কর্ণফুলী টানেল রচনা

ভূমিকা

বাংলাদেশ সরকার দেশের উন্নয়নের জন্য অনেকগুলো মেগা প্রকল্পের কাজ হাতে নিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল – কর্ণফুলী টানেল হল কর্ণফুলী নদীর নিচে অবস্থিত একটি নির্মানাধীন সড়ক। এই কর্ণফুলী টানেল কে আবার সুরঙ্গ পথ ও বলা হয়ে থাকে। কর্ণফুলী টানেল বা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের রয়েছে বিস্তর ইতিহাস। এই টানেলটি হলো বাংলাদেশের প্রথম সুরঙ্গ পথ এবং দক্ষিণ এশিয়ায় নদীর তল দেশ দিয়ে প্রথম ও দীর্ঘতম সুরঙ্গ পথ।

এই টানেলটি যুক্ত করবে কর্ণফুলী নদীর দুই তীরের অঞ্চলকে। এছাড়াও এই টানেলের সুরঙ্গের মধ্যে দিয়ে যুক্ত হবে ঢাকা-চট্টগ্রাম – কক্সবাজার মহাসড়ক। টানেল কে ঘিরে দেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা দোয়ার খুলবে কারণ এই টানেল চালু হলে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে বাণিজ্যিক ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় এবং সেই সঙ্গে উন্মোচিত হবে হাজারো সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সবচেয়ে বড় বন্ধু হল চীন। চীনের সহযোগিতায় বাংলাদেশ সরকার ১৭ টি প্রকল্প করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।আমাদের সকলের উচিত দেশকে একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া আর এটাই আমাদের সকলের প্রত্যাশা। নানা বাধা বিপত্তি থাকা সত্ত্বেও কঠোর পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে পার হাওয়া বড় একটি প্রকল্প হল এই বঙ্গবন্ধু টানেল বা কর্ণফুলী টানেল ।

বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণের ইতিহাস

সর্বপ্রথম কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে এই কর্ণফুলী টানেল নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু নানা বাধা বিপত্তির কারণে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়নি। কর্ণফুলী নদী বাংলাদেশের বাণিজ্যিক নগরী চট্টগ্রাম কে দুই ভাগে বিভক্ত করেছে। এই নদীর ওপর যদিও ইতিমধ্যে তিনটি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে কিন্তু চট্টগ্রামের মত একটি শিল্প নগরীর জন্য এই তিনটি সেতু পর্যাপ্ত নয়। আবার কর্ণফুলী টানেল নির্মাণের অন্যতম প্রধান কারণ হলো কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে পলি জমা হয়ার

আর এই পলি চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য একটি হুমকি স্বরূপ। আর এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে বাংলাদেশ সরকার কর্ণফুলী নদীতে নতুন সেতু নির্মাণ না করে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আর এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্ণফুলী নদীর তলদেশে দিয়ে টানেল নির্মাণের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। ২০১৪ সালের ১০ ই জুন এই কর্ণফুলী টানেল নির্মাণের জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীনের প্রধানমন্ত্রী শি জিন পিং স্বাক্ষর করেন এটি সমঝোতা স্মারক।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং প্রকল্পটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় টানেল প্রকল্প এলাকায় কনস্ট্রাকশন ইয়ারে সুইচ টিপে আনুষ্ঠানিকভাবে এই টানেলটি খননের কাজ উদ্বোধন করেন করেন।

কর্ণফুলী টানেল পরিচিতি

কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত এই টানেলের নাম দেয়া হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। চট্টগ্রাম বন্দর হল অন্যতম শিল্প নগরী। আর মূল নগরীর সাথে সংযোগ স্থাপনকারী উপযুক্ত হিপ্টার ল্যান্ড চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি জরুরী কারণ কর্ণফুলী নদীর পূর্ব পাশে শিল্পাঞ্চল এবং পশ্চিম পাশে সমুদ্র বন্দর ও বিমানবন্দর। বঙ্গবন্ধু টানেল বা এই কর্ণফুলী টানেল হল চার লেন বিশিষ্ট।

কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে এই টানেলটি নির্মিত হয়েছে দুইটি টিউব সংবলিত ৩.৪ কিলোমিটার। চট্টগ্রাম শহর প্রান্তের নেভাল একাডেমীর পাশ দিয়ে এই সুরঙ্গ নদীর দক্ষিণ পাড়ের সি ইউ এফ এল যা চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার এবং কাব্য অর্থাৎ কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার লিমিটেড কারখানার মাঝস্থান দিয়ে নদীর দক্ষিণ প্রান্তে পৌঁছাবে। কর্ণফুলী নদীর ১৫০ ফুট গভীরে নদীর মধ্যভাগে এই সুরঙ্গটি অবস্থান করবে।

যাতায়াতের সময় কমিয়ে আনা, যানজট কমানো এবং চীনের বেল্ট অ্যান্ড কোড ইনিশিয়েটিভের বিআরআই অংশ হতে প্রয়োজনে এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্কের বিআরআই অংশ হতে আঞ্চলিক যোগাযোগ কাঠামোর উন্নয়ন ।

প্রকল্পের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা

বঙ্গবন্ধু টানেল বা কর্ণফুলী টানেল নামক যে সুরঙ্গ পথটি কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে তৈরি হচ্ছে তা হবে মূলত চার লেন বিশিষ্ট। তবে মূল টানেলে থাকবে দুইটি টিউব। নদীর তলদেশে প্রতিটি টিউবের চওড়া হবে ১0.৮ মিটার এবং এর উচ্চতা হবে ৪.৮ মিটার বা ১৬ ফুট। আর একটি টিউব থেকে অপর টিউবের পাশাপাশি দূরত্ব হবে ১২ মিটার। বঙ্গবন্ধু টানেল বা কর্ণফুলী টানেলের পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে অপ্রচ রোড হবে ৫.৩৫ কিলোমিটার এবং ওভারব্রিজ হবে ৭২৭মিটার।

এবং এই কর্ণফুলী টানেলটি চট্টগ্রাম শহরকে আনোয়ারা উপজেলার সাথে যুক্ত করবে। বঙ্গবন্ধু টানের বা কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডি প্রতিবেদন অনুযায়ী এই টানেলের নিচ দিয়ে প্রথম বছর প্রায় ৬৩ লাখ গাড়ি চলাচল করবে এবং পরবর্তীতে আরো বাড়বে এবং পরবর্তীতে প্রায় দেড় কোটিতে গিয়ে দাঁড়াবে। তবে গাড়ি চালুর প্রথম বছর প্রায় ৫১ শতাংশ কন্টেইনার পরিবহনকারী টেলার চলাচল করবে এবং বিভিন্ন ধরনের ভ্যান ও ট্রাকো চলাচল করতে পারবে।

বাকি ৪৯ শতাংশের মধ্যে থাকবে বাস ও মিনি বাস থাকবে ১৩ লাখ আর বিভিন্ন ছোট গাড়ি, ট্রাকও বাস চলাচল করবে প্রায় ১২ লাখ। এই বঙ্গবন্ধু টানেল বা কর্ণফুলী টানেলটি নির্মিত হলে এটি হবে এটি হবে বাংলাদেশ তথা এশিয়া মহাদেশের প্রথম ও দীর্ঘতম সমুদ্র বা নদীর তলদেশ দিয়ে নির্মিত সুরঙ্গ পথ।

টানেলের নির্মাণ তথ্য

কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে নির্মিত এই টানেলের নাম হল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। চট্টগ্রাম সিবিআইএস বাংলাদেশ – চীন – ইন্ডিয়া – মিয়ানমার করিডোরে তৃতীয় নাম্বার স্থানে অবস্থিত।  এই টানেলের করিডোর চীনের কুনসিং থেকে শুরু করে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার হয়ে ভারতের কলকাতায় গিয়ে শেষ হবে। এই কর্ণফুলী টানেলটি নির্মাণের কাজ হাতে পেয়েছে চীনের এক নির্মাণ সংস্থা।

এই সুরঙ্গটি তৈরির কাজ এখনো চলমান রয়েছে তবে ধারণা করা হচ্ছে প্রায় ৯৬ শতাংশ কাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। এই বঙ্গবন্ধু টানেলটির দৈর্ঘ্য ৪৩ কিলোমিটার এবং এর সাথে পাঁচ ৫ কিলোমিটার সড়ক যুক্ত হবে। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই টানেলের বোরিং কাজের শুভ উদ্বোধন করেন। আর এই প্রকল্পটি নির্মাণের মেয়াদ ধরা হয়েছে পাঁচ ৫ বছর।

