প্রশ্নঃ 
ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের সম্পর্ক আলোচনা কর। 

ভূমিকাঃ সাম্প্রতিককালে লোক প্রশাসনে যে সকল ধারণা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে চলেছে, এগুলোর মধ্যে ‘ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব’-এর ধারণা নিঃসন্দেহে অন্যতম। তবে এখানে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব বলতে মূলতঃ প্রশাসনিক ক্ষমতা এবং প্রশাসনিক কর্তৃত্বকেই বুঝানো হয়েছে। শিল্পায়ন, শহরায়ন, অর্থনৈতিক মন্দা এবং যুদ্ধ প্রভৃতি কারণে প্রশাসনের ভূমিকার দ্রুত পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে। জনগণও আজ অর্থনৈতিক, সামাজিক ক্ষেত্রে সরকারের অধিকতর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। 

প্রশাসনিক ক্ষমতা (Power or Administrative Power): প্রশাসনিক ক্ষমতা বলতে সরকারি নীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রশাসনিক সংস্থার নিকট অর্পিত ক্ষমতাকে বুঝায়। প্রশাসনিক সংস্থার ক্ষমতার উৎস প্রধানত দু’টি, যথাঃ আইন এবং আইন, রীতিনীতি ও প্রথার অনুমোদনসাপেক্ষে স্ববিবেচনামূলক ক্ষমতা।

কর্তৃত্ব বা প্রশাসনিক কর্তৃত্ব (Authority or Administrative Authority): ক্ষমতা প্রয়োগের জন্যই কোন না কোন ধরনের কর্তৃত্বের প্রয়োজন। কর্তৃত্ব ব্যতীত ক্ষমতা অর্থহীন। ক্ষমতাকে বৈধ বলে গণ্য করা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা বৈধতা (Legitimacy) একটি কাঠামোর মাধ্যমে প্রকাশিত হওয়া প্রয়োজন। তা না হলে বৈধতা বিমূর্ত ধারণায় পরিণত হবে যে সাংগঠনিক কাঠামোর মাধ্যমে ক্ষমতার বৈধতা মূর্ত হয়ে উঠে, তাকে কর্তৃত্ব বলে। 

ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের সম্পর্ক (Relation Between Power and Authority): ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের সম্পর্ক নিঃসন্দেহে একটি জটিল প্রশ্ন। কর্তৃত্ব ব্যতীত ক্ষমতা অর্থহীন। আবার ক্ষমতা ব্যতীত কর্তৃত্বের উদ্ভব সম্ভব নয়। মোট কথা ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।

কর্তৃত্ব শব্দটিকে অপরের আনুগত্য লাভের ক্ষমতা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। কোন বিষয়ে ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নিজের কর্তৃত্ব আরোপ করতে পারেন। ক্ষমতা আপনাতেই কৰ্তৃত্ব নয়। ক্ষমতার বলে মানুষ কর্তৃত্ব দাবি করে, কিন্তু তা কতখানি সফলতা লাভ করে, তা অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে। অপরদিকে কর্তৃত্ব বলতে আমরা যে কোন সমাজব্যবস্থার ভিতর নীতি নির্ধারণ করার, সংশ্লিষ্ট প্রশ্নাদিতে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করার এবং বিরোধ মীমাংসা করার বা আরও স্থূলভাবে বলতে গেলে, অন্যান্য মানুষের নেতা বা পথ নির্দেশক হিসেবে কাজ করার প্রতিষ্ঠিত অধিকারকেই বুঝি। কর্তৃপক্ষ বলতে’ ঐরূপ অধিকারসম্পন্ন কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তি সমষ্টিকেই বুঝানো হয়। এখানে ক্ষমতার উপর নয়, বরং অধিকারের উপরই প্রধানত গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এককভাবে ক্ষমতার কোন বৈধতা নেই, কোন ম্যান্ডেট নেই, কোন পদ নেই।

