বাংলা কবিতা : পরমজ্ঞান ও সাধন তত্ত্ব

মুহাম্মদ আবদুল বাতেন : বাংলা কবিতা নানা পর্ব ও ইতিহাসের অনেক গভীর রহস্যময় উপত্যকা পেরিয়ে এসেছে। এভাবে আধুনিকতার পর্ব পেরিয়ে এখন উত্তরাধুনিকতার ধূসর জগতে হাঁটছে। বাংলা কবিতার প্রাচীন ও মধ্যযুগ যে কত সমৃদ্ধ ছিল, কত বৈভবে সমুজ্জ্বল ছিল, এখন সে বিষয় কেউ আলোচনা তেমন একটা করেন না। কারণ মানুষ তার বর্তমান কর্ম নিয়ে ব্যস্ত এবং অনেক আত্মতুষ্টু। এই আত্মকেন্দ্রিকতার কারণে ক্রমাগত আমরা শুধু ইতিহাসই নয়, আমাদের নৃতাত্ত্বিক পটভূমি ও দার্শনিক ভাব সম্পদ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছি। বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে বাংলা ভাষা-সাহিত্যের নির্ধারিত পাঠ্য সীমার বাইরে, বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন ও মধ্যযুগ নিয়ে তখনকার সাহিত্য প্রতিভার আলোচনা নেই। বর্তমান সময়ে সংবাদপত্র ও স্যাটেলাইট মিডিয়ার যুগে স্থূল বিনোদন বাণিজ্য নিয়ে মিডিয়ার মাতামাতি হয়, কিন্তু আমাদের অতীত গর্ব, উত্তরাধিকার ও পূর্ব পুরুষদের গৌরব গাঁথা ও নৃতাত্ত্বিক পরিচয় তুলে ধরে অনুষ্ঠান হয় না। আসলে কি আমরা আমাদের নিজেদেরও যথার্থ মূল্যায়ন করতে পারছি?

আমরা যখন উত্তরাধুনিক সাহিত্য, কবিতা ও নন্দনতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করি; তখন অনেকটা অবচেতনে উপনিবেশিক প্ররোচণার শিকার হই। অর্থাৎ অস্তিত্বের আবিষ্কার ও মূল্যায়ন নিজের মতো করতে পারছি না। এখন এদিকে আমরা বাংলা কবিতার ত্রিশের দশকের বিংশ শতকের) প্রধান কবিদের শেকড়হীন ঘোষণা করছি, অন্যদিকে যে উত্তরাধুনিকতাকে গ্রহণ করছি-তাও পশ্চিমাতাত্ত্বিকদের ব্যাখ্যাকে ভিত্তি ধরে, এ কারণে তত্ত্বীয়ভাবে আমরা আরেকটি নতুন উপনিবেশবাদী তত্ত্বের অনুগামী হচ্ছি কী না তা মনে রাখা প্রয়োজন। পোস্ট মডার্ন বা উত্তরাধুনিকতার যে দার্শনিক বাণী তার মূল বার্তা বহু আগেই প্রাচ্যে বিকশিত হয়েছে, আকর্ষণীয়ভাবে তা পাশ্চাত্যের বাজার হয়ে নতুন পণ্য হয়েছে। যদিও উত্তরাধুনিকতা যে অকৃত্রিম নিজস্বতার বৈশিষ্ট্য উপস্থাপন করে, স্থান-কাল, মূল্যবোধ ও মানব আস্তার স্বতঃস্ফূর্ত জাগরণকে মহিমান্বিত মনে করে, তার দার্শনিক ও নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য প্রাচ্যের সাহিত্য, কবিতা ও ভাব সম্পদে নিহিত রয়েছে। উত্তরাধুনিক কবিতা প্রাচ্যের প্রকৃতি, আত্মা ও জীবন সাধনার আনন্দ ও যুক্তির উদ্বোধনে সমুজ্জ্বল হয়ে আছে। ইউরোপের মানুষ তার বিশ্বাসের কাছে প্রতারিত হয়েছে, তাই তাদের আত্মার ঐশ্বর্য সংকোচিত হয়েছে, আর প্রাচ্য নিরন্তর ত্যাগের মহিমায় সর্বমানবিক বাণীকে ধারণ করে আছে। সে কারণেই বাংলা কবিতায় যখন উত্তরাধুনিকতার নতুন সংশ্লেষণ ঘটছে, তখন বাংলা কবিতার অতীত ধারাবাহিকতাকে একটি বিবেচনায় মূল্যায়ন করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। বাংলা কবিতার ইতিহাসে প্রাচীন ও মধ্যযুগের কবিরা ছিলেন জীবন সাধনার প্রাজ্ঞপুরুষ; কিন্তু আজকের সাহিত্য নিরন্তর সাধনার স্থানে টেনে নিয়েছে, মিডিয়ার বাহন, যেখানে কেবল আত্মপ্রচারণাই সরব। সাহিত্য মহাজীবন থেকে ক্লীবতায়। আজকের উত্তরাধুনিক কবিতা যেদিন মহাজীবনকে আপন অস্তিত্বের মধ্য দিয়ে পরম মহাবিশ্ববোধে উত্তীর্ণ করবে তখনই তা স্বার্থক হয়ে উঠবে।

বাংলা ভাষার প্রথম উত্তরাধুনিক দর্শনের কবি কে? যদি বাংলা সাহিত্যের মহৎ কবিদের সৃষ্টিকে সামনে নিয়ে আসা হয়, তাহলে বাংলা ভাষার প্রাচীন ও মধ্যযুগের কবিদের নাম বাদ দেয়া যায় না। বিশেষ করে উত্তরাধুনিক কবিতার যে দেশজ ভাব সম্পদের কথা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়। অপরদিকে আধুনিক যুগের কবিতার লক্ষ্য ছিল পাশ্চাত্য অনুসরণ। যদিও চেতনার মাঝে প্রতিফলন ছিল নিজস্বতার। যে লোকজ্ঞান ও মানবিক মহত্বের মূল সূত্রের কথা বলা হয়, তা প্রাচীন ও মধ্যযুগের কবিতায়ই সবচেয়ে বেশি ঐশ্বর্যবান হয়ে আছে। আধুনিক কবিতার যে সূচনা ঘটে মাইকেল মধুসূদন দত্তের হাতে; তারও কাব্য বিষয় উত্তরাধুনিক কবিতার বিষয়ের বাইরে নয় তিনিও ফিরে এসেছেন স্বভূমিতে।