কর্ণফুলী টানেলের  অবস্থান

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল বা কর্ণফুলী টানেলটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর এবং শিল্প নগরী চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে অবস্থিত। এই টানেলটির প্রবেশ পথ পতেঙ্গার ৪১ নং ওয়ার্ড থেকে নদীর ওপর পাড় আনোয়ারা প্রান্তের সার কারখানার মাঝ স্থান দিয়ে বহিঃগমন করবে। এই টানেলটি নির্মিত হলে শিল্পনগরী চট্টগ্রামকে সংযুক্ত করবে দেশের সব অংশের সাথে এবং এই সংযোগের ফলে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ও বৃদ্ধি পাবে। এবংএই সংযোগ সহ শিল্প নগরী চট্টগ্রামের অনেক উন্নতি হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

কর্ণফুলী টানেলের নকশা

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল বা কর্ণফুলী টানেলের নকশা প্রস্তুত করা হয়েছে চট্টগ্রাম শহরের উন্নয়নের দিকে লক্ষ্য রেখেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল বা কর্ণফুলী টানেলে রয়েছে দুই লেনের রাস্তা এবং আরো রয়েছে একটি পৃথক সার্ভিস লেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের দৈর্ঘ্য ৯.৩৯২ কিলোমিটার কিন্তু পানিতে অবস্থান করবে ৩.৪৩ কিলোমিটার।

এই টানেলে ১২৬ টি জেড ফ্যান থাকবে টানেলের ভিতর বায়ু প্রবাহ নিশ্চিত করার জন্য এবং ৮ টি বায়ু চলাচল ফ্যানে থাকবে। টানেলের ভেতরের গতিসীমা থাকবে ঘন্টায় ৬০ কিলোমিটার এবং ঘন্টায় সর্বোচ্চ ৮ হাজারটি জান বহন চলাচলে সক্ষম হবে এই কর্ণফুলী টানেল।

কর্ণফুলী টানেলের নির্মাণের চুক্তি ও ব্যয়

২০১৪ সালের জুন মাসে বাংলাদেশ এবং চীনের সাথে এই বঙ্গবন্ধু টানেলটি স্থাপনে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর এক বছর পর অর্থাৎ ২০১৫ সালের ৩০ জুন চীনের সড়ক পরিবহন মন্ত্রী ইয়াং চুয়ানতাঙ্গের উপস্থিতিতে দুই পক্ষের মধ্যে ব্যবসায়িক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এরপর ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে চীনের প্রেসিডেন্ট সিং জিন পিং আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রকল্পটির উদ্বোধন করেন। বাংলাদেশ ও চীন সরকার যৌথ অর্থায়নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল বা কর্ণফুলী টানেলটি বাস্তবায়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।

 ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে চীনের প্রেসিডেন্ট ঢাকা শহরে আসেন এবং টানেল চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই প্রকল্পটির ধার্য করা হয়েছে ১০৭৩৪ কোটি ৪২ লক্ষ টাকা আর এই অর্থের মোট সরকার দিচ্ছে ৪৪৬১ কোটি ২৩ লক্ষ টাকা আর ২০ বছর মেয়াদি ঋণ হিসেবে চীনের এক্সিম ব্যাংক দিচ্ছে ৫৯ ১৩ কোটি টাকা। আর এই টানেলের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান কাজটি বাস্তবায়ন করছে চীনের কমিউনিকেশন ও কনস্ট্রাকশন কোম্পানি।

কর্ণফুলী টানেলের নির্মাণের কারণ ও উদ্দেশ্য

বাংলাদেশ নদী মাতৃক দেশ। শিল্পনগরী চট্টগ্রামে রয়েছে অনেক নদী এবং সমুদ্র। আর কর্ণফুলী নদী চট্টগ্রাম শহরকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছে। নদীর এক প্রান্তে রয়েছে ভারী শিল্প এলাকা এবং অপর প্রান্তে রয়েছে বন্দরনগর। যদিও ইতিপূর্বে কর্ণফুলী নদীর ওপর তিনটি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে কিন্তু বন্দরনগরী চট্টগ্রামের জন্য এই সেতু যথেষ্ট নয়।

এছাড়াও কর্ণফুলী টানেলের নির্মাণের প্রধান কারণ ও উদ্দেশ্য হল – কর্ণফুলী নদীর তলদেশে পলি জমে যা চট্টগ্রাম শহরের জন্য একটি বড় হুমকি। আর এই সমস্ত কারণে কর্ণফুলী নদীর উপর সেতু নির্মাণ না করে নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মাণ করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এছাড়াও যে সমস্ত কারণে টানেল নির্মাণ করা প্রয়োজন তা হলো-

