জ্যোৎস্নার আলাে-ছায়ার নৃত্যে প্রকৃতিপ্রেমী নিসর্গবিলাসীর শিরা-উপশিরা দুলে ওঠে । আলাের চুম্বনের দাগ প্রকৃতির অধরে । চাদের মায়াবী আলােয় রাতকে দিন বলে ভ্রম হয়। এমন স্বগীয় সৌন্দর্যমণ্ডিত রাত মানুষের সমস্ত প্রয়ােজনের অতীত । এ যেন কেবল অকারণ আনন্দ উপভােগের জন্য উদযাপিত । সমস্ত কর্মচাঞ্চল্যের অবসানে, স্বার্থমগ্ন জগৎ-সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এ যেন পরম এক শৈল্পিক উপলব্ধি; এক সুন্দর স্বভাব বিরহের মধুরতা । তখন যেন কোন হৃত-জন-মুখ চাদের অবয়বে ফুটে ওঠে আর উচাটন মনে অবদমিত বেদনায় গানের কলি বাজে —


আজি জ্যোৎস্নার পরশনে
কার কথা পড়ে মনে।

না -বলা কথার ধ্যান মৃদঙ্গধ্বনির মতাে কেবল বাজতেই থাকে। বাজতে থাকে অনন্তকালের সেই অতৃপ্ত বাসনার অশ্রুভারাতুর সুর 

কত দিন দেখিনি তােমায়
তবু মনে পড়ে তব মুখখানি।

কারও আবার মনে পড়ে শৈশবে ফেলে আসা সেইসব সােনালি দিন । মনে পড়ে দিদি-ঠাম্মার কোলে বসে শােনা চাদ বুড়ির চরকা। কাটার গল্প। 

এমন বহুমিশ্রিত আবেগ-অনুভূতিতে ভরে ওঠে মানুষের মন। তাই বলা যায়, চাদনি রাত অনুভূতিপ্রবণ স্মৃতিকাতর মানুষের মনে ব্যাপক ও গভীর প্রভাব বিস্তার করে। মানুষ আকুলতার আতিশয্যে বাস্তবতার গণ্ডি পেরিয়ে পরাবাস্তব কল্পনার আনন্দলােকে হারিয়ে যায় ।

চাঁদনি রাত গানের রাত : চাঁদনি রাতের উপভােগ্য দৃশ্য বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে একাকার হয়ে আছে। তাই আমাদের গানেকবিতায়-গল্পে চাঁদের প্রসঙ্গ আসে বারবার। এমনি রাতে কবিরা কবিতার উপকরণ খুঁজে পান । গানের সুর ফুটিয়ে তােলার জন্য এমন রাত বড়াে পয়মন্ত । চাঁদনি রাতে সবার প্রাণেই গানের সুর বেজে ওঠে । তাই প্রেমের কবি কাজী নজরুল ইসলাম চাঁদনি রাত নিয়ে গেয়েছেন 

প্রিয় এমন রাত যেন যায় না বৃথায়,

মালা-চন্দন ফুলে ওই বাসর সাজাই।

চাঁদনি রাতকে যুগে যুগে বহু কবি বিভিন্নভাবে বরণ করেছেন । জ্যোৎস্নার সৌন্দর্য কত কবির মনে ভাবােপলব্ধির বন্যা বইয়েছে, তাঁরা সেই ভাবের ফসল রেখে গেছেন গানে-কবিতায় । জ্যোৎস্নার মাতাল নেশায় মনের মধ্যে ছন্দ-সুর খেলা করে। সে খেলায় মত্ত হয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গেয়েছেন 

আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে

বসন্তের এই মাতাল সমীরণে।

একটি চাঁদনি রাতের অভিজ্ঞতা : পৌষের কুয়াশাচ্ছন্ন চন্দ্রালােকিত গভীর রাত্রি । সমগ্র বিশ্ব দ্রিামগ্ন । কোথাও কোনাে সাড়া নেই। দূর-দিগ্বলয় পানে তাকালে মনে হয় রুপালি জ্যোৎস্নায় কুয়াশার সাদা বসন পরে বৈধব্যবেশী কোনাে নারী দাঁড়িয়ে আছে! রাত্রির নিস্তব্ধতা চৌচির করে দূরে দু’একটি কুকুরের চিৎকার । পূর্ণ চাদের নিথর রাত্রির বুকে আমি একা জেগে । একেবারে একা নিঃসঙ্গ অনিকেত । রজতধারায় ঝরনার মতাে চাঁদের রূপ পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে পড়ছে। আমার চেতনাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে । আমি ক্রমাগত গভীর উপলব্ধির অতলে ডুবে যাচ্ছি । অনন্তকাল ধরে চাদ তার আলাে ছড়াচ্ছে। শুধু একটি রাত আমি তার চলমান প্রক্রিয়ার সাথি হয়ে আছি । মহাকালের অসীম কালচক্রে এই রাত, এই দুর্লভ সুন্দর মুহূর্ত আর তাে ফিরে আসবে না । আসবে অন্য চাদনি রাত কিন্তু এই রাত তাে চিরতরেই বিগত হবে । এসব ভেবে আমার ভিতরে একটি অনির্বচনীয় শিহরণ জেগে উঠছে। কী জানি এমন ভাব। থেকেই কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায় লিখেছিলেন কি না —