বাংলা ভাষার প্রথম আধুনিক কবি কে? প্রথমত ঃ বাংলা ভাষার মূল কাব্য প্রবণতার সব কবিই আজকের ভাষায় উত্তরাধুনিক। বাংলা কবিতার প্রাচীন যুগ সৃষ্টি করেছেন যে সিদ্ধাচার্য কবিগণ তাদের পদে তখনকার সমাজ ইতিহাসই নয়, জীবন সাধনা ও মানব মুক্তির নানা প্রসঙ্গ রূপকের মাধ্যমে উত্থাপিত হয়েছে। চর্যাপদের আদি কবি শবরপাদের একটি বিখ্যাত পদ এখানে তুলে ধরছি।

উষ্ণা উষ্ণা পাবত তহিঁ বসই সবরী বালী।

মোরাঙ্গ পীচ্ছ পরিহাণ সবরী গীবত গুঞ্জরী মালী\

উমত সবরো পাগল সবরো মা কর গুলী গুহারী।

তোহেরী ণিঅ ঘরিণী নামে সহজ সুন্দরী\

নানা তরুবর মৌলিল রে লাগেলী ডালী।

একেলী সবরী এ বণ হিন্ডই কর্মকুন্ডল বজ্রধারী\

তি অ ধাউ খাট পড়িলা সবরো মহাসুহে সেজি ছাইলী।

সবরো ভূঅঙ্গণইরামণি দারী পেম্ম। রাতি পোহাইলী।

হিঅ তাঁবোলা মহাসূহে কাপুর খাই।

সুণ নৈরামণি কণ্ঠে লইআ মহাসূহে রাতি পোহাই\

গুরুআক ধণুআ বিন্ধ ণি অ মণে বাণে।

একে সর সন্ধানে বিন্ধহ বিন্ধহ পরম ণিবাণে\

উমত সবরো গরুআ রোসে।

গিরিবর সিহর সন্ধি পইসন্তে সবরো লোড়িব কইসে\

চর্যাপদের আদিকবি শবর পা’র (৬৮০-৭৬০ খৃীঃ) এটি একটি সাধন সঙ্গীত। চর্যায় সে কালের সমাজ বাস্তবতা ফুটে উঠলেও এর অন্তর্নিহিত লক্ষ্য হচ্ছে পরমসত্যে পৌঁছানো। এক্ষেত্রে বৌদ্ধ ধর্মের মহাযান সাধন পদ্ধতি বর্ণনা করা হয়েছে। সমালোচকদের অনেকেই চর্যাগানের সমাজ বাস্তবতাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন কিন্তু চর্যাগান উচ্চাঙ্গের সাহিত্য বিবেচিত হতো না যদি না তাদের সাধন তত্ত্বের জ্ঞান থাকতো। জ্ঞান ও চিন্তায় তা গভীর মনোরাজ্যে বিচরণ করেছেন। চর্যায় সামাজিক অর্থের আড়ালে ধর্মতত্ত্ব ও সাধন-তত্ত্বের উচ্চস্তরে তারা আরোহন করেছেন। চর্যার আলোচকরা সবাই বিংশ শতকের চিন্তা ও জ্ঞানের  মানুষ সে কারণে চর্যার ধর্মমতের চেয়ে সমাজ ও জীবন যন্ত্রণাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। চর্যাকারগণ যদি উচ্চাঙ্গের সাধন শুরু না হতেন তাহলে তাদের গানে সন্ধ্যা ভাষার আবরণে দ্বৈত অর্থ পাওয়া যেত না। চর্যাকারদের জ্ঞান ও মনীষার মূল্যায়ন করলেই তাদের সৃষ্টির তাৎপর্য বোঝা যাবে। চর্যাপদের আলোচকরা চর্যাগানের মূল্যায়ন এমনভাবে করেছেন- যাতে সেই তত্ত্বজ্ঞানী কবিদের ধর্মতাত্ত্বিক সাধনা সামনে না আসে। আলোচকরা তাদের নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যক্তিগত মত ও পছন্দের বিচারেই চর্যার মূল্যায়ন করেছেন। এ কারণে চর্যার মূলভাব পাঠকদের কাছে অনেকটাই আড়ালে চলে গেছে। বাংলা কবিতার এই মৌলিক শক্তি ও পরম জ্ঞাপনের ধারা পরবর্তী বাংলা কবিতার আলোচনায় গুরুত্ব না পাওয়ায় ক্রমাগত অনুল্লেখযোগ্য হয়ে উঠেছে। বাংলা কবিতার মূল ভাবচেতনা থেকে পরবর্তী বাংলা কবিতার মূল্যায়ন ক্রমাগত একপেশে হয়ে পড়েছে এবং এভাবে বাংলা কবিতার মূল জ্ঞান চেতনা থেকে পরবর্তীকালের কবিরা বিচ্যুত হয়েছেন। শেষ পর্যন্ত আধুনিককালে বাংলা কবিতার চর্চাও আলোচনার জ্ঞানগত উৎস এই মৌলিক ভাবমন্ডল থেকে বিচ্যুৎ হয়ে পশ্চিমা অনুকরণ ও পশ্চিমাভাব জগতে প্রবিষ্ট হয়। কবিরা পরবর্তীকালে নিজেদের রচনায় তা আধুনিকতা ও নিজেদেরকে আধুনিক কবি হিসাবে প্রতিষ্ঠার জন্য নিজস্বতাকে উপেক্ষা করতে শুরু করেন। সাহিত্যে এই আত্মবিস্মৃতি থেকে বাংলা কবিতা উদ্ধারের প্রথম চেষ্টা শুরু হয়, গত শতাব্দীর শেষ দশকে। যখন তরুণ কবি প্রজন্ম পশ্চিমকে প্রশ্নবিদ্ধ করলেন এবং কবিতাকে কেবল বর্ণনা সৌন্দর্যে আবরিত না করে; নিজস্বতা ও লৌকিকতাকে প্রাধান্য দিয়ে জীবন-অভিজ্ঞতাকে দার্শনিক তাৎপর্যে রূপায়নের প্রচেষ্টায় রত হন। চর্যাকারদের মূল লক্ষ্য ছিল সাধন সঙ্গীত রচনা এবং তারা ছিলেন সে সময়ের জ্ঞান তপস। শুধু সামাজিক বাস্তবতার জন্যই তারা গান রচনা করেননি, তাদের লক্ষ্য ছিল মানুষের মুক্তি; এ কারণে গুরু সাধনের মাধ্যমে তারা মহাসুখ রূপ নির্বাণ লাভের উপায় ব্যাখ্যা করেছেন। অন্যদিকে চর্যাকারদের সবার কবি দৃষ্টি ও বৌদ্ধতান্ত্রিক জ্ঞান সমান নয়: ফলে কোন চর্যার সাহিত্য মূল্য সামজচিত্র নির্ভর; আবার কোন চর্যার সাহিত্য মূল্য একই সঙ্গে সমাজচিত্র নির্ভর ও সাধন তত্ত্ব নির্ভর। শবর পা রচিত উল্লেখিত চর্যার শব্দগত অর্থ ও শব্দের ভিন্নতর অর্থ থাকায় সমাজের চিত্র যেমন দেখা যায়, তেমন সাধন তন্ত্রেরও বিশেষ উল্লেখ দেখা যায়।

