক কম্পিউটার থেকে অন্য কম্পিউটারে তথ্য আদান-প্রদান ব্যবস্থা। ই-মেইলের মাধ্যমে টেক্সট বার্তার সঙ্গে কম্পিউটার ফাইলও পাঠানো যায় । লোকাল এরিয়া নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে সীমিত স্থানের মধ্যে এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে সারা বিশ্বের যেকোনো স্থানে ই-মেইল পাঠানো যায়। ডাকযোগে চিঠি পাঠাতে হলে যেমন ঠিকানা প্রয়োজন, তেমনি ই-মেইল পাঠাতেও ঠিকানা প্রয়োজন। ইন্টারনেটে যুক্ত প্রতিটি কম্পিউটারের ঠিকানা আছে । ইন্টারনেট সার্ভিস প্রভাইডারের সাথে সংযোগ নেওয়ার সময় এ ঠিকানা সরবরাহ করা হয়। বস্তুত ই- মেইলের ধারণাটি প্রচলিত ডাক ব্যবস্থার মতোই। একটি জিপিওতে যেমন অনেকের নামে পোস্ট বক্স থাকে, তেমনি ই-মেইল পদ্ধতিতে ব্যবহারকারীর একটি ই-মেইল বক্স থাকে। এই বক্সের ইনবক্স ও আউটবক্স অন্তর্মুখী ও বহির্মুখী ডাক সংরক্ষণ করে। 

ই-মেইল উদ্ভাবন : ১৯৬৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ই-মেইলের সূত্রপাত ঘটে । বিশ্বের দুই পরাশক্তি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চরম স্নায়ুযুদ্ধের কারণে উভয়পক্ষের সমরবিশারদগণ পারমাণবিক বোমার আতঙ্কে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠেন এমতাবস্থায় যোগাযোগ মাধ্যমকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য টেলিযোগাযোগের বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে ই-মেইল পদ্ধতির উদ্ভাবন করা হয় । অতঃপর ই-মেইলের ব্যবহার বিশ্বব্যাপী দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এ পদ্ধতিতে গ্রাহকগণ অপেক্ষাকৃত কম খরচে ইন্টারনেটের মাধ্যমে যোগাযোগ ও তথ্য আদান-প্রদান করতে পারে । বস্তুত ইন্টারনেট প্রযুক্তির চূড়ান্ত উৎকর্ষ সাধনে ই-মেইল একটি অভূতপূর্ব উদ্ভাবন।

ই-মেইলের কার্যপ্রক্রিয়া : ই-মেইল সেবার ক্ষেত্রে তিনটি জিনিসের একান্ত প্রয়োজন, তা হলো— কম্পিউটার, মডেম ও টেলিফোন । কম্পিউটারকে সংযুক্ত হতে হয় একটি টেলিফোন লাইনের সঙ্গে এবং উক্ত কম্পিউটারটিতে বিশেষ ধরনের সফটওয়্যার থাকা বাঞ্ছনীয়— যা ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা সংবলিত । ইন্টারনেট সংযোগ প্রদানকারী স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক হওয়ার পর নিজস্ব ই- মেইল সংযোগ পাওয়া যায় । ই-মেইল পদ্ধতিতে গ্রাহকগণ নিকটবর্তী কোনো সার্ভারকে মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করে তথ্য আদান-প্রদান করে থাকে । প্রধান প্রধান শহরে স্থাপিত সার্ভারসমূহ ইন্টারনেটের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত প্রধান সার্ভারের সঙ্গে সমন্বিত থাকে । সাধারণ গ্রাহকগণ লোকাল কলের মাধ্যমে প্রধান শহরে স্থাপিত সার্ভারের সাথে সংযুক্ত হয়ে তথ্যসমূহ উক্ত সার্ভারে প্রেরণ করে । দিনের নির্দিষ্ট কোনো সময়ে সার্ভারে জমাকৃত সকল তথ্য পাঠিয়ে দেওয়া হয় ইন্টারনেটের সাথে সম্পর্কযুক্ত প্রধান সার্ভারে । সেখান থেকে তথ্যসমূহ চলে যায় স্ব স্ব ঠিকানায় । উপর্যুক্ত কাজটি অতি দ্রুত সম্পন্ন হয় । ই-মেইল নেটওয়ার্কের সাহায্যে পৃথিবীব্যাপী বিশাল যোগাযোগ মাধ্যমকে অল্প খরচে সবাই ব্যবহার করতে পারে এবং এর কার্যপ্রক্রিয়া এত দ্রুত যে, দূরকে আর দূর বলেই মনে হয় না । বিশ্বকে মনে হয় নিছকই বড়ো একটি গ্রাম ।