কর্তৃত্বের নীতি হলো অধিকারপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গের অন্য ব্যক্তিদের উপর পথ প্রদর্শক বা নীতি নির্ধারক হিসেবে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে কর্ম সম্পাদন করা। কর্তৃত্ব অর্জন ব্যতীত কোন ব্যক্তি কোন প্রকার সংগঠন পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারেন না। যেহেতু কোন কাজ সম্পাদন করার ক্ষমতা হচ্ছে কর্তৃত্ব এবং এসব কাজ সম্পাদন করার বাধ্যবাধকতা হচ্ছে দায়িত্ববোধ। সেহেতু কাজ সম্পাদন করার দায়িত্ব দেয়া হলে সাথে সাথে সমপরিমাণ ক্ষমতাও প্রদান করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। অনেক সময় দেখা যায় ঊর্ধতন প্রশাসকগণ তাদের অধস্তন কর্মচারীদের দায়িত্ব পালনে যথাযথ ক্ষমতা প্রদান না করেই দায়িত্ব পালনে অর্থাৎ কার্য সম্পাদনের ব্যাপারে দায়ী করেন। এরূপ আচরণ কোনভাবেই যুক্তিসংগত বা গ্রহণযোগ্য নয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় কার্য সম্পাদনের পর্যাপ্ত ক্ষমতা প্রদান করা হয়, কিন্তু এরূপ ক্ষমতার সদ্ব্যবহারের জন্য তাকে দায়ী করা হয় না। এরূপ ব্যবস্থাপনায় কর্তৃত্ব ও দায়িত্ব সমানভাবে পরিলক্ষিত হয় না। অর্থাৎ কর্তৃত্ব নীতির মূলবিষয় যথাযথভাবে কর্তৃত্ব অর্জন এবং দায়িত্ব পালনের বিষয়টি গৌণ ও উপেক্ষিত হয়ে যায়।

কর্তৃত্বের নীতিতে কর্তৃত্ব অর্পণের প্রয়োগের সাথে সাথে দায়িত্বের প্রশ্নটিও বড় হয়ে দেখা দেয়। অনেক সময় দেখা যায় কর্তৃত্ব ও দায়িত্বের মধ্যে ক্ষমতা নীতির প্রয়োগ অনুপস্থিত। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, কোন প্রশাসককে কোন কাজ করার ক্ষমতা দেয়া হয়, অথচ তা সম্পাদন করার জন্য দায়ী করা যায় না। যেমনঃ ভোগ্যদ্রব্য সরবরাহ কর্পোরেশনের ম্যানেজারকে জিনিস বিক্রির ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, কিন্তু জনগণ যদি এরূপ পণ্য ক্রয় না করে সে জন্য প্রশাসক দায়ী নন। যদিও পণ্য বিক্রি বা বিক্রির পরিমাণ বাড়ানোর জন্য মানবিক ও বৈষয়িক সম্পদ ব্যবহার করার ক্ষমতা তার রয়েছে, কিন্তু জনগণকে জিনিস ক্রয় করতে বাধ্য করার ব্যাপারে তার কোন দায়িত্ব নেই। সে জন্য তিনি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নিকট দায়ী নন।

কর্তৃত্ব যদি বাহ্যিক অবস্থা এবং অভ্যন্তরীণ বাধা নিষেধ দ্বারা সীমিত হয় তাহলে দায়িত্বও সে পরিমাণে হ্রাস পায়। কর্তৃত্ব যদি সীমিত পরিমাণে হস্তান্তর করা হয় তাহলে সীমিত পর্যায়ে অধস্তন কর্মচারীর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে যেসব কাজ রয়েছে কেবল তার জন্যই তাকে দায়ী করা হবে। সংগঠনের বর্তমান অবস্থা এবং তার উন্নয়নকল্পে একজন অধস্তন কর্মচারীর ক্ষমতা সীমিত থাকতে পারে কিন্তু তাই বলে তার দায়িত্বও যে সীমিত হবে এমন কোন যুক্তি নেই। সংগঠনের জন্য ক্ষতিকর সম্ভাব্য সমস্যার সমাধান বা তার উপায় বের করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের থাকা অত্যাবশ্যক।

শেষকথাঃ পরিশেষে উল্লেখ্য, যেসব বিষয় অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে বেসরকারি খাতে ন্যস্ত ছিল, বর্তমানে তা সরকারি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে এবং সরকারের এ নিয়ন্ত্রণ পরিধি দিন দিন বেড়েই চলছে। জনকল্যাণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শ্রমিক সম্পর্ক, কৃষি উৎপাদন, বিনিয়োগ ব্যবস্থা, জনসেবা প্রদানকারী অনেক প্রতিষ্ঠান আজ সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন। সরকারি নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধির সাথে সাথে প্রশাসনিক সংস্থার কর্তৃত্ব ও স্ববিবেচনামূলক ক্ষমতাও বেড়ে চলেছে।

Rate this post