শবরপা’র চর্যাটির অন্তর্নিহিত ভাব হচ্ছে: ‘এই দেহ সুমেরু পর্বত, মস্তিষ্ক তার শিখর- সেখানে বাস করে শবরী, শবরের সহজ সুন্দরী গৃহিণী, নৈরাত্মাদেবী। নৈরাত্মা ভাব বিকল্প রূপ ময়ূর পুচ্ছ এবং গুহ্যমন্ত্ররূপ গুঞ্জার মালা ধারণ করে আছে। বিষয়ানন্দে মত্ত শবর যেন তাকে চিনতে কোন প্রকার ভুল না করে। একমাত্র তার সঙ্গেই শবরের মিলন হওয়া উচিত।

দেহ সুমেরুতে নানা অবিদ্যারূপ তরু বিষয়ানন্দে মুকুলিত হয়েছে, তার পঞ্চস্কন্দাত্মক শাখা-প্রশাখা আকাশ পর্যন্ত বিস্তৃত। কিন্তু এরই মধ্যে জ্ঞান-মুদ্রাদিরূপ কুন্ডল কানে পরে নৈরাত্মা খবরী একাকিনী ঘুরে বেড়ায়।

এক শবরীর আহবানে শবর কায়বাকচিত্তরূপ ত্রিধাতুর খাট পেতে তার ওপর মহামুখরূপ শয্যা বিছাল এবং সম্ভোগচক্রে মিলিত হ’ল শবরীর সঙ্গে। সে হৃদয়রূপ তাম্বুল মহাসুখরূপ কর্পুরের সঙ্গে খায় অর্থাৎ চিত্তকে অচিত্ততায় লীন করে শবরী-নৈরাত্মাকে কণ্ঠে ধারণ করে মহামুখে রজনী-যাপন করে। গুরুবাক্যকে ধনু এবং নিজ মনকে বাণ করে নির্বাণকে বিদ্ধ করা হয়েছে। অর্থাৎ গুরুবাক্য অনুসারে চিত্তের সাধন দ্বারা নির্বাণ লাভ সম্ভব হয়েছে।

