মোল্লা কাকে বলে? মোল্লা-এর অর্থ কী? ইদানিং অনেকেই আমাকে মোল্লা বলে, কারণ হয়তো আমার বর্তমানের বড় দাড়ি আর পাঞ্জাবি। কিন্তু মোল্লা অর্থ কী, সেটা আমি এখনও জানি না। আমাকে কেউ কি জানাবেন?
Sign up to join our community!
Please sign in to your account!
Lost your password? Please enter your email address. You will receive a link and will create a new password via email.
Please briefly explain why you feel this question should be reported.
Please briefly explain why you feel this answer should be reported.
Please briefly explain why you feel this user should be reported.
এটি তুর্কি শব্দ mullin থেকে এসেছে। এর অর্থ বিচারক। মুফতি শব্দের তুর্কি প্রতিশব্দ হিসেবে এটি ব্যবহার করা যায়। তুরস্ক্ তে এ শব্দটি judge বা বিচারক হিসেবে ব্যবহার করা হয়৷
মোল্লা শব্দের আভিধানিক অর্থ
১. মোল্লা বি. (বিশেষ্য) মুসলমান পণ্ডিত পুরোহিত বা ব্যবস্থাপক। [তুর. মুল্লা] (অর্থাৎ তুর্কি পরিভাষায় মোল্লা শব্দটি হ্রস্ব উ কার যোগে মুল্লা উচ্চারিত হয়।) মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত- মোল্লার জ্ঞান ও ক্ষমতার পরিধি মসজিদের ভিতরেই সীমাবদ্ধ; (আল.) অর্থাৎ আলংকারিক অর্থে প্রবাদটির অর্থ করা হয়- লোকের জ্ঞান ও ক্ষমতা স্ব স্ব কর্ম ক্ষেত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
(শৈলেন্দ্র বিশ্বাস কর্তৃক সংকলিত দেব জ্যোতি দত্তের সাহিত্য সংসদ প্রা লি ৩২ এ আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোড, কলকাতা ৭০০০০ হতে প্রকাশিত সংসদ বাংলা অভিধান ৫০৮)
২. মোল্লা [মোললা] বি. (বিশেষ্য) ১ পরিপূর্ণ জ্ঞান বিশিষ্ট মহাপণ্ডিত ব্যক্তি (মোল্লা জামী, মোল্লা আলী কারী, মোল্লা আহমদ জিওন)। ২ আরবি ফারসি ভাষা ও ইসলামি শাস্ত্রে অভিজ্ঞ ব্যক্তি। ৩ বংশীয় উপাধি বিশেষ (রফিজ উদ্দিন মোল্লা) গিরি বি মোল্লার কাজ বা কর্ম। মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত বিণ (অর্থাৎ বিশেষণ) ( আল.) আলংকারিক অর্থে নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে জ্ঞান ও শক্তি সীমাবদ্ধ। {আ. মুল্লা مُلاَّءٌ } (অর্থাৎ মোল্লা শব্দটির মূল রূপ হলো আরবী مُلاَّءٌ।
(ডক্টর মুহাম্মদ এনামুল হক ও শিব প্রসন্ন লাহিড়ী সম্পাদনায় বাংলা একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত ব্যবহারিক বাংলা অভিধান-১০০১)
