অগণিত গ্যালাক্সি, ব্ল্যাক হোল, নক্ষত্র, গ্রহ সবকিছু আমাদের এতটাই মুগ্ধ করে যে আমরা আরও বেশি আগ্রহী হয়ে উঠি এদের সৃষ্টি রহস্য জানতে। আজ আমরা এমনি কিছু অবাক করা প্রশ্নের উত্তর খুঁজব।

বিজ্ঞানীরা শত শত বছর ধরে মহাবিশ্বের সৃষ্টি তত্ত্ব আবিষ্কার করার চেষ্টা করেছেন। এমনকি তারা একের পর এক বিস্ময়কর তত্ত্ব আবিষ্কার করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক যুক্তি ও সূত্র ব্যাবহার করে দেখিয়েছেন যে এই মহাবিশ্ব কীভাবে সৃষ্টি হয়েছে এবং কীভাবে এই অগণিত গ্রহ, নক্ষত্রসহ সমস্ত মহাজাগতিক বস্তু তৈরি হয়েছে।

বিজ্ঞানের বিভিন্ন আবিষ্কারের মধ্যে মহাবিশ্বের সৃষ্টি তত্ত্ব আবিষ্কার বিজ্ঞানীদের জন্য ছিল এক লম্বা ভ্রমণ। প্রাচীন কাল থেকে শুরু করে বিভিন্ন মনিষী ও বিজ্ঞানীদের অসংখ্য মতবাদ রয়ে গেছে মহাবিশ্ব সৃষ্টির রহস্য নিয়ে। মহাবিশ্বের সৃষ্টি ব্যাখ্যায় বিভিন্ন বিজ্ঞানী বিভিন্ন সময় নানান তত্ত্বের ধারণা দিয়েছেন। তবে মহাবিশ্ব ও পৃথিবী কীভাবে সৃষ্টি হয়েছিল সে সম্পর্কে বিভিন্ন প্রচলিত তত্ত্বের মধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত ও গ্রহণযোগ্য তত্ত্ব টি হল “মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব” বা “বিগ ব্যাং” থিওরি।

জর্জ ল্যামাটার কে আধুনিক বিগ ব্যাং তত্ত্বের প্রবর্তক বলা হয়। অবশ্য এই তত্ত্বটির এতটা গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার পেছনে বেশ জোরালো কিছু যুক্তি রয়েছে। তো চলুন দেখে নেওয়া যাক কি এই মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব এবং কেনই বা এটি এতটা জনপ্রিয়।

“মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব” বা “বিগ ব্যাং” কী?

এই তত্ত্ব অনুসারে, কোটি কোটি বছর আগে মহাবিশ্বের সবকিছুই একটি অতি উষ্ণ এবং অতিক্ষুদ্র বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত ছিল। এর ঘনত্ব এতটাই বেশি ছিল যে মহাজগতের সকল কণা ও শক্তি এই ক্ষুদ্র বিন্দুতে আবদ্ধ ছিল। অধিক ঘনত্ব, ভর ও তাপমাত্রার কারণে, এটি প্রবলভাবে বিস্ফোরিত হয় এবং প্রচণ্ড বেগে চারদিক বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়তে থাকে। এই বিস্ফোরণের পর বিক্ষিপ্ত কণাসমূহের খুব সামান্য অংশ “মিনিট পার্টিকেল” এ রূপান্তরিত হয়। তবে হ্যাঁ, এই ‘সামান্য’ কিন্তু বিশালত্বের দিক দিয়ে আমাদের কল্পনাকেও ছাড়িয়ে যাবে।

এরপর এই মিনিট পার্টিকেল গুলো ধীরে ধীরে শীতল হতে শুরু করে এবং মহাকর্ষ বলের কারণে একত্রিত হয়ে বিভিন্ন মহাজাগতিক বস্তু গঠন করা শুরু করতে থাকে। তবে এটি কোন দ্রুত প্রক্রিয়া নয়। লক্ষ কোটি বছর ধরে এ প্রক্রিয়া চলতে থাকে।

এই মহাবিশ্বের নক্ষত্র, গ্রহ, স্থান, কণা, শক্তি সবকিছু এই প্রক্রিয়ায় ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছে। এই তত্ত্বটিই আমাদের কাছে “বিগ ব্যাং” বা মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব হিসেবে পরিচিত।

আরও পড়ুন- মহাবিশ্ব নিয়ে ১১ টি চমকপ্রদ তথ্য | 11 Space facts 

 