সহজানন্দ পানে প্রমত্ত শবর মস্তকে অবস্থিত মহামুখ চক্রে এমনভবে প্রবিষ্ট হয়েছে যে, তাকে তার বিষয় ক্লেশদুষ্ট জীবনে খুঁজে পাওয়া যাবে না। চর্যাগানের যে দ্বৈত অর্থ রয়েছে, তা সকলেই স্বীকার করেন। চর্যাকারগণ এই দ্বৈত অর্থের কোন অর্থটি মুখ্য হিসাবে চর্যাগান রচনা করেন, সে বিষয়টিকে প্রয়াশই এড়িয়ে যাওয়া হয়, যদিও চর্যাকারদের চর্যাগান রচনার মূল প্রেরণা ছিল তাদের পরমজ্ঞান চেতনা। চর্যাগানের সেই জ্ঞানতত্ত্বই হচ্ছে বাংলা কবিতার ক্লাসিক প্রবণতা। চর্যাগানের পরবর্তীতে মধ্যযুগের যে সাহিত্য তারও মূল প্রবণতার রয়েছে ধর্মবোধ, পরমজ্ঞানের চর্চা। এক্ষেত্রে যিনি যে ধর্মবোধকে লালন করতেন, তিনি সেই ধর্মবোধের গভীর ব্যঞ্জনা দিতেন, তার ভাব ও পরমজ্ঞান চেতনা অনুরূপই ছিল। এক্ষেত্রে একটি ধর্মবোধ ও জ্ঞান চেতনার কবি অন্য ধর্মবোধ, জ্ঞান চেতনা কিংবা জীবন পথের প্রতি অশ্রদ্ধা ছিল না। মূলত ধর্মচেতনার পথে যে সাধন মার্গেই তারা আরোহণ করেছেন তার মূল বাণী ও ভিত্তি ছিল প্রেম। প্রেমের সেই পরমবোধ মধ্য ও প্রাচীন যুগের কবি ও তাদের রচনায় একটি অহিংস সহ-অবস্থান তৈরি করেছে। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ এই বাণীর তাৎপর্য এখানেই যে, মানুষ ধর্মাধর্ম নির্বিশেষে সকলকেই প্রেমের পরম আনন্দলোকে একই অরণ্যের নানা বৈচিত্র্যের সহাবস্থান তৈরি করেছে। প্রেম ও জ্ঞানের পরিমাপক অন্য কোনো তাৎপর্যে এ বিষয় ব্যাখ্যা সম্ভব নয়। প্রাচ্য তত্ত্বকে একটি শব্দে ব্যাখ্যা করতে হয়, তাহলে সেই শব্দটি হচ্ছে প্রেম। দক্ষিণ এশিয়ার (বিভাগ পূর্ব ভারত) তান্ত্রিক ও যোগ সাধনা ছাড়াও নানা আচার ও প্রকৃতি পূজারীরাও  নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে গত এক হাজার বছরে একটি বৃহৎ আন্তধর্মতাত্ত্বিক সংশ্লেষে এসে এ অঞ্চলে একটি ভাবজগৎ তৈরি করেছে। যদিও কোন কোন ধর্ম সম্প্রদায় ও প্রকৃতি পূজারীদের মধ্যে সফলতা অর্জনের জন্য নরবলি, পশু বলি এমনটি হিন্দু ধর্মের সতীদাহের মতো নিষ্ঠুরতা ছিল। কিন্তু খৃস্টীয় সপ্তম শতক থেকে এ অঞ্চলের বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে রাজ্য শাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে যে যোগাযোগ সৃষ্টি হয়েছে, তাতে এক বিশ্বাসের মানুষের সঙ্গে অন্য ধর্ম বিশ্বাসের মানুষের আন্তসম্পর্ক সৃষ্টি হয়। এ কারণেই উপমহাদেশে বিশেষ করে অনার্য বাংলা অঞ্চলে নানা রকম ভাষা ধারার সৃষ্টি হয়। এই ভাষা ধারার কেন্দ্রে রয়েছে ধর্মীয় জ্ঞানতত্ত্বে পরম ভাবনা। সুফী, বৈষ্ণব ও বাউল তত্ত্ব ও ধারার সৃস্টি হয় এভাবেই। শ্রী চৈতন্য দেবের সময় এসব তত্ত্বের সংশ্রব ও সংশ্লেষ আরো গভীর হয়ে ওঠে। এই ধর্মতাত্ত্বিক জীবন ও দার্শনিক প্রেক্ষাপট যে ভাবমন্ডল তৈরি করেছে তার অখন্ড পরম ক্ষেত্রটি হচ্ছে প্রেম। প্রাচ্যের সারবস্তু যদি হয়, প্রেম সেই প্রেমের বহুমাত্রিক সংশ্লেষের জ্ঞানমার্গ রচিত হয়েছে বাংলা অঞ্চলের কবি ও সাধকের রচনা ও জীবন সাধনার। চর্যাকারগণের কবিতা সেই সাধনতত্ত্ব ও সৃষ্টিশীলতার পথ উন্মুক্ত করেছে। প্রাচ্যের প্রধান আধ্যাত্মিক শক্তি ইসলামের একত্ববাদ। যা ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সব কিছুকেই একই প্রেম ও ভালবাসার পরম যুক্তির পথ নির্দেশ করে। এক্ষেত্রে বৌদ্ধ ধর্ম ও মানুষের জীবন চক্র ও কর্মকেন্দ্রিক সাধনার মাধ্যমে যে পরম নির্বাণ তত্ত্বের বাণী উত্থাপন করেছে, তা বাংলার এ অঞ্চলে একটি ভাবগত সমন্বয় তৈরি করেছে। বৌদ্ধ ধর্মের সৃষ্টি যেহেতু এ অঞ্চলেই ফলে এর একটি বড় প্রভাব হিন্দু ধর্মকে সংস্কারের দিকে ধাবিত করে। শ্রী চৈতন্য দেবের এবং বৈষ্ণব সম্প্রদায় সেই সংস্কারের সৃষ্টি। এই ধর্ম, জ্ঞান ও জীবন ও ভাবগত সংশ্লেষ ও সমন্বয় বাংলা কবিতাকে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করেছে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে এই দার্শনিক, ধর্মগত ও ভাবগত জগত তৈরি হয়নি। বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন কিংবা বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাগীতি রচনাকালে ভারতের অন্য কোন অঞ্চলে এত পন্ডিত, সাধকের মাধ্যমে পরম কোন জ্ঞানতত্ত্ব ভিত্তিক সাহিত্য রচিত হয়নি। যদি সংস্কৃতি সাহিত্যের কথা বলা হয়, তাহলে সেই সাহিত্য চর্যাকারগণের মতো সাধারণ মানুষের জীবন সাধনা ও সাধন জ্ঞানের সমতুল্য ছিল না। সংস্কৃত সাহিত্য নিয়ে এক্ষেত্রে অনেক আলোচনা করা যেতে পারে, কিন্তু সেদিকে না গিয়েই এই সত্যটি উল্লেখ করতে চাই যে, সংস্কৃত সাহিত্য সাধারণ মানুষের সাহিত্য নয়, এই সাহিত্য ছিল উচ্চ স্তরের ব্রাহ্মণ সমাজের এবং সংস্কৃত সাহিত্য উচ্চ শ্রেণীর ভোগ ও কামনা বাসনার ইচ্ছা পূরণের একটি আদিরসাত্মক পারা। সংস্কৃতি-সাহিত্যে উচ্চাঙ্গের কাব্য ও নাটক রচিত হয়েছে, কিন্তু সেই সাহিত্য মানুষের যুক্তি ও পরমপ্রেম ও আনন্দভাবে মহিমান্বিত ছিল না। চর্যাগান শুরুতেই মানুষকে যে আত্মসচেতনতা ও সাধন পথের ইঙ্গিত দিয়েছে সেটা একটি বিরল ঘটনা। সাধারণত বিভিন্ন ভাষার সাহিত্যের সূচনা হয় এক ধরনের কাহিনী কেন্দ্রিক কাব্য দিয়ে এবং রাজকাহিনী, রূপকথা কিংবা পুরাণ। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের সূচনা হয়েছে সাধন সঙ্গীত দিয়ে। এ সঙ্গীতের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে তত্ত্বজ্ঞানের। যারা এ সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন, তারা সবাই বৌদ্ধ তান্ত্রিক সাধক। তাদের পান্ডিত্য এবং মেধা তখনকার সময়ের চেয়েও বেশি এগিয়ে ছিল, এ কারণেই এত সংক্ষিপ্ত একটি গানে সন্ধ্যা ভাষার একই বর্ণনায় একাধিক অর্থ তৈরি করেছেন বৌদ্ধ সাধক কবিগণ। সাধারণত চর্যার কবিগণ যদি উচ্চ মার্গের পন্ডিত, ধর্মসাধক ও সাধারণ মানুষের দুঃখ আনন্দের অংশীদার না হতেন তাহলে চার্যার কবিরা আদিরসাত্মক কবিতাই হয়তো লিখতেন। চর্যার কবিতা তাদের মূল সাধনা পথের বর্ণনা দিতে গিয়ে কোথাও কোথাও তখনকার সমাজচিত্রের অবলম্বন করেছেন, এতে তখনকার সমাজের আদিরসাত্মক চিত্রও কোথাও কোথাও ফুটে ওঠেছে। কিন্তু সেই রচনার মূল লক্ষ্য পথের বর্ণনা। চার্যাকাররা জানতেন, সাধারণ মানুষের জীবন ও বাস্তবতার মাধ্যমেই ধর্মতাত্ত্বিক সিদ্ধির পথ তুলে ধরতে হবে। যাতে সাধারণ মানুষের কাছে সাধনার পথ সহজ বোধ্য হয়। চর্যাগানের রচয়িতা কবিদের ধর্মবিশ্বাস ছিল, জীবনের পরম সিদ্ধি অর্জন তাদের লক্ষ্য ছিল। অন্য কোনো ধর্মমতের প্রতি তাদের হিংসা কিংবা বিদ্বেষ ছিল এমন কোনো নজির কিংবা বক্তব্য পাওয়া যায়নি। কিন্তু তারা ধর্মনিরপেক্ষ একথা বলারও সুযোগ নেই। চর্যা কবিরা নির্দিষ্ট কোনো ধর্মগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে চর্যাগান লিখেননি। অর্থাৎ চর্যাকারগণ কোথাও বলেননি, বৌদ্ধ তাত্ত্বিক মহাযান কিংবা হীনযান পক্মখীদের উদ্দেশ্যেই এ গান লেখা হয়েছে। বৌদ্ধ ধর্ম হিন্দু ব্রাহ্মণ শাসকের মাধ্যমে এ অঞ্চল থেকে নির্বাসিত হয়েছে। চর্যার কোন কোন বর্ণনায় নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের উদ্দেশ্য ছিল নির্বাণ লাভের উপায় বর্ণনা করা। যখন নির্বাণ লাভ হয়, তখন তিনি ধর্ম অধর্ম-জ্ঞানের ঊর্ধ্বে ওঠে যান। যিনি নির্বাণ লাভ করবেন তিনিই প্রকৃত প্রেম অর্জন করবেন এই প্রেম প্রকৃতিময়। এই দর্শন বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের চেয়ে এ উপমহাদেশে বেশি ভিত্তি নির্মাণ করেছেন মধ্যযুগের সুফী কবিরা। কারণ ভারও উপমহাদেশে সুফী কবিরাই আধ্যাত্মিকতা ও কবিত্বের প্রতিনিধিত্ব একই সঙ্গে করেছে এবং এ কারণেই পীর আউলিয়াগণ এ অঞ্চলে (ভারত উপমহাদেশ) সাধারণ জনগণের মুক্তিদূত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। দিল্লী থেকে সুফী কবিদের সে বার্তা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে সাধারণ মানুষের ধর্ম ও জীবন চর্চার সরাসরি প্রভাব বিস্তার করেছিল, আমীর খসরুর মতো অনেক সুফী সাধক সেই আধ্যাত্মবাণী গোটা উপমহাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে দিয়েছেন। বাংলার এ অঞ্চলে সুফী সাধক ও কবিদের বিশাল প্রভাব সবারই জানা রয়েছে। সুফী, বৈষ্ণব ও বাউল কবি ও তাদের ভাবতত্ত্ব এ বিষয় পর্যায়ক্রমিক আলোচনার অপরিহার্যতা রয়েছে। বাংলা সাহিত্যে সুফী, বৈষ্ণব, বাউল সাহিত্য সৃষ্টি চর্যাপদের পরবর্তীকালের, যদিও ভারত উপমহাদেশে সুফীবাদের প্রভাব সৃষ্টি হয়েছে আরো আগে থেকে। ভারতবর্ষে ইসলাম ধর্মের প্রসারের থেকে সুফী দর্শন বিস্তার লাভ করে। অন্যদিকে প্রাচীন ভারতে ভাষা, ধর্ম ও জীবনাচারে পারস্য প্রভাব ছিল খৃষ্টপূর্বকাল থেকেই।