এমন চাদের আলাে।
মরি যদি সেও ভালাে
সে মরণ স্বর্গ সমান । 

সন্ধ্যায় যে চাঁদ ছিল পূর্ব গগনে, এখন সে পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে। অথচ আমার ভিতরে কত সুধা, কত বেদনাই না সে জাগিয়ে। তুলছে । আনন্দ-বেদনায় বিগত দিনের স্মৃতি রােমন্থন করে আমার ভিতরে একটা গুমড়ে মরা অবরুদ্ধ আবেগ কান্না হয়ে বেরােতে চাচেছ । আমার চারপাশে একটা নিবিড় শান্তি বিরাজ করছে। পাশের বেত বনে ডাহুকি বিরহী হৃদয়ের আকুল কান্নায় ব্যথার রাগিণী জাগিয়ে তলচ। প্রকতির মনোেহর রূপ-মাধুর্যের লাস্যময়-হাস্যময় স্নিগ্ধ সৌন্দর্যের গভীরে আমার তনুমন সমর্পিত হয়ে আছে। চাদনি। রাতের অন্ধ ভরে বিরহী পাখির করুণ সুর আমার মগ্ন চৈতন্যে সহসা বেদনার ছোঁয়া দিয়ে গেল । পবিত্র এক পরিবেশ শুভ্রতার চাদর গায়ে দিয়ে সজাগ জীবনবােধে আমার হৃদয়ের গভীরে নাড়া দিয়ে গেল। আমার কোনাে মালিন্য নেই; নেই কোনাে সাংসারিক দুশ্চিন্তা। জাগ্রত এই রাত আমাকে অনাবিল অনিন্দ্য ভুবনের মহিমাদীপ্ত জ্যোৎস্না-স্নিগ্ধ প্রকৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। 

উপসংহার : চাঁদনি রাতের স্বতন্ত্র একটি রূপ-বৈচিত্র্য আছে। এমন রাতের সৌন্দর্য উপভােগ ও অবলােকন করা সকলের পক্ষে সম্ভব নয়। এ সৌন্দর্য-সুধা পান করতে চায় ভাবুক মন। চাঁদের আলাে শুধু পৃথিবীকেই আলােকিত করে না, ক্ষণিকের তরে হলেও আলােকিত করে সৌন্দর্যপিপাসু মানুষের মনকে। বিশেষ করে ভাবুক মনে জ্যোৎস্না বপন করে সৌরভ স্নিগ্ধতার বীজ। চাঁদনি রাত আমাদের ভিতরে বহুমাত্রিক উপলব্ধিকে জাগিয়ে তােলে। সে উপলব্ধি যেমন ব্যাপক তেমনি বিচিত্র; যেমন গভীর তেমনি অন্তর্মুখী সূক্ষ্মানুভব। বিষন্নতার বাহনে চড়ে বিমল সুন্দর যেমন মূর্তরূপ ধারণ করে তেমনি সৃষ্টিশীল সত্তায় স্বভাব বিরহ অশ্রান্ত অনুরণী হয় । নির্মোহ আনন্দের আতিশয্যে মানুষ মৃত্যুকে বন্ধুর মতাে হাসি মুখে জড়িয়ে ধরে। কেননা, আত্মার আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হলে, মৃত্যুতেও মহাতৃপ্তি বিরাজ করে। আর তা যদি হয় স্বর্গীয় সুন্দর কোনাে মুগ্ধ পরিবেশ, তাহলে তাে কথাই নেই। তাই কবি জন কিটস বলেছেন —

তােমার পদে এ মিনতি করি দয়াময়,
আমার মরণ যেন চাঁদনি-রাতে হয়।

Rate this post