মোল্লা শব্দের উপরোক্ত আভিধানিক আলোচনায় এর পারিভাষিক অথর্টি ফুটে উঠেছে। তবে দুটি অভিধানে মোল্লা শব্দের মূল ধাতু নিয়ে বিপরীত মুখী দুটি মত পরিলক্ষিত হচ্ছে।
বাংলা একাডেমীর ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে মোল্লা শব্দের আরবী মূল রূপ বলা হয়েছে مُلاَّءٌ । আরবী এ শব্দটির ধাতুগত আরো গভীরতায় গেলে মোল্লা শব্দের মূল ধাতু দাঁড়ায় م ل ء । তবে আসল ব্যাপার হল, মুল্লা উচ্চারণের কোন শব্দ আরবী অভিধানগুলোতে পাওয়া যায় না। এমন একটি কমন শব্দকে আধুনিক-প্রাচীন কোন অভিধানকর্তা তাদের অভিধানে ধরবেন না -ব্যাপারটা মেনে নিতে কষ্ট হবে। উপরন্তু আরবী ملأ (মালা-উন) ধাতুর অর্থের সাথে মোল্লা শব্দের অর্থের তেমন একটা সাযুজ্য নেই। এ দিক বিবেচনায় মোল্লা শব্দের আদি ও মূল রূপকে আরবী مُلاَّءٌ (মুল্লাউন) ধরে নিতে পারি না।
অন্য দিকে মওলভী ফিরুজুদ্দীন কৃত উর্দূ অভিধান ফিরুজুললুগাতে বলা হয়েছে, মোল্লা শব্দটি মূলত মওলা শব্দের অপভ্রংশ। আর আরবী মাওলা (المولى) শব্দের মূলধাতু হল و ل ى । আর وَلِىَ শব্দ থেকে বন্ধু হওয়া, মিত্র হওয়া, কিংবা কর্তৃত্ব করা, শাসন করা, ক্ষমতাসীন হওয়া ইত্যাদি অর্থ সৃষ্টি হয়। এ দৃষ্টিকোণ থেকে মোল্লা শব্দের ধাতুগত অর্থ এবং অভিধানিক ও পারিভাষিক অর্থের মাঝে বেশ সাযুজ্য লক্ষণীয়। সুতরাং আমরা ধরে নিতে পারি, মোল্লা শব্দটি মূলত মাওলা শব্দের ভুল সিদ্ধ একটি শব্দ। মানুষের মুখে চলতে চলতে তার আদি রূপ ম্লান হয়ে গেছে। ভাষা সংস্কৃতির আবহমানতায় এরূপ নজীর ভুরি ভুরি বিদ্যমান। শব্দের ভাষাগত বিবর্তনে মানুষের মুখ চালনার বেশ বড় একটা দখল রয়েছে। একটি শব্দের ভুল ব্যবহার কিংবা অশুদ্ধ উচ্চরণ মানুষের ব্যবহার চালনায় এক কালে তা শুদ্ধতা এমনকি সাহিত্য পদমর্যাদাপূর্ণ শব্দের স্বীকৃতি লাভ করে। ভাষা-শব্দ মানুষের মুখের হাওয়ায় উড়ে তার রূপ বদলায়। ধারণ করে বিবিধ বিচিত্র রূপ। শব্দগত এমন রূপ বৈচিত্রের আবহ সব ভাষাতেই রয়েছে। এ থেকে মুক্তি কোন ভাষাতেই সম্ভব নয়।
মোল্লা শব্দের অর্থ প্রসঙ্গ
পিছনে আমরা ইংরেজি, বাংলা, উর্দূ অভিধানগুলোতে মোল্লা শব্দের অর্থ দেখে এসেছি। সে অর্থ বিবেচনায় একজন শিক্ষিত মানুষ মানে মোল্লা। একজন পি এইচ ডি হোল্ডার ডক্টর মানে তিনি মোল্লা। ভার্সিটির একজন অধ্যাপক মানে তিনি মোল্লা। বুদ্ধিজিবী, পণ্ডিতজন, ধার্মিক সবই মোল্লা শব্দের সমার্থক। এ দৃষ্টিকোণ থেকে দেশের সেরা ও খ্যাতিমানদের কেউ মোল্লা শব্দের আওতামুক্ত