প্রশ্নঃ ‘রাষ্ট্রের ভিত্তি হচ্ছে সম্মতি, বল নহে’- আলােচনা কর।

অথবা, সমালােচনাসহ রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কিত বলপ্রয়োেগ মতবাদ আলােচনা কর।

ভূমিকাঃ রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে বলপ্রয়ােগ মতবাদের ভিত্তি হচ্ছে মানুষের আদিম প্রকৃতি। মানুষ একাধারে সামাজিক জীব ও কলহপ্রিয় জীব। কলহপ্রীতি ও ক্ষমতা লিপ্সর জন্য মানুষ আদিকাল থেকেই বলপ্রয়ােগ করে আসছে। রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বিভিন্ন মত প্রদান করেছেন। তাদের মধ্যে বলপ্রয়ােগ মতবাদ উল্লেখযােগ্য।

বলপ্রয়োগ মতবাদঃ রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কিত বলপ্রয়ােগ মতবাদের মূল প্রবক্তা হলেন Prof Jenks. তিনি লিখেছেন, ঐতিহাসিক দিক থেকে এটি প্রমাণ করা সামান্যতম কঠিন নয় যে আধুনিক ধরনের সব রাষ্ট্রীয় সমাজই সব যুদ্ধ হতে সৃষ্টি হয়েছে। বলপ্রয়ােগ মতবাদের মূল বক্তব্য হচ্ছে শক্তিই রাষ্ট্রের মূলভিত্তি। এ মতবাদে বলা হয় মানুষের কার্যকলাপ ও আচরণ, ক্ষমতালিপ্সা ও আত্মশক্তির প্রকাশ এ দুটি প্রবৃত্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এ মতবাদ অনুসারে মানুষের আদিম জীবনে যুদ্ধ ও সংঘাত চলছিল এবং শক্তিশালী শ্রেণী দুর্বল শ্রেণীকে সর্বদাই পরাজিত করেছে ও দাসে পরিণত করেছে। আদিম সমাজে বিভিন্ন বংশ ও উপজাতির মধ্যে কলহ-বিবাদ শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রের বিকাশে সহায়তা করেছিল। Oppenheimer বলেন, উৎপত্তিতে সম্পূর্ণভাবে ও অস্তিত্বের প্রথম পর্যায়ে রাষ্ট্র অপরিহার্যভাবে বিজয়ীর বলপ্রয়ােগ দ্বারা বিজিত মনুষ্য সম্প্রদায়ের ওপর এক সামাজিক প্রতিষ্ঠান।

বলপ্রয়ােগ মতবাদের সমর্থকগণঃ অধ্যাপক লিকক, ডেভিড হিউম, জেলেনিক, জেংক ও ওপেন হেইমার এই মতবাদের সমর্থক। বলপ্রয়ােগ মতবাদকে বিভিন্ন নীতির সমর্থনে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন চিন্তাবিদগণ ব্যবহার করেছেন। কোনাে কোনাে গ্রিক দার্শনিক মনে করেন কেবল বল প্রয়ােগেই সাধারণ মানুষকে সৎপথে পরিচালিত করা যায়। সুতরাং রাষ্ট্রকে বলপ্রয়ােগ করে যেতে হবে। মধ্যযুগের খ্রিস্টান ধর্মযাজকগণ মনে করতেন, খ্রিস্টান সংগঠন খােদার সৃষ্টি আর রাষ্ট্র পাশবিক বল প্রয়ােগের সৃষ্টি। বার্নহাডি, সােরেল, নিটশে, টেইটস্কী প্রমুখ আধুনিক জার্মান চিন্তাবিদের লেখনীতে বল প্রয়ােগ মতবাদ নতুনরূপ পরিগ্রহ করেছে। তারা গৌরব ও শক্তির দিক দিয়ে জার্মানিকে শীর্ষস্থানে নিয়ে যাবার উদ্দেশ্যে নগ্ন বলপ্রয়ােগের মতবাদ প্রচার করেন। তারা রাষ্ট্রকে ‘শক্তিরই প্রতীক’ বলে মনে করেন। ওপেন হেইমার বলেন, ‘জন্মলগ্নে ও অস্তিত্বের প্রথম পর্যায়ে অনিবার্যভাবে রাষ্ট্র ছিল বিজিত গােষ্ঠীর ওপর প্রতিষ্ঠিত বিজেতা গােষ্ঠীর এক সামাজিক সংস্থা।’