  • বাণিজ্য সহজীকরণ ত্বরান্বিত করা, অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ করা এবং খনিজ দ্রব্য, পানীয় ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের যৌথ উত্তোলন উন্নয়ন করা।
  • কর্ণফুলী নদীর পূর্ব তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা শহরের সাথে ডাউন টাউন কে যুক্ত করা এবং উন্নয়ন কাজ করান্নিত করা।
  • চট্টগ্রাম শহরে নিরবছিন্ন ও যুগ-পযোগী সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং বিদ্যমান সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন, এশিয়ান হাইওয়ের সাথে সংযোগ স্থাপন।
  • পন্য সেবা ও জ্বালানির বাজার প্রবেশ গণ্যতা বাড়ানোর পাশাপাশি অশুল্ক বাধা দূরীকরণ।
  • বন্দরনগরী চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মধ্যে নতুন একটি সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
  • কর্ণফুলী নদীর দুই পাড়ের মধ্যে যোগাযোগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতির প্রসার ঘটানো।
  • কর্ণফুলী নদীর ওপর বিদ্যমান দুই সেতুর ওপর থেকে যানবাহনের চাপ কমিয়ে আনা।
  • ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রধান স্থানের সঙ্গে কর্ণফুলীর পূর্ব পাশ্বের নির্মীয়মান শহরে সংযোগ স্থাপন এবং উন্নয়ন কাজে গতি বৃদ্ধি করা।
  • কর্ণফুলী নদীর দুইপাশে নতুন শহর ও জনবসতি বাড়ানো।
  • শিল্প নগরী চট্টগ্রাম বন্দরে আরো সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করা।
  • চীনের সাংহায় নগরীর মত চট্টগ্রামকেও ওয়ান সিটি টু টাউন এর আদলে গড়ে তোলা।
  • পরিবহন কেন্দ্রস্থল হিসেবে চট্টগ্রাম বাণিজ্যিক শহরকে আরও বেশি শক্তিশালী করা।
  • আনোয়ারা উপজেলায় এক্সক্লুসিভ চাইনিজ ইকোনমিক ও করিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোনকে আরো সমর্থন যোগানো।
  • বঙ্গোপসাগর কে ঘিরে আবর্তিত ব্লু ইউ ইকোনমি সমর্থন দেওয়া।
  • চট্টগ্রাম নগরীতে নিরবছিন্ন সড়ক যোগাযোগের পাশাপাশি বিদ্যমান সড়ক নেটওয়ার্কের উন্নয়ন করা।

কর্ণফুলী টানেলের নির্মাণ তথ্য

চীনের এক নির্মাণ সংস্থা কর্ণফুলী টানেল বা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের নির্মাণ কাজ হাতে পেয়েছে। এবং তারা দক্ষতার সাথে কাজ পরিচালনা করছে। আশা করা যায় ২০২৩ সালের মধ্যে এই টানেলের নির্মাণ কাজ শেষ হবে। টানেলটির মূল দৈর্ঘ্য ৩.৪৩ কিলোমিটার হলেও এর সাথে সংযোগ সড়ক বা এপ্রোচ সড়ক যুক্ত হবে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার।

বঙ্গবন্ধু টানেলের প্রবেশ পথ

বঙ্গবন্ধু টানেলের নকশা অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর টানের বিমানবন্দর হবে এর প্রবেশ পথ অর্থাৎ কর্ণফুলী নদীর দুই কিলোমিটার ভাটির দিকে নৌবাহিনী এভিনিউয়ের সামনে যা চট্টগ্রাম বন্দরের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত।

বঙ্গবন্ধু টানেলের বহিঃগমন পথ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের দৈর্ঘ্য হল ৯.৩৯২ কিলোমিটার যা চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড ও কর্ণফুলী নদীর অপর পাড়ে আনোয়ারা প্রান্তে সার কারখানা কর্ণফুলী ফার্টিলাইজারের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত। এই টানেলটি দুই লেনের টানেল বা ডুয়েল। আর  শিল্প ড্রিভেন মেথন পদ্ধতিতে এই কর্ণফুলী টানেলটি নির্মাণ করা হচ্ছে। এই চ্যানেলটি কর্ণফুলী নদীর তলদেশ থেকে এর গভীরতা হবে ৩৪ ফুট থেকে ১০৮ ফুট বা ১৮ থেকে ৩১ মিটার।