নন। বস্তুত এক কালে মোল্লা শব্দটি মহাজ্ঞানী শাস্ত্রবিদদের পদমর্যাদার প্রতীক ছিল। যে কারো জন্য এই শব্দ ব্যবহারের সুযোগ ও অধিকার ছিল না। আধুনিক কালে যেমন ডক্টর শব্দটি প্রয়োগের জন্য একজন মানুষকে জীবনের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ কাটাতে হয় পৃথিবীর নানা বিদ্যাপীঠে। একজন উচ্চশিক্ষিত মানুষ অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে তারপর ডক্টর শব্দটি নিজের নামের শেষে এঁটে দিতে সক্ষম হয়। বর্তমান কালের ডক্টর কোন ফেলনা শব্দ নয়; যে কেউ এটাকে যেন তেন করে ব্যবহার করতে পারে না। মোল্লা শব্দটি ঠিক তেমনি একটি উচ্চ পদমর্যাদার প্রতীকী শব্দ ছিল। আজ গৌরবময় সেই শব্দটি বিদ্রƒপাত্মক নিচাশয় শব্দের রূপ নিয়েছে। এরূপ রূঢ় আচরণ শুধু মোল্লা শব্দের সাথেই করা হয় নি; খলিফা, কাজী প্রভৃতি সম্মান ও পদমর্যাদাপূর্ণ শব্দগুলোর সাথেও ঠিক একই আচরণ করা হয়েছে। আজ খলিফা বলতে আমরা একজন সাধারণ দর্জি শ্রমিককে বুঝি। ব্যাপারটি এখানেই সীমবদ্ধ নয়। ব্যঙ্গাত্মক ব্যবহারে খলিফা শব্দটি ধূর্ত ব্যক্তিকেও নির্দেশ করে। দেখুন সংসদ বাংলা অভিধানের মন্তব্য :
খলীফা, খলীফা-(১) বি. ওস্তাদ, কারিগর; দরজি; মুসলমানদের শ্রেষ্ঠ নৃপতি ও ধর্মনেতার উপাধি; (ব্যঙ্গে) উস্তাদ বা ধূর্ত ব্যক্তি। (২) (ব্যঙ্গে) ওস্তাদ বা ধূর্ত, [আ. খলীফা]। -১৫৪
অথচ খলিফা একজন মুসলিম রাষ্ট্রনায়কের সম্মানিত পদমর্যাদাবাচক শব্দ। ইসলামী খিলাফতের সুমহান পদমর্যাদা হতে খলিফা শব্দটিকে নামিয়ে এনে একটা সাধারণ দর্জি পেশার মানুষের সাথে জুড়ে দেয়া হয়েছে। তেমনিভাবে কাজী শব্দটিও ব্যবহার সন্ত্রাস হতে মুক্ত নয়। বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে উল্লিখিত হয়েছে :
কাজি… ৩ যিনি মুসলমানদের বিবাহাদি রেজিস্ট্রি করেন। -২৪৩
মহান বিচারপতির পদমর্যাদাপূর্ণ একটি গৌরবান্বিত শব্দকে বিবাহ রেজিস্ট্রির মত তুলনামূলক নিম্ন শ্রেণীর একটি কাজের সাথে সম্পৃক্ত করে দেয়া হয়েছে। সম্মানিত এই শব্দগুলোকে হেয় প্রতিপন্ন করার পিছনে ইসলামের জন্মশত্রু ইংরেজ বেনিয়ারা নিরলস চেষ্টা সাধনা করে গেছে। সে সাধনার ফল আজ তারা ইংল্যান্ডের মাটিতে বসে আয়েশি ভঙ্গিতে ভোগ করে চলছে। আমরা কলজে বিহীন মুসলমান। আমাদের স্বকীয় অনুভূতি বলতে কিছুই নেই। আমরা ওদের শেখানো বুলি গেয়ে বুলবুল করছি। বুলিটা কি আমাদের পক্ষের না বিপক্ষের আদৌ ভেবে দেখি না।
মোল্লা শব্দের উদ্দীষ্ট পুরুষ কে বা কারা ?