বলপ্রয়োেগ মতবাদের সমালােচনাঃ রাষ্ট্রের বলপ্রয়ােগ মতবাদ- এর সপক্ষে যুক্তির প্রাচুর্য ও ঐতিহাসিক ভিত্তি থাকা সত্ত্বেও এর বিপক্ষের যুক্তিসমূহ খুবই ক্ষুরধার ও তীব্র। সমালোচকদের মতে, বলপ্রয়ােগ মতবাদ ভ্রান্ত। পাশবিক শক্তি রাষ্ট্র গঠনে অন্যতম উপাদান সন্দেহ নেই কিন্তু একমাত্র উপাদান নয়। শক্তি ছাড়াও মানুষের সামাজিক প্রকৃতি, ধর্মীয় বন্ধন, রাজনৈতিক চেতনা প্রভৃতি রাষ্ট্র গঠনে কার্যকর রয়েছে। রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কিত বলপ্রয়ােগ মতবাদের একজন ঘােরতর বিরােধী হচ্ছে T. H. Green. তিনি এ মতবাদের পূর্ণ বিরােধিতা করে বলেন, Will not force is the basis of the state. শক্তি নয় ইচ্ছাই রাষ্ট্রের ভিত্তি। এটাই ছিল মূলত Green-এর রাষ্ট্রচিন্তার মূল ভিত্তি। এখানে বলা প্রয়ােজন যে, শক্তির ওপর ভিত্তি করে কোন রাষ্ট্রই টিকে থাকতে পারে না। রাষ্ট্রের স্থায়িত্বের জন্য জনগণের ইচ্ছা ও সম্মতি একান্ত প্রয়ােজন। জার্মানির হিটলার, রাশিয়ার জার, ইটালির মুসােলিনি, ইংল্যান্ডের ক্রমওয়েল এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। T. H. Green-এর উপযুক্ত উক্তির সূত্র ধরেই এ মতবাদের সমালােচনা করলে যা স্পষ্ট হয়ে ওঠে তা হলাে-

(১) রাষ্ট্র কোনাে আপদ নয় কল্যাণঃ বলপ্রয়ােগই যদি রাষ্ট্রের ভিত্তি হয় তাহলে রাষ্ট্র একটি আপদ। কিন্তু রাষ্ট্র মূলত একটি কল্যাণকর প্রতিষ্ঠান। আর বলপ্রয়ােগ কখনাে কল্যাণ আনতে পারে না।

(২) অযৌক্তিকঃ রাষ্ট্র বল প্রয়ােগের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে এবং বল প্রয়ােগের মাধ্যমে টিকে আছে। এটি অযৌক্তিক। কারণ যদি তাই হয় তবে শক্তিশালী রাষ্ট্রের কাছে দুর্বল রাষ্ট্রগুলাে কখনাে টিকে থাকতে পারে না।

(৩) মানবতাবিরােধীঃ বলপ্রয়ােগ মতবাদ মানুষের ক্ষমতালিপ্সার প্রবৃত্তিকে প্রবলভাবে বৃদ্ধি করে। ফলে মানুষের মধ্যে কলহ ও বিবাদের মানসিকতা জন্ম নেয়।

(৪) গণতন্ত্র বিরােধীঃ গণতন্ত্র হচ্ছে পারস্পরিক পরামর্শ, আলাপ-আলোচনা, সমালােচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া বা মাধ্যম। আর বলপ্রয়ােগ মতবাদে এ ধরনের পারস্পরিক পরামর্শের পরিবর্তে যুদ্ধ-কহলকে উৎসাহ দেয়া হয়। এটি গণতন্ত্র বিরােধী।

(৫) রাষ্ট্রের ভিত্তি মানবসম্মতি বা ইচ্ছাঃ Green মনে করেন, রাষ্ট্রের ভিত্তি মানব-সম্মতি বা ইচ্ছা। তিনি আরাে মনে করেন, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব প্রশ্নাতীত, কিন্তু এর ক্ষমতা সীমাহীন নয়। রাষ্ট্র মানব সম্মতির ভিত্তি মূলে প্রতিষ্ঠিত বল বা ক্ষমতা নয়।