চর্যাগীতি শুধুই কবিদের উদ্দেশ্যহীন আবেগ কিংবা কামনা-বাসনা অথবা সমাজচিত্র নয়; সে কথা স্পষ্ট করার জন্য পূর্বেকার আলোচনার অবতারণা করেছি। আরো যে বিষয়টি তুলে ধরেছি তা হলো : চর্যাগীতিকা হচ্ছে, সেই কবিদের আধ্যাত্ম সাধনার বাণী। চর্যার কবিরা নিজেদের ধর্মমতের বাইরে অন্য ধর্মমতকে অশ্রদ্ধা কিংবা আক্রমণও করেননি। আবার এই কবিগণ বর্তমানের তথাকথিত স্যেকুলার কবি বুদ্ধিজীবী ছিলেন না। চর্যাপদের কবিরা রাজসভার কিংবা কোনো রাজনৈতিক পক্ষের কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা আদায়ে তৎপরও ছিলেন না। আবার এই একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে বাংলাভাষার তরুণ কবিদের লোকজ সংস্কৃতি ও নিজস্ব মূল্যবোধের অন্বেষণে যে উত্তরাধুনিক সাহিত্যের কথা বলা হয, চর্যাপদকে সেই বৈশিষ্ট্য থেকে বাদ দিতে পারি না। অর্থাৎ চর্যাপদে আমাদের সাহিত্যের সকল উত্তরাধিকারকেই খুঁজে পাওয়া যাবে। চর্যাপদের কবিদের আধ্যাত্মিক সাধনাকে কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যাবে না। মুহম্মদ আবদুল হাই ও আনোয়ার পাশা চর্যাগীতিকার ভূমিকায় লিখেছেন চর্যাগীতিগুলো মূলত বৌদ্ধ সহজিয়াদের সাধন পদ্ধতি মূলক গান। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে সন্ধ্যা ভাষার রূপকের মাধ্যমে সাধকদের গূঢ় ধর্মসাধনার কথা প্রচার করা। কোটি জনের একজন এর সমার্থ অনুধাবন করতে পারবে এমন বিশ্বাস ব্যক্ত করেছেন চর্যা পদকর্তাগণ। কুক্কুরিপাদের একটি চর্যা এখানে বর্তমান প্রসঙ্গে উল্লেখ করছি।

দুলি দুহি পীঢ়া ধরণ ণ জানাই।

রুখের তেস্তলি কুম্ভীরে খাই।।

আঙ্গল ঘনপন সুন ভো বি আতী!