মোল্লা অর্থ মহাপণ্ডিত, ইসলামী শাস্ত্রের অভিজ্ঞ ব্যক্তি, Very learned man, Doctor, School master, Judge ইত্যাদি।
অর্থগত দৃষ্টিকোণ থেকে মোল্লা শব্দটি প্রয়োগের ক্ষেত্রে কিছুটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। মাথায় টুপি গায়ে কোর্তা আর মুখ ভর্তি দাড়ি হলেই মোল্লা হওয়া যায় না। একজন মাদরাসার ছাত্র মানেই মোল্লা নয়। মোল্লা টাইটেল অর্জন করতে হলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হয়। সে মতে একজন মাদরাসা শিক্ষার্থী মোল্লা হতে পারে না। যাবৎ না উচ্চ শিক্ষা সার্টিফিকেট হাতে তুলে নিবে। হোক না তার মুখ ভর্তি দাড়ি। নতুবা নির্মলেন্দুগুণ, রবি ঠাকুর, চেগুয়েভারা, ডারউইন, হুগো শ্যাভেজ, কার্ল মার্কস, লেলিন সহ শিখ সম্প্রদায়ের মানুষগুলো মোল্লা বনে যাবেন। কিন্তু যারা ‘মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত’ কিংবা মোল্লা বলে বিদ্রƒপ উপহাসের অভিনয় করতে চান তারা কি এ ব্যবধান বুঝেন? উপহাস করেন বলে কি এ ব্যবধান বোধটুকুর প্রয়োজন নেই? বিদ্রƒপ, উপহাস এবং ব্যঙ্গাত্মক ভাষা ব্যবহারের জন্যও জ্ঞানের প্রয়োজন। না জেনে ভুল উপহাস করলে নিজেকেই বিদ্রƒপের পাত্র হতে হয়। মোল্লা শব্দটি যে আসলেই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় জনপ্রিয় একজন লেখকের নিরপেক্ষ মন্তব্যেও তা ফুটে উঠছে। বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. আব্দুল হাননান বলেন, মোল্লা এবং মুনশী, বাংলাদেশের দুটো জনপ্রিয় পদবি ধারা। এদের বংশগত প্রসার প্রায় দেশব্যাপী। অধুনা অনেক মোল্লা ও মুনশী পরিবারের বাঙালী মুসলমান এই পদবি ধারণ না করলেও অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, তাঁদের পূর্ব পুরুষরা ছিলেন মোল্লা অথবা মুনশী। কতক গোত্রে এই পদবি নিয়ে গ্রামবাংলায় কৌতুক প্রচলিত থাকার কারণে এই পদবি ব্যবহারে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া লক্ষগোচর হয়। ফলে দিন দিন জনপ্রিয় এই পদবি বংশ ধারা বাঙালি মুসলমান সমাজ থেকে লোপ পাচ্ছে। ‘মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত’Ñএই বহুল কথিত প্রবাদ বাংলাদেশে মোল্লা বংশের জন্যে না হলেও তা এই পদবি ক্ষেত্রে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলেছে। ….কিন্তু পরবর্তীকালে মসজিদে নামাজ পরিচালনাকারী মাত্রই ‘মোল্লা’ নামে অভিহিত হতে থাকে। এখান থেকেই সাধরণের বংশ-পদবি হিসেবে তা ব্যবহার শুরু হওয়ায় এবং তাঁরা সকল জ্ঞানের আকর না হওয়া সত্ত্বেও ‘মোল্লা’ পদবি ধারণ করায়, শেষ পর্যন্ত ‘মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত’ প্রবাদের উৎপত্তি হয়েছে ধারণা করা যায়। আধুনিক শিক্ষিত বাঙালি মুসলমান সমাজে তাই ‘মোল্লা’ পদবি ব্যবহারের মাত্রা কমে এসেছে বলে অনুমান করার যৌক্তিকতা রয়েছে।’ ড. মোহাম্মদ হাননান, বাঙালি মুসলমানের পদবি ৩২-৩৩
আমাদের সমাজে মাথায় এক টুকরো সাদা কাপড় এঁটে দিলেই তিনি মোল্লা হয়ে যান। মুখে একগুচ্ছ দাড়ি গজিয়েছে; ব্যাস তিনিই মোল্লা। গায়ে একটু লম্বা কাপড় ঝুলছে তো মোল্লা হয়ে গেছেন। এরূপ সস্তা মোল্লার তো দেশে অভাব নেই। সারা দেশে বিশেষত গাঁও-গ্রামে যারা বাপ-দাদার উপাধি পেয়ে গেছেন তারা তো অবলীলায় মোল্লা বনে গেছেন। কারণ আমাদের দেশের একটা সংস্কৃতি হল, বাবা বিশেষত দাদা হলে মুখে দাড়ি ছেড়ে দেন, মাথায় টুপি তুলে নেন। এ সংস্কৃতির নিরিখে ঘরে দুয়ারে, পথে-ঘাটে মোল্লা মানুষে গিজ গিজ করবে।
মোল্লা বলে কাউকে উপহাস করবেন করুন। তবে তার আগে মোল্লা শব্দের যথাযথ প্রয়োগটা জেনে নিন। ভুল কিংবা মিথ্যা উপহাস করে নিজেকে সচেতন মূর্খ পরিচয় দেয়ার কি প্রয়োজন ?