(৬) শান্তি বিরােধীঃ বলপ্রয়ােগ মতবাদে এক বন্য পরিবেশ কল্পনা করা হয়। যেখানে জোরের রাজত্বই একমাত্র কার্যকর ব্যবস্থা। এটি আইন, শান্তি, সংহতি ও শৃঙ্খলা বিরােধী। এটি যুদ্ধবাদের নামান্তর।

(৭) স্বৈরতন্ত্রের সমর্থকঃ বলপ্রয়ােগ মতবাদ শুধু শক্তিকেই ভক্তি করে এবং স্বৈরতন্ত্রকে সমর্থন করে। বলপ্রয়ােগ মতবাদ স্বৈরশক্তিকে ইন্ধন যােগায়।

(৮) বিপজ্জনক মতবাদঃ বলপ্রয়ােগ মতবাদ বিপজ্জনক। এ মতবাদের অনুসরণের ফলে রাষ্ট্রের মধ্যে শক্তি প্রয়ােগের বাসনা জাগরিত হয়, ফলে রাষ্ট্রে অরাজকতা সৃষ্টি হয়।

মূল্যায়নঃ বহু সমালােচনা আছে সত্য, তবে পুরাকাল থেকে আধুনিককাল পর্যন্ত সময়ে এর বহু সমর্থক দেখতে পাই। শক্তিকে ভিত্তি করে যে বহু রাষ্ট্র গড়ে ওঠেছে তা অস্বীকার করা যাবে না। প্রাচীন সমাজেও গােত্র প্রধানগণ ক্ষমতাবলে প্রাধান্য বলবৎ রাখত। বলপ্রয়ােগের মাধ্যমে রাষ্ট্র গঠন বা প্রভাব বিস্তারের কতিপয় দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হলাে

(১) রােমান সম্রাটঃ রােমান সম্রাট আলেকজান্ডার যে বিশাল সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তার মূলে ছিল শক্তি বা বল। বলপ্রয়ােগের মাধ্যমেই তিনি এটি সম্ভবপর করেছিলেন।

(২) মােগল সম্রাটঃ মােগল সম্রাট পাক-ভারত উপমহাদেশে যে বিরাট সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং দীর্ঘদিন ধরে রেখেছিল তার পাশ্চাতেও ক্রিয়াশীল ছিল প্রবল শক্তি।

(৩) ইতালির মুসােলিনীঃ মুসােলিনীর মতে, শান্তি হলাে ত্যাগের মােকাবিলায় কাপুরুষজনিত কাজ। তিনিও শক্তি প্রয়ােগের মাধ্যমে তার প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়েছিলেন।

(৫) টমাস হবসঃ ইংরেজ দার্শনিক টমাস হবসও শক্তি প্রয়ােগকে সমর্থন করেছেন। ইংল্যান্ডের চরম এক মুহূর্তে টমাস হবস রাজাকে চরমশক্তি প্রয়ােগের পরামর্শ দিয়েছেন। শক্তি প্রয়ােগের উল্লিখিত দৃষ্টান্ত থাকা সত্ত্বেও বলা যায় যে, শক্তি প্রয়ােগের মাধ্যমে রাষ্ট্র সৃষ্টি বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে, কিন্তু শক্তির আশ্রয় নিয়ে রাষ্ট্রকে স্থায়ী করা যায় না। রাষ্ট্রকে একটি স্থায়ী প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হলে শক্তি নয়, জনসমর্থনই আবশ্যক।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, শক্তি কখনাে রাষ্ট্রের ভিত্তি হতে পারে না এবং শক্তি রাষ্ট্রকে বেশিদিন টিকিয়ে রাখতে পারে না। রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখার সর্বাগ্রে যেটি প্রয়ােজন তা হলাে জনগণের সম্মতি। জনগণের সম্মতি না থাকলে পাশবিক শক্তি বিভেদের সৃষ্টি করে, যা রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর নয়। সুতরাং আমরা বলতে পারি বলপ্রয়ােগ মতবাদের পক্ষের যুক্তির চেয়ে বিপক্ষের যুক্তির তীব্রতা অনেক বেশি।

Rate this post