প্রশ্নঃ 
সাইমনের যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ তত্ত্বের সমালোচনা কর

ভূমিকাঃ মানুষের ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে সামাজিক, রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রীয় জীবনে বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। রাষ্ট্র বা সংগঠনের সর্বোচ্চ পর্যায়ের পদাধিকারী ব্যক্তিগণকে বৃহত্তর বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রদান করতে হয়, যার উপর একটি সংগঠন, সংস্থা বা একটি জাতি নির্ভরশীল থাকতে পারে। সিদ্ধান্তের উপযুক্ততা, শ্রেষ্ঠত্ব ও কুশলতার উপরও নির্ভর করে অনেকের ভাগ্য। ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল বিষয় আর কমই আছে। তাই সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া সমাজবিজ্ঞানীদের নিকট এক অন্যতম অধ্যয়নের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় বা জাতিগতভাবে বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যারা বিশ্বের মানব সম্প্রদায় বিষয়টির উপর অত্যধিক গুরুত্ব দিয়ে চলেছে। কারণ যুদ্ধ পরবর্তী সময়কালে সমাজজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিভিন্ন রকম জটিলতা বৃদ্ধির সাথে সাথে নির্ভুল ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা আরো অনেক বেশি অনুভূত হয়ে চলেছে। তাই হার্বার্ট সাইমন (Herbert Simon) সিদ্ধান্ত গ্রহণকে ‘Heart of Administration’ বলে অভিহিত করেছেন। 

সাইমনের যৌক্তিক সিদ্ধান্তের মডেল (Model of Rational Decision of Simon): রাজনীতি বা প্রশাসনে যৌক্তিকতা বিশ্লেষণে সাইমন প্রথম ব্যক্তি নন, তবে তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় এ তত্ত্বের সর্বাধিক বাস্তবভিত্তিক ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। সাধারণভাবে, একজন যৌক্তিক মানুষ হচ্ছেন তিনি যিনি এমনভাবে তার কর্মপন্থা নির্ধারণ করেন যাতে সর্বাধিক লক্ষ্য অর্জিত হয় এবং ক্ষতির পরিমাণ সর্বনিম্ন হয়। কাজেই যে কর্মপন্থা বা সিদ্ধান্ত সর্বাধিক লক্ষ্য অর্জন করতে পারে, তাই যৌক্তিক।

সাইমন (Simon) বলেছেন, “Rationality is concerned with the selection of preferred behavior alternatives in terms of some system. of values whereby the consequences of behavior can be evaluated.”

প্রকৃতপক্ষে সাইমনের যৌক্তিক সিদ্ধান্ত এমন এক প্রক্রিয়া যাতে সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নের মাধ্যমে বিভিন্ন বিকল্প থেকে উত্তম বিকল্প নির্বাচন করা হয়। কাজেই যৌক্তিক সিদ্ধান্তে সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিভিন্ন পর্যায় যথাযথভাবে অনুসরণ করে প্রাপ্ত তথ্যের যাচাই-বাছাই করে সবচেয়ে উত্তম বিকল্প নির্বাচন করা হয়।

যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ তত্ত্বের সমালোচনা (Criticisms of the Rational Decision Making): হার্বার্ট এ. সাইমনের যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের মডেলটি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও বিভিন্ন দিক হতে তা সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। এমনকি সাইমন নিজেও তার পরবর্তী লেখাসমূহে এ মডেলের সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, মানুষের পক্ষে সম্পূর্ণ যৌক্তিকতা অর্জন করা সম্ভব নয়। মূল্যবোধের প্রতি আস্তা বা বিশ্বাস স্থাপন মানুষকে সীমিত করে দেয়। এর ফলে তার আচরণ ‘Bounded Rationality’ দ্বারা আক্রান্ত হয়। জ্ঞানের অসম্পূর্ণতা, অংশগ্রহণের জটিলতা প্রভৃতি যৌক্তিক সিদ্ধান্ত প্রণয়নের ক্ষেত্রে অন্যতম দুর্বলতা। বস্তুত নৈতিকতা এবং মূল্যবোধ যৌক্তিক সিদ্ধান্তকে সীমিত করে তোলে। 

অধ্যাপক আই. শারকাভস্কী (Prof. I. Sharkavsky) সাইমনের মডেলের অন্যতম সমালোচক। তিনি একে অবাস্তব এবং অচল বলে উল্লেখ করেছেন। কারণ, জরুরি পরিস্থিতিতে, যুদ্ধ পরিস্থিতিতে, যৌক্তিকতা, আচরণ ইত্যাদি বিশ্লেষণের ফলে যে কালক্ষেপণ হয় তার ফলে মূল উদ্দেশ্য অর্জন ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। 

সি. লিডরুম (C. Lindbloom) বলেছেন, সাইমনের মডেলে একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করা হয়েছে। তা অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং কালক্ষেপণকারী। 

আমিতাই এজায়োনির (Amitai Etzioni ) মতে, সাইমনের যৌক্তিক সিদ্ধান্ত সঠিকভাবে নির্ধারণ করার কোন নির্দিষ্ট মানদণ্ড নেই। একজনের নিকট যা যৌক্তিক অন্যজনের নিকট তা যৌক্তিক নাও হতে পারে। 

সমাপনীঃ উপরোক্ত সমালোচনা সত্ত্বেও হার্বার্ট সাইমনের যৌক্তিক সিদ্ধান্ত প্রণয়ন মডেলটি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। তার এ মডেল পরবর্তীকালে সিদ্ধান্ত প্রণয়ন তত্ত্বগুলোর অন্যতম ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে।

Rate this post