কানেট চোরে নিল অধরাতী\

সসুরা নিদ গেল বহুড়ী জাগই।

কানেট চোরে নিলকাগই মাগই\

দিবসহি বহুড়ী কাউহি ডর ভাই।

রাতি ভইলে কামরু জাই\

অইসনী চর্য্যা কুক্কুরী পা এঁ গাইল।

কোড়ি মাঝে একু হি অহি সমাইল\

এ চর্যায় সে কালের গৃহস্থবউ এর কথা বলা হয়েছে, সাধারণ অর্থে বোঝানো হয়েছে এ বউ’টি পরকীয়া অভ্যস্ত। চর্যাগানটির সাধারণ অর্থ হলো : ‘কচ্ছপ দোহন ক’রে ভাঁড়ে ধরা যাচ্ছে না। কুমীরে খেয়ে নিচ্ছে গাছের তেঁতুল। শোনো ওগো বাদ্যকরী, ঘরের পানে (অর্থাৎ মধ্যে অঙ্গন)। অর্ধরাত্রে ‘কানেট’ নিল চোরে। শ্বশুর ঘুমিয়ে গেল, বধূ জেগে। চোরে নিল কানেট, কি (আর) খোঁজ করবে গিয়ে, দিনের বেলা বউটি কাকের ভয়ে ভীত হয়। (কিন্তু) রাত হলেই (সে) কামরূপ যায়। এমন চর্যা গাইছেন কুক্কুরীপাদ। কোটি জনের মধ্যে (কেবল) একটি হৃদয়েই তা প্রবেশ করে। (চর্যাগীতিকা, সম্পাদনায় আনোয়ার পাশা ও মুহম্মদ আবদুল্লাহ হাই)।

চর্যাটির অন্তর্নিহিত ভাব হচ্ছে : মহাসুখ কমল দোহন করে বজ্রমণিরূপ পিঁড়িতে রাখা যাচ্ছে না অর্থাৎ ইড়াপিঙ্গলাকে বশীভূত করে দ্বৈতভাব দূর করা এবং বোধিচিত্তকে নির্বাণ মার্গে চালিত করা যাচ্ছে না, তার ফলে সহজানন্দ লাভও সম্ভব হচ্ছে না। দেহতরুর ফল তেঁতুলরূপী চিত্তকে কুমিরে খায় অর্থাৎ কুম্ভক সমাধি দ্বারাই চিত্তকে নিঃস্বভাব করা যেতে পারে। দেহরূপ ঘরের ভিতরেই অঙ্গন মহাসুখরূপ বা সহজানন্দরূপ সেই অঙ্গনে নির্বাণ লাভ করা যায়। অর্ধরাত্রি হচ্ছে প্রজ্ঞানের অভিষেক দানের সময়, ঐ সময় সহজানন্দরূপ চোর কানেটরূপী প্রকৃতি দোষ হরণ করে। শ্বাসবায়ু যখন স্থির তখন জেগে থাকে পরিশুদ্ধ প্রকৃতিরূপিণী বধূ এই বধূ দিনের বেলা অর্থাৎ ইন্দ্রিয়াদির সজাগ অবস্থায় বস্তু জগতের ভয়াবহ পরিণতি দেখে ভীত সঙ্কুচিত হয়। কিন্তু রাত্রে ইন্দ্রিয়াদি সুষুপ্ত হলে সে পরিশুদ্ধাবস্থায় নির্বিকল্পাকারে কামরূপে অর্থাৎ মহাসুখসঙ্গমে গমন করে। (ঐ)

এখানে সাধারণ অর্থ ও ভাবগত অর্থের পার্থক্য

কচ্ছপ দোহন করে        মহাসুখ কমল দোহন করে

ভাঁড়ে    বজ্রমণিরূপ পিঁড়িতে

গাছ               দেহ তরু

তেঁতুল  দেহতরুর তেঁতুলরূপী ফল

অর্ধরাত্রি প্রজ্ঞাজ্ঞানের অভিষেক দানের সময়

কানেট (মেয়েদের অলঙ্কার)      প্রকৃতি দোষ।

চোর     সহজানন্দরূপ (চোর)

শ্বশুর    (মানুষের শ্বাস বায়ু)

ঘুম               (শ্বাস বায়ুর) স্থির বা থেকে থাকা

দিনের বেলা      ইন্দ্রিয়াদিব সজাগ (জাগ্রত) অবস্থা

কাক    বস্তু জগতের ভয়াবহ পরিণতি

রাত               ইন্দ্রিয়াদি সুষুপ্ত হলে (ঘুমিয়ে গেলে)

কামরূপ (কাম, যৌনতা) মহাসুখ সঙ্গম (আনন্দলোক, নির্বাণ লাভ, কাম বা যৌনতা অর্থে নয়)

চর্যার এ গানে সাধারণ অর্থ ও ভাবগত অর্থ সম্পূর্ণ বিপরীত। চর্যাগানের এই বৈশিষ্ট্য এ গানকে সাহিত্যের মহত্ব এনে দিয়েছে। যা চর্যাগান রচনাকালে বাংলাভাষা ছাড়া উপমহাদেশের অন্য কোনো ভাষায় কিংবা সাহিত্যে খুঁজে পাওয়া যাবে না।

চর্যাগান কেবলমাত্র বাংলা সাহিত্যে আদি নিদর্শনই নয়। এ চর্যা গানগুলো শ্রেষ্ঠ সাহিত্য। পৃথিবীর যে কোন ভাষায়ই যদি এমন গভীর ব্যঞ্জনা ও তাৎপর্যে কবিতা লেখা হয়, তা সাহিত্যের শুধু নিদর্শনই নয়, তা উন্নত এক সাহিত্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হবে। এক্ষেত্রে পৃথিবীর খুব কম ভাষাই আছে, যে ভাষার সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে পদকর্তাদের মতো জ্ঞান সাধকদের হাতে। কবিতা সৃষ্টির জন্য যে প্রজ্ঞা, যে ভাবজগত থাকা প্রয়োজন তা প্রাচীনকালে ধর্মসাধকদেরই ছিল। কল্পনা শক্তি ভালো-মন্দ ও সুন্দর-অসুন্দরের যে পার্থক্য তা প্রাচীনকালে ওই কবি ও ধর্মসাধকদেরও ছিল। চর্যাগীতি ও এর রচয়িতাগণ সেই জ্ঞানের উচ্চ মার্গে আসীন ছিলেন।