হ্যাঁ একথা স্বীকার্য্য, মোল্লা শব্দটি সর্বোতভাবে এখনো বিদ্রƒপাত্মক অভিধার স্বীকৃতি পায় নি। কেউ কেউ এখনো কোন ইসলামিস্ট ব্যক্তিকে মোল্লা শব্দে সম্বোধন করে সম্মান দেখান। এ শ্রেণীতে যারা আছেন তারা অবশ্য শব্দটির প্রয়োগে বেশ সচেতন। তারা না জেনে কাউকে মোল্লা বলতে যান না। তারা বুঝেন মোল্লা একটি সম্মান সূচক শব্দ। এটাকে অপাত্রে প্রয়োগ করা যাবে না। ভেবে চিন্তে সুপাত্রেই ব্যবহার করতে হবে। গোলটা বাধান উপহাসকারী ভাইজানেরা। কিন্তু এ শ্রেণীর ভাইজানেরাই আবার যখন বিপদে পড়েন কিংবা তাদের প্রয়োজন হয় তখন মোল্লা হুযুর ছাড়া কিছুই বুঝেন না। উপহাস করতে বেশ মজা পান। এ মজা করতে গিয়ে সব ভুলে যান।
কখনো যিনি তেমন কোন এডুকেটেড নন এমন ব্যক্তিকে পণ্ডিত বলে কোন কারণে উপহাস করা হয়। এ ক্ষেত্রে উপহাসের সার্থকতা সৃষ্টি হয়। এটাকেই মূলতঃ উপহাস বলে। উপহাস কিংবা ঠাট্টা বিদ্রƒপেরও একটা সংজ্ঞা আছে। ঠাট্টা-বিদ্রƒপ বলা হয় যার ভিতরে যে গুণ বা দোষ নেই সে গুণ-দোষের সাথে তাকে সংশ্লিষ্ট করে বিদ্রƒপাত্মক আচরণ করা। তো সত্যিকার অর্থেই যিনি জ্ঞানী কিংবা পণ্ডিত তাকে পণ্ডিত বললে তো আর উপহাস হবে না। উপহাসের পরিবর্তে সম্মান প্রদর্শন হয়ে যাবে।
আমার দূর সম্পর্কের ছোট্ট একটা মামা ছিল। ডান-বাম একটু কম বুঝতো। তাই সবাই তাকে নিয়ে একটু মজা করতো। বাড়ির পাশেই দৈনিক বাজার। মামাটা তার গোটা দিনটাকেই বাজার-ঘাটেই কাটানোর চেষ্টা করতো। বাজারের এক দোকানদারের নাম তোতা মিয়াঁ। সবাই তোতা ভাই বলে ডাকতো। একদিন বিকেলে আমার সে বলদ মামাটি এলো তোতা ভাইয়ের দোকানে। আমি তখন কি একটা প্রয়োজনে সে দোকানের সামনেই দাঁড়ানো ছিলাম। তোতা ভাই মামাকে নিয়ে মজা করতে শুরু করলেন। এতে আমার ছোট্ট বোকা মামাটি ভীষণ ক্ষেপে গেল। ছোট্ট মানুষ বড়দের উপরে ক্ষেপে গেলে শোধ নেবার মত মুখ বিনে আর কিছুই থাকে না। মুখ বলতে তার একমাত্র অস্ত্র গালি। কিন্তু আমার ডান-বাম না বোঝা মামাটির বকা বা গালির সংজ্ঞা জানা ছিল না। সে ভাবতো চোখ-মুখ খিচিয়ে রাগতঃ স্বরে কিছু শব্দ বলতে পারলেই সেটা গালি বলে গণ্য হবে। তাই আমার মামাটি চোখ-মুখ কালো করে অনবরত বলতে শুরু করলো- তোতা ভাই তোতা ভাই তোতা ভাই…। ব্যস, মামা এক-আধ মিনিট শব্দগুলো বলে দম নিল। এরপর চলে গেল। সে ভাবল আমার উপর বকা বা গালি দেয়ার যে দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল তা পালন করলাম। তো আর বসে থেকে লাভ কি? চলে যাই। আমরা তো এদিকে হেসে খুন।