মহাবিস্ফোরণ তত্ত্বের প্রমাণ

নিশ্চয়ই এত এত মহাজাগতিক বস্তু একটি ক্ষুদ্র বিন্দু থেকে তৈরি হওয়া অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে? তবে তাত্ত্বিক ভাবে এটি কিন্তু সত্য হিসেবে প্রমাণিত। বিজ্ঞানীরা আমাদের বিভিন্ন মহাজাগতিক ঘটনার ব্যাখ্যা দিয়ে এই তত্ত্বের প্রমাণ দেখিয়েছেন।

প্রায় ১৩.৭ বিলিয়ন বছর আগে ধীরে ধীরে গ্রহ, নক্ষত্র, গ্যালাক্সি এবং বিভিন্ন ধরণের মহাজাগতিক বস্তুর সৃষ্টি শুরু হয়। বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন নক্ষত্রের মধ্যে দূরত্ব বৃদ্ধি পর্যালোচনা করে প্রমাণ করেছেন যে মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে। মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তু একে অপরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এই প্রসারণ কেবল দুটি বস্তুর মধ্যে দূরত্ব বৃদ্ধি নয়, এটি প্রত্যেক বস্তুর মধ্যে দূরত্ব বৃদ্ধি। আর এটি কেবল তখনই সম্ভব যখন কোন বিস্ফোরণ প্রক্রিয়া শুরু করে, আর যা কি না বিগ ব্যাং এর অস্তিত্ব কেই প্রমাণ করে।

এছাড়াও আরও কিছু তাত্ত্বিক প্রমাণ রয়েছে। আসুন দেখে নেওয়া যাক-

আমাদের মহাবিশ্বে শত শত কোটি গ্রহ, তারা, গ্যালাক্সি ইত্যাদি রয়েছে। আর মহাবিশ্বের অপরিহার্য এবং সর্বাধিক অংশ হল শক্তি। আইনস্টাইনের বিখ্যাত সমীকরণ E = mc2 অনুসারে, কণা এবং শক্তি কোনও আলাদা রূপ নয়। এখন আমরা যদি মহাবিশ্বের মোট কণার সংখ্যা হিসাব করি তবে একটি ধনাত্মক সংখ্যা পাওয়া যাবে। আবার মহাবিশ্বের মোট শক্তি হিসাব করলে একটি ঋণাত্মক সংখ্যা পাওয়া যাবে। কারণ মাধ্যাকর্ষণ শক্তি একটি ঋণাত্মক শক্তি। এই দুটি যোগ করলে আমরা প্রাপ্ত ফলাফল হবে শূন্য। সুতরাং, মহাবিশ্ব তৈরির জন্য কোন অতিরিক্ত কণা এবং শক্তির প্রয়োজন নেই।

এখন আমরা যদি মোট ধনাত্মক এবং ঋণাত্মক চার্জ গণনা করি সেক্ষেত্রেও এদের যোগ করে শূন্য পাওয়া যাবে। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে মহাবিশ্ব গঠনের জন্য কোন চার্জের প্রয়োজনও নেই।

এবার আসি স্পিন বা ঘূর্ণনের হিসাবে? হ্যাঁ, আমরা যদি মোট স্পিন গণনা করি, তবে আমরা আবারও শূন্য পাব। সুতরাং, মহাবিশ্বের মোট চার্জ, স্পিন এবং শক্তি-কণার সমষ্টি শূন্য। এটি আসলে আমাদের দেখায় যে মহাবিশ্ব একটি ক্ষুদ্র বিন্দু থেকে তৈরি হয়েছিল।

আমাদের ছায়াপথ এর উৎপত্তি

বাবল ইউনিভার্স তত্ত্ব অনুযায়ী, আমাদের মহাবিশ্বের মত এরকম অসংখ্য মহাবিশ্ব রয়ছে। তবে সে যাই হোক, বিভিন্ন হিসাব অনুযায়ী দৃশ্যমান মহাবিশ্বে প্রায় 300-400 বিলিয়ন গ্যালাক্সি রয়েছে, এর মধ্যে আমাদের সৌরজগত অবস্থিত মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে।

বিগ ব্যাং এর পরবর্তী সময়ে, উত্তপ্ত মিনিট পার্টিকেল গুলো মহাকর্ষ বলের কারণে একত্রিত হতে থাকে এবং বৃহৎ আকারের নক্ষত্র গঠন করতে থাকে। এই প্রক্রিয়া কয়েক মিলিয়ন বছর ধরে চলতে থাকে। নিকটস্থ নক্ষত্র গুলো মহাকর্ষ বলের প্রভাবে একে অপরের কাছাকাছি আসতে থাকে এবং ধীরে ধীরে বিভিন্ন ছায়াপথ তৈরি হতে থাকে। 