চর্যাপদের পরবর্তী মধ্যযুগের সাহিত্যও শুরু হয়, ধর্মভাবের মধ্য থেকেই’ রামায়ণ-মহাভারত কিংবা আরবি ও ফারসি কাব্যের বাংলা অনুবাদের পেছনে ধর্মচেতনাই অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে কিন্তু বিংশ শতকে যখন আধুনিক গদ্য সাহিত্যের উদ্ভব; গবেষণা, সমালোচনা এবং মূল্যায়ন শুরু হয়, তখন গবেষকরা তথ্যকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। সাহিত্যের মূল্যায়নে আলোচকদের বর্তমান ব্যক্তিপ্রবণতাকে প্রক্ষেপ করেছেন। কবিদের ধর্মতাত্ত্বিক জ্ঞান-গভীরতা এবং আধ্যাত্ম চেতনা নিয়ে অগ্রবর্তী আলোচনা না করে, সমাজ চেতনা ও মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিগুলোকে ব্যাখ্যা করেছেন। যদিও প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্যের গভীর জ্ঞানতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ অপরিহার্য ছিল।

চর্যাপদের কবিরা অনেকেই বাংলা অঞ্চলের নন। তবে বাংলার আদি কবি মীননাথ (সপ্তম শতক) একথা ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ যুক্তি দিয়েই প্রমাণ করেছেন। বাংলার বাইরের কবিরাও বাংলা ভাষায় চর্যাপদ রচনা করেছেন। প্রথম বাংলা ভাষার আদিরূপ এসেছে অপভ্রংশ থেকে। অপভ্রংশ ভাষার সঙ্গে বাংলা অঞ্চলের বাইরের ভাষার অনেকটা মিল ছিল। চর্যার ভাষার সঙ্গে অসমীয়া, উড়িয়া এমনকি হিন্দী অপভ্রংশের কোথাও কোথাও মিল আছে। চর্যার ভাষাকে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ-বঙ্গ-কামরূপী ভাষা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। চর্যাপদের রচনাও কয়েক শতাব্দীব্যাপী (৬৫০-১১০০ খ্রীঃ)। কিন্তু চর্যার বিষয় হিসাবে সকল কবিই বৌদ্ধ মহাযান ও হীনযান তত্ত্ব ও তান্ত্রিকতার উপরই প্রতিষ্ঠিত। অপভ্রংশ লোকমুখের প্রচলিত ভাষা। বাংলার বাইরে ভারতে অন্যান্য এলাকায়ও অপভ্রংশে সাহিত্য রচিত হয়েছে। ভাষা তাত্ত্বিকদের মতে অপভ্রংশ ভাষায় সাহিত্য রচনা হয় আনুমানিক ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে দশম শতাব্দী পর্যন্ত। অপভ্রংশ ভাষায় জৈনদের অনেক লেখা রয়েছে, এমনকি জৈন দর্শনও অপভ্রংশ ভাষায় রচিত। নীতিমূলক অপভ্রংশ কাব্য রচনায় জৈনরা কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। উপদেশমূলক দার্শনিক গ্রন্থ রচনায় প্রভুত পান্ডিত্য দেখিয়েছেন জৈনাচার্য জোইন্দু (সপ্তম থেকে দশম শতাব্দীর মধ্যে) জৈনরা যে সমস্ত বই লিখেছেন তার ভাষা পশ্চিমী ও দক্ষিণ অপভ্রংশ। পূর্বদেশের (বাংলার) প্রাচ্য অপভ্রংশের যে সব অজৈন লেখকের লেখার নিদর্শন পাওয়া যায়, তাদের মধ্যে কাঞ্চ, সরহ প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য। (ভারত কোষ, পশ্চিমবঙ্গ)। পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত ভারত কোষ-এ বলা হয়েছে ‘কাহ্নের (৭০০ খ্রীঃ) ও সরহের (১০০০ খ্রীঃ) দোহাকোষ সাধন সংকেতমূলক অপভ্রংশ দোহা। এ মূলত উপদেশাত্মক হলেও এতে কবিত্বের নিদর্শন আছে।’

বাঙলা অপভ্রংশে যখন চর্যাপদ রচিত হয়, তখন ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে ইসলাম ধর্মের আগমন ঘটেছে। মুসলমান কবিরাই উত্তর ভারতে অপভ্রংশে সাহিত্য রচনা করেন, এ সময় অপভ্রংশ ছাড়া সংস্কৃত সাধু ভাষায় সাহিত্য রচিত হয় কিন্তু গণমানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল অপভ্রংশ ভাষার সাহিত্য। সুকুমার সেন লিখেছেন, ‘সংস্কৃতমূলক সংস্কৃতির সঙ্গে মুসলমান কবিদের পরিচয কিছু থাকলেও তা খুব গভীর ও ধারাবাহিক ছিল না, তাই বরাবরই হিন্দু কবিদের তুলনায় এদের জনসংযোগ নিবিড়তর ছিল। সুতরাং তারা অপভ্রংশ কাব্য পদ্ধতিকে উপেক্ষা করেননি। (ইসলামী বাংলা সাহিত্য সুকুমার সেন)। মুসলিম কবি আবদুর রহমান-এর কবিতা উল্লেখ করে সুকুমার সেন জানান, তিনি অপভ্রংশের কবি ছিলেন। এ সময়ের আদি হিন্দী কবি ছিলেন ‘চন্দ বলিদ্দ’ (চন্দ বরদাই)। তার ‘পহুবিয়ার-রাসউ’ বা ‘পৃথ্বিরাজ-রাসক’ লেখা হয়েছিল অপভ্রংশে। সুকুমার সেন লিখেছেন, ‘চন্দ-বরদাইয়ের কথা বাদ দিলে হিন্দী সাহিত্যের প্রথম কবির মর্যাদা পান দিল্লীর আমীর খুসরৌ (আমীর খসরু ১২৫-১৩২৫)। আমীর খুসরৌ ছিলেন বহুভাষাবিদ, ফারসি কাব্য-সাহিত্যে তাঁর স্থান খুব উচ্চে। হিন্দীতেও তিনি অনেক গান ও কবিতা লিখেছিলেন। (ঐ) সুকুমার সেন উল্লেখ করেছেন, ‘লৌকিক ভাষায় সাধনগীতি পদ্ধতির অনুশীলনে ব্রতী হলেন সুফী সাধক-কবিরা। পাঞ্জাবের প্রথম কবি শেখ ফরীদুদ্দীন শক্রগঞ্জ (?-১২৬৭) ছিলেন আমীর খুসরৌর খুরশিদ শেখ নিজামুদ্দীন আউলিয়ার গুরু।