কর্ণফুলী টানেলের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল বা কর্ণফুলী টানেলটি শুধু চট্টগ্রাম শহরের নয় বরং সারাদেশের অর্থনীতিতে সাড়া জাগাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই টানেলটি এশিয়ান হাইওয়ের সাথে যুক্ত হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের প্রকল্পকে ঘিরে দক্ষিণ চট্টগ্রামে ইকোনমিক জোনসহ চলছে বিশাল অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ। চট্টগ্রামের সরকারি- বেসরকারি খাতে সবচেয়ে বড় সার কারখানা চট্টগ্রামের আনোয়ারায় অবস্থিত।

এই টানেলটির নির্মাণ কাজ শেষ হলে কোরিয়ান রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা লিঃ এবং চট্টগ্রাম বন্দরে সকল কার্যক্রম প্রসারণ করা সম্ভব হবে। এছাড়াও দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, এলএনজি সহ বহু শিল্প কারখানা গড়ে উঠবে। প্রস্তাবিত এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে সংযুক্তিসহ সাতটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যে টানে নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলেছে।

এই টানেলের জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হবে এবং ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক আয় অনেক বৃদ্ধি পাবে যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিবে।

টানেলের শিল্পায়ন

কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ে অর্থাৎ আনোয়ারায় অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল স্থাপিত হলে দুই পাড়ে সেতু বন্ধন রচিত হবে এবং এই  টানেলের মধ্যে দিয়ে যার ফলে খরচ ও সময় দুটোই হ্রাস পাবে। এবং পূর্ব প্রান্তের শিল্প কারখানা, কাঁচামাল ও প্রস্তুত মালামাল বিমানবন্দর চট্টগ্রাম বন্দরসহ প্রক্রিয়াজাত সহজ হবে।

বিশেষ করে দেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের কাজ অনেক সহজ হয়ে যাবে। এছাড়াও চট্টগ্রাম বন্দরের আনোয়ারায় চায়না ইকোনোমি জোন স্থাপিত হচ্ছে ৭৮৩ একর জমি নিয়ে। এছাড়াও এখানে ইলেকট্রনিক পণ্য, সিমেন্ট, শিল্পরপ্তানি মুখী জাহাজ শিল্প ও ফ্যান কারখানা সহ শিল্প কারখানায় স্থাপন হবে প্রায় ৩১ টির মত।

বিনিয়োগের প্রসার

কর্ণফুলী টানেল কে ঘিরে দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো কর্ণফুলী নদীর ওপারে বিনিয়োগ শুরু করেছে। বর্তমানে নদীর ওপারে আংশিক শিল্প চালু করেছে কোরিয়ান ইপিজেড। এছাড়াও সরকার টানেলের নির্মাণের সঙ্গে সমন্বয় রেখে আনোয়ারায় একটি ইকোনোমিক্স জোন স্থাপন করেছে। এছাড়াও চীনের বিনিয়োগকারীদের জন্য চায়না ইকোনমিক জোন বাস্তবায়িত হচ্ছে।

কর্ণফুলী টানেলের যোগাযোগ ব্যবস্থা

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল বা কর্ণফুলী টানেলটি নির্মিত হলে ঢাকা-চট্টগ্রাম কক্সবাজারের মধ্যে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। এছাড়া ও এশিয়ান হাইওয়ের সাথে সহজ যোগাযোগ স্থাপিত হবে। এছাড়া এই টানেলের সঙ্গে যুক্ত করতে টানেলের পশ্চিম প্রান্তে ৭২৭মিটার ও পূর্বপ্রান্তে পাঁচ ৫ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করা হবে। চট্টগ্রাম শহরের সঙ্গে আনোয়ারা উপজেলার ও যোগাযোগ রক্ষা পাবে।

কর্ণফুলী টানেলে শিল্পের উন্নয়ন

কক্সবাজার, বান্দরবান, সেন্ট মার্টিন, পাহাড়, সমুদ্র ও নদীসহ দেশের প্রধান পর্যটন এলাকা গুলোতে সৌন্দর্য উপভোগ করতে বিভিন্ন দেশি- বিদেশি পর্যটকদের যোগাযোগের ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে এই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। আর সেই সাথে নিরসন হবে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের যানজট।