ই-মেইলের সুযোগ-সুবিধা : ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিশ্বের যেকোনো স্থানে ই-মেইল পাঠিয়ে যোগাযোগ করা সম্ভব । একটি টাইপ করা মেইল একাধিক ই-মেইল অ্যাড্রেসে প্রেরণ করা যায় । এক্ষেত্রে বারবার টাইপ করার প্রয়োজন হয় না। ই-মেইলের মাধ্যমে টেক্সট ডকুমেন্ট দ্বারা সরাসরি যেকোনো কম্পিউটারে যোগাযোগ করা যায়। বস্তুত সরাসরি চিঠি প্রাপ্তির জন্যই ইলেকট্রনিক পদ্ধতির চিঠি হিসেবে ই-মেইলের উদ্ভাবন ও প্রচলন হয়েছে। স্বল্পতম সময়ে যোগাযোগের মাধ্যম হলো ই-মেইল। বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ই-মেইল যেতে এক সেকেন্ডেরও কম সময় লাগে। ব্যবসায়িক যোগাযোগের ক্ষেত্রে ই-মেইল এক অভাবনীয় আবিষ্কার ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্য ও ব্যবসায়িক খোঁজ-খবরের জন্য ই-মেইল ব্যবহার করে। বিভিন্ন দেশে অবস্থিত আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু- বান্ধবের সঙ্গে তাৎক্ষণিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে ই-মেইল সত্যিই একটি উত্তম মাধ্যম।

বিভিন্ন ক্ষেত্রে ই-মেইল ব্যবহার : ই-মেইল বিশ্ব যোগাযোগের ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী বিপ্লব এনে দিয়েছে। কেবল ব্যক্তিগত যোগাযোগের ক্ষেত্রেই নয়, ব্যবসায়-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি প্রভৃতি ক্ষেত্রেও ই-মেইলের ব্যাপক ব্যবহার পরিলক্ষিত হয় । ই-মেইল বিশ্ববাণিজ্যে নতুন প্রাণ এনে দিয়েছে। বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে যেকোনো শিক্ষার্থী ভর্তি বা লেখাপড়া সংক্রান্ত তথ্যাবলি ই- মেইলের মাধ্যমে সংগ্রহ করতে পারে । জন্মদিন, বিভিন্ন দিবস উপলক্ষ্য প্রভৃতিতে বহুদূরে অবস্থান করেও একজন শুভাকাঙ্ক্ষী তার প্রিয়জনকে ই-মেইলের মাধ্যমে শুভেচ্ছা জানাতে পারে; প্রকাশ করতে পারে সুখ-দুঃখসহ হৃদয়ের বিচিত্র অনুভূতি। মোটকথা, ই- মেইল পত্র যোগাযোগের দ্রুততম একটি পদ্ধতি — যা সঠিক স্থানে নির্ভুলভাবে পৌঁছে যায়। তাই যোগাযোগের ক্ষেত্রে ই-মেইলের অবদান অপরিসীম।

বাংলাদেশে ই-মেইলের প্রচলন : বাংলাদেশে ১৯৯৩ সালের ডিসেম্বর মাসে ইন্টারনেটের পাশাপাশি ই-মেইলের ব্যবহার শুরু হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ ই-মেইল সার্ভিসের বিশাল জগতে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছে। শিক্ষা, চিকিৎসা, বিদেশ গমন, চাকরির অনুসন্ধান প্রভৃতি ক্ষেত্রে বাংলাদেশি জনগণ আজ ই-মেইল ব্যবহার করে বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগ রাখছে । দিন যতই যাচ্ছে প্রযুক্তি ততই উন্নত থেকে উন্নততর হচ্ছে। সেই উন্নতির ধারায় ই-মেইল একটি অত্যাশ্চর্য সংযোজন । বাংলাদেশও সেই উদ্ভাবনী যুগের আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে ক্রমোন্নতির দিকে অগ্রসরমান।