তো তোতা ভাই তো কোন বকা নয়। রাগতঃ স্বরে বারবার মানুষের নাম মুখে আনাকে যে বকা বলবেন সে নিজেই বোকা বনে যাবেন।
আসলে মোল্লা বলে যারা উপহাস করেন তারা কিন্তু বুঝেন, লোকটা ধর্ম টর্ম সম্পর্কে কিছু জানে। যার সম্পর্কে সে জানবে যে সে ধর্ম সম্পর্কে গণ্ডমূর্খ তাকে ভুলেও মোল্লা বলতে যাবে না। তো দেখা যাচ্ছে সে হাওয়ার উপরে না জেনে যাকে তাকে মোল্লা বলছে। সে দাড়ি-টুপিকেই মোল্লা বনার মানদণ্ড বানিয়ে নিয়েছে। তার এ মানদণ্ড চরম ভুল ও বাস্তবতা বিবর্জিত। অন্যদিকে কোন আলেম বা ইসলামিস্টকে যদি মোল্লা বলে উপহাস করা হয় তবে এটা উপহাস হবে না। উপহাসের অপপ্রয়োগ হবে। সেতো অর্জিনালই শাস্ত্রীয় মোল্লা। এ প্রয়োগ কিংবা ব্যবহারে তো বিজ্ঞ জনদের হেসে ওঠার কথা। বিশেষতঃ যারা ভাষা-শব্দ নিয়ে নাড়াচাড়া করেন তারা আচমকা হেসে উঠবেন।
মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত
‘মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত’ এটি একটি প্রবাদ কথা। প্রবাদ অর্থ বহুকাল ধরে প্রচলিত উপদেশমূলক জ্ঞানগর্ভ উক্তি, জনশ্রুতি, রূপকথা ইত্যাদি। এসব প্রবাদ প্রবচন সৃষ্টির পিছনে বাস্তব ঘটিত বিশেষ কোন ঘটনা কাজ করে থাকে। বাংলায় একটি প্রবাদ আছে আদার ব্যাপারীর জাহাজের খবর। কোন কালে হয়তো কোন আদা ব্যবসায়ী জাহাজ সম্মন্ধে কারো কাছে জানতে চেয়েছিল কিংবা জাহাজ সম্মন্ধে কোন কথা বলেছিল। ব্যস সেখান থেকেই চাউর হয়ে যায় ‘আদার ব্যাপারীর জাহাজের খবর’। অর্থাৎ তুমি অতি সাধারণ একজন আদা ব্যবসায়ী। তোমার মুখে তো জাহাজের কথা শোভা পায় না। তোমার দ্বারা কি জীবনে কখনো জাহাজ কেনা কিংবা জাহাজে চড়া সম্ভব হবে? তো এতো ছোট মানুষ হয়ে অত বড় কথা মুখে আনো কি করে? ছোট মুখে বড় কথা! কিন্তু এখন আর প্রবাদটি আসল অর্থে ব্যবহৃত হয় না। কেউ ছোট হয়ে বড় কথা বললে কিংবা অযোগ্য হয়ে যোগ্যতার ভান দেখালে তার সম্মন্ধে বলে দেওয়া হয় ‘আদার ব্যাপারীর জাহাজের খবর’। প্রবাদ সৃষ্টির পিছনে কিন্তু একজন আদা ব্যবসায়ীই দায়ী ছিল। সেই হয়ত একা জাহাজের খবর বলেছিল। আর কোন