তবে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিটি সামান্য ব্যতিক্রম ভাবে তৈরি হয়েছিল। এটি দুটি ভিন্ন গ্যালাক্সির সমন্বয়ে আজকের মিল্কিওয়েতে পরিণত হয়। দশ হাজার মিলিয়ন বছর আগে দুটি পৃথক স্টেলার সিস্টেমে উৎপত্তি হওয়া নক্ষত্রের মিলন হলে তৈরি হয় মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি। এই নক্ষত্র দুটির একটি ছিল বামন ছায়াপথ যা আমরা গাইয়া-এনস্ল্যাডাস নামে অভিহিত করি এবং অন্যটি ছিল আমাদের গ্যালাক্সির মূল প্রজেক্টর, যা ছিল প্রায় চারগুন বড় এবং এক বৃহৎ ধাতুর সম্ভার। এই পৃথক গ্যালাক্সি দুটি প্রায় ত্রিশ হাজার মিলিয়ন বছর পূর্বে দুটি ভিন্ন স্টেলার সিস্টেমে গঠিত হয়েছিল এবং দশ হাজার বছর পূর্বে এদের মিলনের ফলে তৈরি হয় আমাদের আজকের এই গ্যালাক্সি। কি? মহাবিশ্ব নিয়ে এরকম আরও মজার তথ্য জানতে চান? 

মিল্কিওয়ে ছায়াপথের গঠন

মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিটি একটি বৃহৎ গ্যালাক্সি এবং গ্যাস ও ধূলিকণার সমন্বয়ে গঠিত। মহাবিশ্বে বিভিন্ন আকার এবং আকৃতির গ্যালাক্সি বা ছায়াপথ রয়েছে। আমাদের ছায়াপথটি একটি বড় সর্পিলাকার ছায়াপথ। মজার ঘটনা হল আমরা রাতের আকাশে যে সমস্ত তারা দেখি তার অধিকাংশই আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতেই অবস্থিত। অন্য গ্যালাক্সি বা ছায়াপথের নক্ষত্রও দেখতে পাই, তবে এদের মধ্যে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির নক্ষত্র সংখ্যাই বেশি।

গ্যালাক্সির ভিতরে আমাদের অবস্থান থেকে মিল্কিওয়ের নক্ষত্রের সংখ্যা গণনা খুবই কঠিন – হ্যাঁ, প্রায় অসম্ভভ। তবে বিভিন্ন বিজ্ঞানভিত্তিক পরিক্ষা থেকে জানা যায় যে মিল্কিওয়ে প্রায় 200-300 বিলিয়ন নক্ষত্র নিয়ে গঠিত। এই নক্ষত্রগুলি একটি বৃহৎ ডিস্ক গঠন করে আছে যার ব্যাস প্রায় 100,000 আলোক-বর্ষ (1 আলোক-বর্ষ হল আলো প্রতি এক সেকেন্ডে 300000000 মিটার অতিক্রম করে তবে এক বছরে যে দুরত্ব অতিক্রম করবে সেটি) আমাদের সৌরজগৎ আমাদের ছায়াপথের কেন্দ্র থেকে প্রায় 25,000 আলোক-বছর দূরে রয়েছে। পৃথিবী যেমন সূর্যের চারদিকে ঘোরে, তেমনি সূর্য মিল্কিওয়ের কেন্দ্রের চারদিকে ঘোরে যেখানে একটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল অবস্থিত। আমাদের সূর্য মিল্কিওয়ের কেন্দ্রকে একবার ঘুরে আসতে প্রায় 250 মিলিয়ন বছর সময় নেয়।

ভিডিও তে দেখে নিন- স্পেস নিয়ে ৫ টি চমৎকার তথ্য

শেষ কথা

অনেক সময় মহাবিশ্বের সৃষ্টি তত্ব ও এর মহাজগতিক বস্তুর সৃষ্টি হওয়া নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের অবতারনা হয়েছে। কেউ কেউ আবার এই তত্ত্ব গুলোকে সম্পুর্নই ভিত্তিহীন দাবি করে থাকেন। তবে এই তত্ত্বগুলো যে একদমই ছেলেখেলা নয় তা বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন সময় প্রমণ করিয়েও দেখিয়েছেন। তবে মানুষের জ্ঞানের পরিসীমা খুবই নগন্য। নির্মম সত্যটি হল মানুষ কখনো এই মহাবিশ্বের কুলকিনারা করে উঠতে পারবে কি না বলা কঠিন। হয়তো আমরা অনেক কিছু জেনেছি বা আবিস্কার করেছি। কিন্তু কে জানে, তা হয়তো চুলসামান্যও নয়। এই অসীম মহাবিশ্বে আমরা অতি নগন্য।

আরও পড়ুন- বাবল ইউনিভার্স- যে মহাবিশ্ব আমাদের কল্পনারও বাইরে । Bubble Universe

Rate this post