ই-মেইলের গোপনীয়তা রক্ষা : তথ্যসমূহ আদান-প্রদানের উল্লিখিত পদ্ধতি দেখে অনেকেই এর গোপনীয়তা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করে থাকে । কিন্তু যারা ই-মেইল ব্যবহার করে তারা এ বিষয়ে অবগত আছে যে, ই-মেইল ব্যবহারের সময় ডকুমেন্ট প্রেরণের নিমিত্তে একাউন্টে প্রবেশ করার পূর্বে একটি পাসওয়ার্ড দিয়ে লগ ইন করতে হয় । অন্য কারও গোপন পাসওয়ার্ডটি জানা থাকে না বিধায় শুধু প্রাপক ব্যতীত উক্ত ডকুমেন্টটি আর কেউ ওপেন করতে পারে না । তাছাড়া ডকুমেন্টসমূহ সার্ভারের নিজস্ব একাউন্টে প্রেরণ করা হয় । এই একাউন্টেও ব্যবহারকারীর নিজস্ব পাসওয়ার্ড ব্যতীত প্রবেশ করা সম্ভব নয় । ফলে প্রেরিত তথ্যসমূহের গোপনীয়তা শতভাগ নিশ্চিত থাকে । বস্তুত পাসওয়ার্ড নিরাপদ বিধায় ডকুমেন্টসমূহ যে কেউ বিকৃত বা পরিবর্তন যেমন করতে পারে না, তেমনি তথ্যসমূহ ডিলিট করাও অসম্ভব ।

ই-মেইলের ক্ষতিকর প্রভাব : ই-মেইল ব্যবহারে সুবিধার পাশাপাশি কিছু অসুবিধাও রয়েছে। ইতোমধ্যে এর মাধ্যমে ভুল তথ্য প্রেরণ, গ্রাহকদের হয়রানি এবং অশ্লীলতা প্রসারের অভিযোগ উঠেছে। ই-মেইলের মাধ্যমে অপরাধীচক্র সহজেই নিজেদের মধ্যে তথ্য বিনিময় করছে এবং অনেক সময় বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রেরণ করে উদ্বেগ ও বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে। সাইবার অপরাধীরা তাদের কুতৎপরতা চালিয়ে, প্রযুক্তির সুবিধা কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন অপকর্ম সংঘটিত করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ মানি চুরি সাম্প্রতিককালে তার একটি জ্বলন্ত প্রমাণ । যদিও ই-মেইলের ক্ষেত্রে অপরাধ-সংঘটনের মাত্রা নিতান্তই কম, তাই ই-মেইলের উপকারিতাই মানব কল্যাণার্থে অধিক বলে বিবেচ্য ।

উপসংহার : এ কথা নিঃসন্দেহে অনস্বীকার্য যে, ই-মেইল আধুনিক কম্পিউটার বিজ্ঞানের এক বিস্ময়কর সৃষ্টি। তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়ন ও প্রসারের ক্ষেত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। এর বহুমুখী সুবিধা আজ মানুষের জীবনে আমূল পরিবর্তন আনয়ন করেছে। ই- মেইল জীবনকে করেছে স্বাচ্ছন্দ্যময়, বিশ্বকে এনেছে হাতের মুঠোয়। ই-মেইল ব্যবহারের সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশও বহুল উপকৃত হতে পারে । তথ্য-প্রযুক্তি বাংলাদেশের আপামর জনগণের জন্য এক বিরাট সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হয়েছে, সকলে তা পূর্ণ উদ্যমে গ্রহণ করার জন্য এগিয়ে এলেই এই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়া সম্ভব হবে এবং বাংলাদেশ হবে একটি সুখী, সমৃদ্ধ ও উন্নত দেশ।

Rate this post