আদা ব্যবসায়ী এমন অভিলাষ দেখায় নি। দেশ বা এলাকার সব আদা ব্যবসায়ীরা মিলে সংবাদ সম্মেলন করে জাহাজের সংবাদ বলে নি কিংবা জানতে চায় নি। এখন হয়তো সারা দেশে জরিপ করেও কোন আদা ব্যবসায়ীকে পাওয়া যাবে না যে জাহাজ সম্মন্ধে অভিলাষ দেখায়। কিন্তু কোন এক কালে ঘটনা একটা ঘটে গেছে তাই মুখে মুখে চাউর হয়ে এখনো চলছে। এখানে আদা ব্যবসায়ী বেচারার কিন্তু দোষ ছিল না। কোন বিষয়ে মানুষের জানার আগ্রহ থাকতেই পারে। মানুষের স্বপ্ন থাকতেই পারে। হোক না সে ছোট কিংবা অতি সাধারণ একজন মানুষ। জানতে চাওয়া তো ভুল নয়। স্বপ্ন দেখা তো অপরাধ নয়। কিন্তু ঈর্ষাকাতর কিছু মানুষ হয়তো বেচারার এ অনুসন্ধিৎসা কিংবা স্বপ্ন দেখাকে সহ্য করতে পারে নি। তাই তার স্বপ্নটাকে বিদ্রƒপাত্মক ভাবে সমাজে ছড়িয়ে দিয়েছে। ব্যস নেট জগতের মতো মুখে মুখে সারা দেশে ছড়িয়ে গেছে। প্রবাদ প্রবচন গুলো মূলত এভাবেই গড়ে ওঠে।
‘মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত’ এ প্রবাদটির পেছনেও হয়তো বা এমন একটি ঘটনাই কাজ করেছিল। হয়তো কোন এলাকায় শ্মশ্রু মণ্ডিত টুপি জুব্বা পরা কোন ব্যক্তি বাস করত। তার পাঁচ বেলা নামাজ পড়া বা পড়ানো ছাড়া পারিপাশ্বিক কোন যোগ্যতা কিংবা দাপট ছিল না। কিছু অবিবেচক মানুষ সহজ সরল মানুষটার গায়ে একটা বাক্য এঁটে দিল- মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত। ব্যস বৈরি শত্রু ভাইদের সহায়তায় বাক্যটি মুখে মুখে মার্কেট পেয়ে গেল।
বস্তুত এ প্রবাদটি একটু ব্যতিক্রম। বাস্তবতা যাই হোক ব্যবহার অনুভূতিতে প্রবাদটি তার আসল অর্থেই বেশি ব্যবহৃত হয়। রূপক অর্থে খুব একটা ব্যবহৃত হয় না। বিশেষ কোন বিষয়ে কিংবা এলাকায় কারো যোগ্যতা ও দাপট সীমিত হয়ে পড়লে কেউ মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত প্রবাদটি প্রয়োগ করে না। অভিধানে যদিও এরূপক অর্থটিও আছে। তবে কালে ভদ্রে দু একজন ব্যবহার করলেও করে থাকতে পারে। দাড়িয়াল জুব্বা টুপি পরা মানুষগুলোকে কেন্দ্র করেই এ প্রবাদটি ব্যবহৃত হয়। বাস্তবতার নিরিখে তার যোগ্যতা ও শক্তির সীমা রেখা কম না বেশি তা মেপে দেখা হয় না। উদ্দেশ্য যেহেতু একটু খোঁচা দেয়া; তাই ওই বিবেচনা করতে যাবে কেন? তাতে যদি খোঁচা মারাটা স্বার্থক না হয়!