সুকুমার সেন আরো লিখেছেন, ‘প্রাচীন বাংলা চর্যাগীতির অনুবৃত্তি পাওয়া যাচ্ছে কবীরের গানে। একাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দীর সহজ-সাধনার গঙ্গা ধারার সঙ্গে সুফী-সাধনার যমুনা-ধারাকে মিলিয়ে দিয়েছিলেন চতুর্দশ-পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীর মুসলমান সাধক কবিরা।’ কবীরের (১৩৯৮-১৫১৮)। একটি গানে চর্যাগীতির কয়েক ছত্র উদ্ধৃত হয়েছে। সুকুমার সেন এ গান পেয়েছেন একটি পুরানো বাংলা পুঁথিতে মীরার দুটি হিন্দী পদাবলী এবং জ্ঞানদাস ও মীর ফৈজুল্লা আলীর কয়েকটি ব্রজবুলি পদাবলীর সঙ্গে।

অব কেয়া করে গাঁব কতুয়ালা।

শ্ব মাংস-পসারি গীধ রাখওআলা\

মুসা কি নাও বিলাই কাড়ারী।

সো এ মেড়ুক নাস পহারী\

বলদ চিত্রাওয়ে গাভি ভই বাঞ্ঝা

বাছুরি দুহাওয়ে দিন তিন সাঞ্ঝা।

নিতি নিতি শৃগালা সিংহ সনে জুঝে

কহে কবীরে বিরল জনে বুঝে।

‘এখন কি গান করছে গ্রাম-কোতোয়াল? কুকুর দিয়েছে মাংসের পসার, নজর রাখছে বৃধ্র। ইঁদুরের নৌকা, হাল ধরছে বিড়াল। ব্যাঙ রয়েছে শুয়ে, প্রহরী নাগ। বলদ বিয়ালো, গাই হল বাঁঝা; বাছুর দোয়া হচ্ছে দিনে তিন সন্ধ্যা। নিত্য নিত্য শৃগাল যুদ্ধ করে সিংহের সঙ্গে। কবীর কহে, কম লোকেই বোঝে’।

সুকুমার সেন বলেছেন, ‘এই ধারাই সরাসরি চলে এসেছে অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীর বাউল-দরবেশি গানে।’

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে চর্যাগীতিকার সাধনতত্ত্ব ও ধর্মকেন্দ্রিক চেতনার ধারাবাহিকতা অব্যাহত ছিল। মধ্যযুগের সাহিত্যের প্রায় সব শাখার উদ্ভব হয়েছে ধর্মতত্ত্বকে কেন্দ্র করে। পদাবলী ছাড়াও প্রণয় কাব্যগুলোরও মূল বিষয় ছিল ধর্মীয় চেতনা। মধ্যযুগের কাহিনী কাব্যগুলোর মূল বার্তা ধর্মীয় আধ্যাত্মিকতায় উপস্থাপন করা হয়েছে। পদাবলী, মঙ্গল কাব্য, প্রণয় উপাখ্যান এসব কাব্যধারারই মৌলিক অবলম্বন ধর্মকাহিনী ও ধর্মতত্ত্ব। ধর্মতাত্ত্বিক উৎস থেকেই উদ্ভব হয়েছে বৈষ্ণব ও বাউলদের। ইসলামের সুফীবাদ থেকে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে যে প্রেম, ভাব ও বিদ্যা ছড়িয়ে পড়েছিল, তার প্রত্যক্ষ প্রভাব আজও চলমান, তবে প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্য থেকে আধুনিক যুগে বাংলা সাহিত্য ক্রমাগত পশ্চিম প্রভাবিত হতে থাকায় এর শেকড় দুর্বল হয়ে যায়, এ জন্য বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগ যেমন নানা বৈচিত্র্যে বর্ণময়, বিস্তৃত, তেমন এই আধুনিক বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন পর্ব-প্রাচ্যের চেয়ে প্রতীচ্যের ভাব ও ভাষা গ্রহণ করে বাংলা ভাষার প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্যের ধারাবাহিকতা থেকে বিচ্যুত হতে থাকে। আধুনিক ইংরেজী সাহিত্য শেক্সপিয়ার, মারলো ও চরসারকে এভাবে এড়িয়ে যায়নি। আজও তারা সমান উজ্জ্বলতায় ইংরেজী ভাষা সাহিত্যের প্রেরণাস্থল হয়ে আছে। বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম ঘটেছে। আধুনিক বাংলা কবিতা ও আলোচনায় যতটা বিদেশী প্রাচীন সাহিত্যের উদ্ধৃতি পাওয়া যায়, সে তুলনায় চর্যাপদ ও মধ্যযুগের সাহিত্যের কবি ও কবিতা নিয়ে আলোচনা হয় না। আধুনিক যুগ ও আধুনিক চেতনার মধ্যে যে কলোনিয়াল মানসিকতা তৈরি হয়েছে দু’শ বছরে তার বিষফলই বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতি ও সাহিত্যকে পেছনে ঠেলে দিয়েছে। বাংলা ভাষায় যখন চর্যাপদ লেখা হয়, তখন বাংলা ভাষার শক্তি ও প্রভাব নিকটবর্তী অঞ্চলের অপভ্রংশ ভাষাকে টপকিয়ে উঁচু স্তরে উঠেছিল, যে কারণে বাংলা অঞ্চলের বাইরের কবিরা অর্থাৎ যে কবিরা বাংলা ভাষার নন, তারাও বাংলা অপভ্রংশে চর্যাপদ লিখেছেন।

Rate this post