বেকারত্ব দূরীকরণ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল কে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যে বিভিন্ন ধরনের ২৩ টি প্রতিষ্ঠান এবং এছাড়া ও তিনটি বড় বড় কোম্পানি যেমন – ডেভেলপমেন্টাল কোম্পানি, গায়া প্রোডাক্ট ও ডেইগু প্রোডাক্ট কোম্পানি সহ অনেক কোম্পানি তাদের স্থাপনের কাজ শুরু করেছে। এছাড়াও এই এলাকায় রপ্তানি মুখী জুতা, তৈরি পোশাক, টেক্সটাইল সহ নানা উৎপাদন মুখী শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হবে।

আর এইসব কোম্পানি স্থাপনের ফলে বেকারত্ব দূরীকরণ সম্ভব হবে। আর এই বেকারত্ব দূরীকরণে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল বা কর্ণফুলী টানেল।

সৌন্দর্য বর্ধন ও সবুজায়ন

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল বা কর্ণফুলী টানেল এর চার লেনের ১০ কিলোমিটার সড়কে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ পরিচালিত সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ করা হবে ৩০ মিটার এবং এ সড়কে কাফকো ও সেন্টার ক্রান্তির হাট থেকে জেলেঘাট পর্যন্ত ফ্লাইওভার হবে ৭৫০মিটার। আর এই সড়কের দুই পাশে সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য তৈরি হবে ড্রেন এবং করা হবে সবুজায়ন।

কর্ণফুলী টানেলের বর্তমান অবস্থা

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল বা কর্ণফুলী টানেলের ২0২0 সালের নভেম্বরে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা প্রান্ত থেকে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ বয়ে নদীর উপরে আনোয়ারা পর্যন্ত দক্ষিণ সুরঙ্গের পূর্তকাজ শেষ হয়েছে। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত এই সুরঙ্গটি জান চলাচলের জন্য প্রস্তুত। তবে পতেঙ্গা থেকে আনোয়ারা মুখি এই সুরঙ্গের কাজ এখন শেষের পথে।

আর এই উত্তর দিকের কাজ শেষ হলে যান চলাচলের জন্য এই টানেলটি উন্মুক্ত করে দেয়া হবে। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে টানেলের দ্বিতীয় টিউবের কাজ শুরু হয় এবং ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে এই টানেলের নির্মাণ কাজ শেষ হয়। টানেলের চারটি মুখ খুলে দেওয়া হবে আনোয়ারা প্রান্ত থেকে পতেঙ্গা প্রান্ত পর্যন্ত। যারা এই প্রকল্পের কাজে নিয়োজিত আছেন তারা এই টিউবের ভিতর দিয়ে টিউবের এপার থেকে ওপারে যেতে সক্ষম হচ্ছেন।

 এছাড়া ও সুরঙ্গের মধ্যে পিচ ঢালা সড়ক নির্মাণের কাজ শেষ হওয়ার পথে।তত্ত্বাবধানে দ্রুত কাজে এগিয়ে চলেছে।এই প্রকল্পের কাজ ২৪ ঘন্টায় চলছে। এছাড়া ওই কাজে নিয়োজিত করা হয়েছে বাড়তি জনবল, অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি। তবে এই টানেলে এখন বৈদ্যুতিকও যান্ত্রিক কাজগুলো চলছে। তবে এই কাজগুলোর অগ্রগতি ও সন্তোষজনক।

এছাড়াও এই টানেলের ভিতরে অগ্নি প্রতিরোধক বোর্ড, ডেকোরেটিভ বোর্ড স্থাপনের কাজও চলছে। এই টানেলে দুই প্রান্তে ১৫ মেগাওয়াটের একটি করে দুইটি সাব স্টেশন স্থাপিত হবে। বিদ্যুতের এই সাব স্টেশন গুলো নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে শুধু সংযোগ দেওয়া বাকি রয়েছে।

উপসংহার

চট্টগ্রাম বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর এবং প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র। এই চট্টগ্রাম শহরে বাস করে প্রায় ৫৭ লক্ষ ৪০ হাজার মানুষ। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি বড় কর্মসংস্থান হল চট্টগ্রাম বন্দর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল বা কর্ণফুলী টানেল নির্মিত হলে কর্ণফুলী নদীর দুই পাড়ের দুটি শহর সিটিতে পরিণত হবে। এছাড়াও ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা কাজের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

দেশের অর্থনীতিতে ঘটবে উন্নয়ন। যার ফল দেশবাসী ভোগ করবে। স্বপ্নের টানেলের সুযোগ হবে স্বপ্নের মতই। আর এই টানেলের উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে দেশবাসী।

5/5 - (1 vote)